জশনে জুলূস ও আমরা

গত ২৭শে জুন’৯৯ রবিবার দেশব্যাপী মহা সমারোহে ‘ঈদে মীলাদুন্নবী’ পালিত হ’ল। ঈমানী তেজে বলীয়ান হ’ল বাংলাদেশের মুসলিম সমাজ। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হ’ল সবাই। ইসলামপন্থী, ধর্মনিরপেক্ষ বা জাতীয়তাবাদী সকল দলের মুসলমান স্ব স্ব দৃষ্টিকোণ থেকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জীবন চরিত ব্যাখ্যা করলেন বিভিন্ন মীলাদ মাহফিল, সেমিনার, সুধী সমাবেশ ইত্যাদির মাধ্যমে। পত্রিকা সমূহ বিশেষ সংখ্যা বা ক্রোড়পত্র বের করল। বের হ’ল বড় বড় ধর্মীয় মিছিল ও সড়ক কাঁপানো জশনে জুলূসে ঈদে মীলাদুন্নবী (ছাঃ)-এর দীর্ঘ শোভাযাত্রা। প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেত্রী, জাতীয় সংসদের স্পীকার সকলেই সুন্দর সুন্দর বাণী প্রদান করলেন। সকলেই সকলকে রাসূল (ছাঃ)-এর উত্তম জীবনাদর্শ অনুসরণের আহবান জানালেন এবং বললেন যে, রাসূল (ছাঃ)-এর আদর্শ বাস্তবায়নের মধ্যেই কেবল বিশ্বশান্তি নির্ভর করছে। কতই না সুন্দর কথা সব। সেই সাথে ব্যয় হ’ল সরকারী রাজস্ব ও বেসরকারী সম্পদের একটি বিরাট অংশ। এক্ষণে প্রশ্ন হ’ল- কি জন্য এই জোশ? কি জন্য এই ভালবাসার প্রদর্শনী?

জবাব যদি এটাই হয় যে, রাসূল (ছাঃ)-এর জন্মে আমরা খুবই খুশী। তাই আনন্দের প্রকাশ ঘটাচ্ছি মাত্র। তবে তো বলা যাবে যে, রাসূল নয় মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহর জন্ম মুহূর্তে খুশী হয়েছিলেন এই পিতৃহীন ইয়াতীম শিশুর দাদা-চাচা ও নিকটাত্মীয় জাহেলী আরবের নেতারা। এমনকি চাচা আবু লাহাব এই সুসংবাদ পেয়ে খুশী হয়ে সংবাদ বাহিকা ক্রীতদাসী ছুওয়াইবাকে মুক্ত করে দিয়েছিলেন। দাদা আব্দুল মুত্ত্বালিব, চাচা আবু তালিব তাঁকে জীবন দিয়ে আদর-যত্ন করেছিলেন। সারা আরবের লোক তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিল। তাঁকে সকলে ‘আল-আমীন’ বা ‘বিশ্বস্ত’ বলে আহবান করত। শৈশব, কৈশোর, তারুণ্য ও যৌবন পেরিয়ে প্রৌঢ়ত্বের শুরুতে ৪০ বৎসর বয়সে যেমনি মাত্র তিনি প্রচলিত শিরকী প্রথা সমূহের বিরোধিতা করে তাওহীদের দাওয়াত দিলেন, অমনি শুরু হ’ল বিরোধিতা, চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র, গীবত, তোহমত, চরিত্রহনন, সমাজচ্যুতি, বয়কট, দৈহিক ও মানসিক নির্যাতন, হত্যার ষড়যন্ত্র এবং অবশেষে চিরদিনের মত মাতৃভূমি ত্যাগ ও মদীনায় হিজরত ও সেখানেই মৃত্যুবরণ।

যে চাচা আবু লাহাব ভাতীজার জন্মে খুশীতে বাগবাগ হয়েছিল। সেই চাচা ছাফা পাহাড়ে ভাতীজার নিকট থেকে তাওহীদের দাওয়াত পেয়ে রাগে-দুঃখে-ক্ষোভে বলে উঠল : ‘তুমি এজন্য আমাদেরকে এখানে জমা করেছ?’ অতঃপর কুরায়েশ-এর প্রায় সব নেতাই রাতারাতি তাঁর শত্রু হয়ে গেল।

বুঝা গেল যে, ভাতীজা মুহাম্মাদকে গ্রহণ করলেও রাসূল মুহাম্মাদকে তারা বরদাশত করেনি। তারা তাঁর আনীত শরী‘আতকে গ্রহণ করেনি। যদিও তারা আল্লাহকে, হাশর-নশরকে, ক্বিয়ামত ও হিসাব-নিকাশকে, জান্নাত ও জাহান্নামকে, হজ্জ ও ওমরাহকে, সর্বোপরি আল্লাহর ঘর কা‘বাকে বিশ্বাস করত। কিন্তু আল্লাহর বিধানকে তারা মানেনি। কিছু ক্ষেত্রে তারা নিজেদের বিধান জুড়ে দিয়েছিল। ইবাদতের ক্ষেত্রে আল্লাহর সাথে অসীলা পূজারী হয়েছিল। মৃত নেককার লোকদের মূর্তি গড়ে তারা কা‘বা গৃহে জমা করেছিল ও তাদের অসীলায় ও সুফারিশে আল্লাহর নিকটে মুক্তি কামনা করেছিল। রাসূল মুহাম্মাদ (ছাঃ) স্বীয় বাপ-দাদাদের শিরকী আক্বীদা ও আমলের বিরোধিতা করলেন। ফলে সবাই হ’ল তাঁর শত্রু এবং তিনি হ’লেন অপবাদগ্রস্ত, নির্যাতিত ও বিতাড়িত। নানার বাড়ী মদীনার আনছাররা তাঁকে বরণ করে নিলেন। তাদের সাহায্যে তিনি পরবর্তীতে মক্কার উপরে সামরিক ও রাজনৈতিক বিজয় লাভ করলেন। সফল নবী হিসাবে বিশ্বের ইতিহাসে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করলেন। যদি সেদিন তিনি মক্কায় নিজ বাপ-চাচাদের হাতে নিহত হ’তেন কিংবা পরবর্তীতে মক্কা বিজয়ে ব্যর্থ হ’তেন, তাহ’লে হয়তবা তাঁর জীবনেতিহাস অন্যভাবে লেখা হ’ত।

এক্ষণে প্রশ্ন : রাসূল (ছাঃ)-এর জীবনে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কোনটা? তাঁর জন্ম না তাঁর নবুঅত লাভ? ‘মুহাম্মাদ বিন আবদুল্লাহ’ বেশী গুরুত্বপূর্ণ না ‘মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ (ছাঃ) বেশী গুরুত্বপূর্ণ? জন্মকে গুরুত্ব দিয়ে রিসালাতকে গুরুত্ব না দিলে তাঁর চাচাদের চরিত্রের সাথে আমাদের চরিত্রের মিল হয়ে যাবে। দু’টোকেই গুরুত্ব দিয়ে স্রেফ দিবস পালন করলে দেখা যাবে রাসূল (ছাঃ) ও তাঁর ছাহাবীগণ কখনোই এসব করেননি। তাহ’লে এগুলো কার আদর্শ? ইতিহাস খুঁজলে দেখা যাবে যে, খ্রিষ্টানদের বড় দিন পালনের অনুকরণে ৬০৫ বা ৬২৫ হিজরীতে ইরাকের ‘এরবল’ প্রদেশের গবর্ণর আবু সাঈদ মুযাফফরুদ্দীন কুকুবুরী (৫৮৬-৬৩০ হিঃ) সর্বপ্রথম ‘মীলাদুন্নবী’র প্রথা চালু করেন। প্রতি বৎসর মীলাদুন্নবীর মৌসুমে প্রাসাদের নিকটে তৈরী অন্যূন ২০টি খানক্বাহে তিনি গান-বাদ্যের আসর বসাতেন (আল-বিদায়াহ ১৩/১৩৭)। কখনো মুহাররম কখনো ছফর মাস থেকে এই মৌসুম শুরু হ’ত। মীলাদুন্নবীর দু’দিন আগে থেকেই খানক্বাহের আশপাশে গরু-ছাগল যবহের ধুম পড়ে যেত। কবি, গায়ক, ওয়ায়েয সহ অসংখ্য লোক সেখানে ভিড় জমিয়ে মীলাদুন্নবী উদযাপন করত। আলেমদের উপঢৌকন ও চাপ দিয়ে মীলাদের পক্ষে জাল হাদীছ ও বানোয়াট গল্প লিখতে বাধ্য করা হ’ত। উদ্দেশ্য আর কিছুই নয়, মিথ্যা নবীপ্রেমের মহড়া দেখিয়ে জনসাধারণের মন জয় করা।

এক্ষণে রবীঊল আউয়াল মাস এলে আমাদের দেশে যেভাবে দিবস পালন, মিছিল-মিটিং, জশনে জুলূস, মীলাদুন্নবী, সীরাতুন্নবী, ইয়াওমুন্নবী, দাওয়াতুন্নবী ও আশেকে রাসূল (ছাঃ) মহাসম্মেলন ইত্যাদি শুরু হয়ে যায়, তাতো কেবল সেই কুকুবুরীর কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। অথচ রাসূল (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরামের যামানায় এ সবের কোন খবর ছিল না। যদি এটা ধর্মীয় প্রথা হয়, তাহ’লে অবশ্যই রাসূল (ছাঃ)-এর বাণী, কর্ম বা সম্মতি দ্বারা এর সমর্থন থাকতে হবে। কিন্তু সে সবের তো কোন অস্তিত্ব নেই। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘তোমরা আমাকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করো না, যেভাবে নাছারাগণ ঈসা (আঃ) সম্পর্কে বাড়াবাড়ি করেছে... বরং তোমরা বল যে, আমি আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল’।[1] হাদীছে রিয়া ও শ্রুতিকে ‘শিরকে আছগার’ বা ছোট শিরক বলা হয়েছে।[2] যা সকল পাপের বড় পাপ। মিছিল, জশনে জুলূস ইত্যাদি তো ‘রিয়া’ বা প্রদর্শনীর মধ্যেই পড়ে যায়।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর প্রতি ভালবাসার প্রকৃত প্রমাণ হ’ল তাঁর ‘ইত্তেবা’ বা অনুসরণ করা। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক তথা সার্বিক জীবনে তাঁর আদর্শ যথাযথভাবে অনুসরণ করার মধ্যেই তাঁর প্রকৃত প্রেম নিহিত রয়েছে। দেশের সরকারী ও বিরোধী দলীয় রাজনৈতিক দল সমূহের প্রায় সবাই মুসলমান। আমরা যদি আমাদের এই প্রিয় জন্মভূমিতে রাসূল (ছাঃ)-এর রেখে যাওয়া পবিত্র আদর্শের বাস্তবায়নে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হ’তে পারতাম এবং যাবতীয় শিরক ও বিদ‘আত থেকে দূরে থাকতে পারতাম ও ছহীহ সুন্নাহর অনুসারী হ’তে পারতাম, তাহলেই তাঁর প্রতি যথার্থ সম্মান প্রদর্শন সম্ভব হ’ত বলে আমরা মনে করি। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন- আমীন!

(এ বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্য মাননীয় লেখকের ‘মীলাদ প্রসঙ্গ’ বইটি পড়ুন)


[1]. বুখারী হা/৩৪৪৫; মিশকাত হা/৪৮৯৭।

[2]. আহমাদ হা/২৩৬৮০, সনদ হাসান; মিশকাত হা/৫৩৩৪।