স্বাধীনতার মাসে অধীনতার কসরৎ

২৬শে মার্চ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস। এ মাসেরই ২৫শে মার্চ দিবাগত রাতে রাজধানী ঢাকার ঘুমন্ত মানুষের উপর হিংস্র আক্রোশে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল নীতিহীন পাকিস্তানী সেনাবাহিনী। ফলে পরদিন ২৬শে মার্চকেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস হিসাবে ঘোষণা করেন দেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। সাধারণ মানুষ সর্বদা স্বাধীনতা প্রিয় এবং এই কষ্টার্জিত স্বাধীনতাকে অক্ষুণ্ণ রাখতে দেশের প্রতিটি নাগরিক সর্বদা আপোষহীন প্রতিজ্ঞায় অটল। কিন্তু সাধারণ জনগণের সরল প্রতিজ্ঞা ও দেশের নেতৃবৃন্দের ইচ্ছা ও চেতনা কি একই মানদন্ডে পরিমাপ করা যাবে? পাকিস্তানী শাসকদের অদূরদর্শিতার কারণে যেমন তখনকার স্বাধীনতা টেকেনি, তেমনি বাংলাদেশী নেতৃবৃন্দের অদূরদর্শিতার কারণে এ দেশের স্বাধীনতা যেকোন সময় উবে যেতে পারে, সেকথা সর্বদা সকলের মনে রাখা কর্তব্য। হাঙ্গরের প্রসারিত মুখ গহবরে সূঁচালো দন্তসারির মধ্যে একটা তরতাযা প্রাণ যেমন বেশীক্ষণ লাফ-ঝাঁপ করতে পারে না, বঙ্গীয় ব-দ্বীপ এই বাংলাদেশের স্বাধীনতাও অনুরূপ অনিশ্চয়তার চোরাবালিতে যেকোন সময় হারিয়ে যাওয়া মোটেই অবাস্তব বিষয় নয়।

দেশটির ভূ-প্রকৃতি ও শস্য-শ্যামল ভূ-অর্থনৈতিক অবস্থান চিরকাল বিদেশীদের আকৃষ্ট করেছে। ফলে দেশটি অধিকাংশ সময় পরদেশী দ্বারা শাসিত ও শোষিত হয়েছে। বিশেষ করে দেশের দক্ষিণ-পূর্ব অংশে অবস্থিত দেশের এক দশমাংশ এলাকা নিয়ে গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক, ভূ-অর্থনৈতিক এবং কৌশলগত অঞ্চল হিসাবে পরিগণিত। অঞ্চলটি বিশ্বের তিনটি খুবই গুরুত্ববহ ভূ-রাজনৈতিক অঞ্চলের সংযোগস্থলে অবস্থিত। এক. দক্ষিণ এশিয়া বা সার্ক অঞ্চল। দুই. দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বা আসিয়ান অঞ্চল। তিন. উত্তর-পূর্বের বিশাল চীন অঞ্চল। চীন ইতিমধ্যে পরাশক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে এবং ভারত নিকট ভবিষ্যতে পরাশক্তি হ’তে যাচ্ছে। সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতার ঊর্ধ্বে এরা কেউ নয়। বিশেষ করে ভারতের কোন প্রতিবেশী তার সম্পর্কে নিশ্চিন্ত নয়। ফলে তাদের কারু সাথে তার সদ্ভাব নেই। চীন ও ভারতের মধ্যকার বৈরিতা সুস্পষ্ট। অথচ উভয়েই চায় ভারত মহাসাগরে তাদের প্রভাব বলয় বৃদ্ধি করতে। ভারত তো নেহরুর ‘ইন্ডিয়া ডকট্রিন’ অনুযায়ী মধ্যপ্রাচ্যের বিস্তীর্ণ তৈলক্ষেত্রসহ সুদূর মক্কা-মদীনা পর্যন্ত তার সাম্রাজ্যসীমা বিস্তৃত করার স্বপ্ন দেখে। হাতে শক্তি পেলে সে যে তার স্বপ্ন বাস্তবায়নের চেষ্টা করবে না, একথা হলফ করে বলার উপায় নেই।

ভারত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্র চট্টগ্রামকে এতদঞ্চলে অতীব প্রয়োজনীয় ভূ-কৌশলগত এলাকা হিসাবে বিবেচনা করে। কারণ ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলের ‘সাতবোন রাজ্যমালা’ (Seven Sisters States) তথা মণিপুর, আসাম, মেঘালয়, নাগাল্যান্ড, মিজোরাম, ত্রিপুরা, অরুণাচল সহ সাতটি রাজ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী উলফা, বোড়ো, মিজো, নাগা, গুর্খা, কুকি প্রভৃতি মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপগুলি তাদের সশস্ত্র তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। তাদের ওপারেই রয়েছে বিশাল চীনের সশস্ত্র অবস্থান। ১৯৬২ সালের যুদ্ধে তারা ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রায় অর্ধাংশ দখল করে নেয় এবং তারা আজও বৃটিশদের দ্বারা চিহ্নিত ম্যাকমোহন লাইন (Mc Mohon Line)-কে স্বীকৃতি দেয়নি। তাই চীনকে ভারত সব সময় সন্দেহের নযরে দেখে। এই রাজ্যগুলির স্বাধীনতা আন্দোলন দমন করার জন্য বাংলাদেশের বুক চিরে দ্রুত ও সরাসরি সমর সম্ভার প্রেরণের স্বার্থে ভারতের জন্য চট্টগ্রাম বন্দর ও পার্বত্য চট্টগ্রামের সড়ক পথ খুবই যরূরী। অপরদিকে চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের এই ৫০/৬০ মাইল চওড়া এক ফালি ভূমি পেরুতে পারলেই চীন সরাসরি পৌঁছতে পারে চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরে, যা তাকে নিয়ে যাবে বঙ্গোপসাগর দিয়ে ভারত মহাসাগরের নীল দরিয়ায়। যার মাধ্যমে সে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে ভারত মহাসাগরীয় বিশাল পানি সীমাকে। যেভাবে ভূমধ্যসাগরে নৌবহর পাঠিয়ে আমেরিকা সমস্ত মধ্যপ্রাচ্যের উপরে ছড়ি ঘুরাচ্ছে। একইভাবে তখন ভারত মহাসাগরে সামরিক নৌবহর পাঠিয়ে চীন সমগ্র দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একক পরাশক্তি হিসাবে ছড়ি ঘুরাতে সক্ষম হবে।

অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার পর একক বিশ্বশক্তি হিসাবে আমেরিকা এখন একবিংশ শতাব্দীতে চীনকেই তার সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে মনে করছে। আর সেকারণেই সে চীনের বৈরীশক্তি হিসাবে ভারতকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে চীনকে ভারত মহাসাগরের প্রবেশদ্বার চট্টগ্রাম থেকে দূরে রাখার জন্য বাংলাদেশের উপরে চাপ সৃষ্টি করে ভারতের সাথে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষর করিয়ে নিয়েছে। তাছাড়া ইতিমধ্যেই সেখানে এনজিও তৎপরতার মাধ্যমে টাকা-পয়সার লোভ দেখিয়ে চাকমা ও অন্যান্য উপজাতীয়দের খ্রিষ্টান বানানোর চক্রান্তে লিপ্ত রয়েছে। যাতে অদূর ভবিষ্যতে পার্বত্য চট্টগ্রামকে সংখ্যাগরিষ্ঠ খ্রিষ্টান রাজ্য হিসাবে ঘোষণা ও স্বীকৃতি দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের বুকে ইস্রাঈলের ন্যায় এবং ইন্দোনেশিয়ার বুকে পূর্ব তিমুরের ন্যায় এখানে একটি বিষফোঁড়া রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা যায়। যার কাজ হবে আমেরিকার স্বার্থ রক্ষা করা। সাথে সাথে চীন ও তার প্রতিবেশী তথা সমগ্র এশিয়ার উপরে আমেরিকা চোখ রাঙাতে সক্ষম হয়। সাথে সাথে সক্ষম হয় এতদঞ্চলের সম্পদরাজির অবাধ লুণ্ঠনের। মার্কিন কোম্পানী ইউনিকলের সাথে সম্প্রতি গ্যাস চুক্তি স্বাক্ষর ও চট্টগ্রামে বেসরকারীভাবে আমেরিকান পোর্ট নির্মাণের চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে যার প্রক্রিয়া ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে।

অন্যদিকে ভারতের সাথে পানি চুক্তি, ট্রানজিট চুক্তি, বাস চলাচল চুক্তি, অসম বাণিজ্য এবং অঘোষিতভাবে সীমান্ত উন্মুক্ত করে দেওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশের উপরে ভারতের অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদ পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। ফলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা এখন ভারত, আমেরিকা ও চীনের ত্রিমুখী হামলার সম্মুখীন। অতএব মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তি, স্বাধীনতার অতন্দ্র প্রহরী ইত্যাকার লকব ছুঁড়ে ফেলে সত্যিকারের দেশপ্রেমিক শক্তিকে ঝুঁকি নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।

ইতিমধ্যে নতুন এক খবর আমাদেরকে ভাবিয়ে তুলেছে। গত ৮ই মার্চ সোমবার তথাকথিত বিশ্ব নারী দিবসে দিনাজপুরের হিলি চেকপোস্টের নিকটে হাকিমপুর কলেজ ময়দানে বাংলাদেশের ২৫টি এনজিও এবং পশ্চিমবঙ্গের ২টি এনজিও নারী সংগঠনের ব্যানারে উভয় দেশের প্রায় দু’হাযার মহিলা মিছিল করে হিলি চেকপোস্টে সমবেত হয় এবং এ সময় তারা নারী মুক্তির শ্লোগানের বদলে ‘দু’ বাংলা এক হও’ শ্লোগান দেয়। বাংলাদেশের ‘প্রশিকা’ এনজিও-র কেন্দ্রীয় নারী-পুরুষ সমন্বয় কোষ-এর প্রধান ফৌযিয়া খন্দকার ইভার সভানেত্রীত্বে অনুষ্ঠিত উক্ত নারী সম্মেলনে উভয় বাংলাকে এক করার দাবীতে বক্তৃতা করেন, পল্লীশ্রী-র শামীম আরা বেগম, মহিলা পরিষদের মুনীরা খান, এডাব-এর কেন্দ্রীয় সদস্য শাহ-ই মুবীন জিন্নাহ, তৃণমূল নেত্রী মাকছূদা বেগম ও দিনাজপুর যেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা গুলনাহার মোহসিন। উক্ত সম্মেলনের পূর্বে কলিকাতা কেন্দ্রিক নারী মুক্তি সংগঠন ‘স্বয়াস’ ও ‘মৈত্রী’র সভানেত্রী যথাক্রমে অনুরাধা কঙ্কর ও অচিন্তা পাঠকের নেতৃত্বে সকালে ভারত সীমান্তের মধ্যে নারী সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। অতঃপর উভয় দেশের দু’হাযারের অধিক নারী উভয় দিক থেকে এসে চেকপোস্টে সমবেত হয়ে ফুলের তোড়া বিনিময় করে। ... এ সময় হিলি চেকপোস্ট উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় এবং সকলে এসে হাকিমপুর কলেজ মাঠে সমাবেশে যোগদান করে। উক্ত নারী সম্মেলনকে সফল করার জন্য প্রশিকা, তৃণমূল ও এডাব ছাড়াও দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, গাইবান্ধা ও জয়পুরহাট যেলার পঁচিশটির মত এনজিও থেকে পাঁচ হাযারেরও অধিক নারীর সমাবেশ ঘটে।

প্রশ্ন হ’ল : প্রকাশ্যভাবে সারাদিন স্বচ্ছন্দে বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থল বন্দরে এতবড় একটা রাষ্ট্রঘাতী সম্মেলন হ’ল, তুখোড় বক্তৃতা হ’ল, ‘দিলে দিলে দিল লাগি’ হ’ল, তার কোন খবরই কি সরকার রাখেন না? স্বাধীনতার অতন্দ্র প্রহরী, মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তি, সরকারী গোয়েন্দা বাহিনী, নিদেনপক্ষে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সদস্যদের কারও নযরে পড়ল না? কি সরকারী দল কি বিরোধী দল এযাবত এর বিরুদ্ধে কোন বিবৃতি কিংবা তারা কোনরূপ ব্যবস্থা নিয়েছে বলে জানা যায়নি। সমাজকল্যাণের নামে এইসব এনজিওগুলো বছরের পর বছর ধরে এদেশে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানীর ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে, সরকার কি তা মোটেই বুঝতে পারেন না? গত ২০শে মার্চ থেকে সপ্তাহব্যাপী আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের সফর উপমহাদেশে একটি অনাসৃষ্টি কান্ড ঘটিয়ে গেল। তিনি পরিষ্কার জানিয়ে গেলেন যে, আমেরিকা এখন ভারতের সাথে। অতএব উপমহাদেশের যেসব দেশ ভারতের সাথে থাকবে, আমরা তাদের সাথে আছি। বাংলাদেশে তিনি এলেন মাত্র ১০ ঘণ্টার জন্য স্রেফ সৌজন্য সফরে। আর পাকিস্তানে গেলেন ৫ ঘণ্টার জন্য কেবল তাদেরকে শাঁসিয়ে দিতে যে, সাবধান! কাশ্মীর নিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে বাড়াবাড়ি করো না। মানবাধিকারের স্বঘোষিত এই সোল এজেন্ট কাশ্মীরে মানবাধিকার লংঘনকারী রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটি করেননি। গণতন্ত্রের অতন্দ্র প্রহরী নামাংকিত আমেরিকার উদ্যোগেই ১৯৪৮-৪৯ সালে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে কাশ্মীরে গণভোট অনুষ্ঠানের প্রস্তাব গৃহীত হয়। অথচ আজ সেই আমেরিকার প্রেসিডেন্ট সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ হিসাবে খ্যাত ভারতের জন্ম থেকে বিতর্কিত কাশ্মীর রাজ্যে গণভোট অনুষ্ঠানের কথা বলতে সাহস পেলেন না। অথচ পাকিস্তানী সামরিক নেতাকে সেদেশে তাড়াতাড়ি নির্বাচন দেওয়ার অঙ্গীকার আদায় করে ছাড়লেন। কাশ্মীরী মুক্তিযুদ্ধকে তিনি বলে গেলেন ‘সন্ত্রাস’। আফগান জনগণ দীর্ঘ ১০ বছর যাবত হানাদার রুশদের বিরুদ্ধে আমেরিকার সহায়তায় যখন যুদ্ধ চালিয়েছিল, তখন তারা ছিল আমেরিকার ভাষায় ‘ফ্রীডম ফাইটার’ বা ‘মুক্তিযোদ্ধা’। কিন্তু সোভিয়েতের পতনের পর ঐ মুক্তিযোদ্ধারাই এখন আমেরিকার চোখে হয়ে গেছে মৌলবাদী সন্ত্রাসী। আমেরিকার এই দ্বৈত নীতি সম্পর্কে হুঁশিয়ার থেকেই দেশের নেতৃবৃন্দকে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের গ্যারান্টি বহাল রাখার চেষ্টা করতে হবে। আল্লাহ আমাদেরকে যোগ্য নেতৃবৃন্দ দান করুন- যারা দেশের স্বাধীনতাকে অক্ষুণ্ণ রাখতে সক্ষম হবেন। আমীন![1]