মুছল্লী না সন্ত্রাসী?

গত ৪ঠা ফেব্রুয়ারী শুক্রবার বাদ জুম‘আ খুলনা খালিশপুরে ইমাম পরিষদের ব্যানারে একদল লোক খালিশপুর ১২ নং সড়কের আহলেহাদীছ জামে মসজিদে হামলা করে মসজিদ ও ওযূখানা ভাংচুর করে এবং পার্শ্ববর্তী মাওলানা আব্দুর রঊফ ছাহেবের বাড়ী ও লাইব্রেরীতে হামলা চালিয়ে ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে। পবিত্র কুরআনের তাফসীর ও হাদীছ সহ বহু ধর্মীয় গ্রন্থাবলী তারা তছনছ করে। কিছু কিতাব ছিঁড়ে ফেলে। কিছু পার্শ্ববর্তী পুকুরে নিক্ষেপ করে ও কিছু তারা লুট করে নিয়ে যায় বলে জানা যায়। তার পূর্বে তারা জুম‘আর ছালাতের পর বিভিন্ন মসজিদ থেকে এসে খালিশপুরে গোলচত্বরে জমায়েত হয় ও পার্শ্ববর্তী খালিশপুর শ্রমিক ময়দানে অনুষ্ঠিতব্য স্থানীয় আহলেহাদীছদের আয়োজিত একটি ওয়ায মাহফিলের মঞ্চ ও প্যান্ডেল ভেঙ্গে দেয়। পুলিশ হামলাকারীদের ২৬ জনকে গ্রেফতার করে এবং পরের দিন তাদেরকে ছেড়ে দেয়। মসজিদের সেক্রেটারীর পক্ষ থেকে ৪০ জনের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে বলে জানা গেছে। ‘আল্লাহ কি নিরাকার ও সর্বত্র বিরাজমান’? নামক মাওলানা আব্দুর রঊফের লেখা ৩২ পৃষ্ঠার একটি পুস্তিকার বিরুদ্ধে স্থানীয় ইমাম পরিষদের ক্ষোভের প্রেক্ষিতে এই হিংসাত্মক ঘটনা ঘটে। বইটি জানুয়ারী ’৯৫-তে প্রথম ও নভেম্বর ’৯৯-তে পুনরায় প্রকাশিত হয়। পুস্তিকাটি বাযেয়াফ্ত করার জন্য পুলিশ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকটে সুফারিশ করেছে বলে খবরে প্রকাশ। পুস্তিকাটির প্রকাশককে পরের দিন পুলিশ গ্রেফতার করেছে বলে জানা গেছে। অথচ দেশে হর-হামেশা ইসলাম বিরোধী ও বিভিন্ন নোংরা বই-পত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে। সেদিকে খেয়াল নেই।

আহলেহাদীছের বিরুদ্ধে খুলনা ইমাম পরিষদের এ হিংসাত্মক আচরণ আজকের নতুন নয়। বিগত ১৯৯৪ সালের ২২শে এপ্রিল তারিখে খুলনা ইমাম পরিষদের নেতাদের প্ররোচনায় কিছু মাদরাসা ছাত্র খুলনা পৌরসভা মিলনায়তনে আয়োজিত ‘আহলেহাদীছ যুবসংঘে’র ইসলামী সম্মেলনে হামলা করে। পরে শ্রোতা ও পুলিশের পিটুনী খেয়ে থানায় গিয়ে সম্মেলনের পোস্টারে ঘোষিত উপস্থিত-অনুপস্থিত বক্তা ও নেতৃবৃন্দের নামে ঢালাওভাবে বিভিন্ন ধারায় মিথ্যা মামলা দায়ের করে। বিচারে বাদীপক্ষের সকল অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হয় এবং ২৪.১১.৯৪ইং তারিখে মামলা খারিজ হয়ে যায়। সেদিনও জালসার শুরুতে তারা হামলা করেছিল। এবারও জালসা শুরুর আগেই ফাঁকা প্যান্ডেলে ও ফাঁকা মসজিদে তারা হামলা করেছে। একই ইমাম পরিষদ বর্তমান ঘটনার নায়ক। মাওলানা আব্দুর রঊফ ফরিদপুরের গওহরডাঙ্গা মাদরাসার স্বনামধন্য মুহতামিম মরহূম মাওলানা আব্দুল আযীয ছাহেবের পুত্র। স্বীয় বুযর্গ পিতার জীবদ্দশায় তিনি জেনে-বুঝে আহলেহাদীছ হন এবং তাঁর প্রচারে খালিশপুর ও অন্যান্য স্থানের বহু লোক আহলেহাদীছ হয়েছেন। ‘খুলনা ইমাম পরিষদ’ নামীয় সংগঠনের আলেমরা তাঁর বিরুদ্ধে প্রথম থেকেই ক্ষুব্ধ। কারণ ধর্মীয় দলীল-প্রমাণে তারা কখনোই মাওলানা আব্দুর রঊফের মোকাবিলায় টিকতে পারেননি। ফলে স্থানীয় ভক্তদের কাছে এটা তাদের এখন ‘প্রেস্টিজ ইস্যু’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইমাম পরিষদের সম্মানিত আলেমদেরকে বাগদাদ ধ্বংসের ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। সেদিন শাফেঈদের বিরুদ্ধে হানাফীরা হালাকু খাঁকে ডেকে এনেছিল। ১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ই ফেব্রুয়ারীতে হামলার শুরু থেকে ৪০ দিন পর্যন্ত ব্যাপক হত্যাকান্ডে বাগদাদ ও তার আশপাশের শহরে আট হ’তে চল্লিশ লক্ষ মুসলমান নিহত হয়েছিল। কয়েকশত বছর ধরে সঞ্চিত জ্ঞান-বিজ্ঞানের অমূল্য ভান্ডার এক সপ্তাহের মধ্যেই তারা দজলার বুকে ডুবিয়ে বিনষ্ট করে দিয়েছিল। ফলে ইসলামের রাজনৈতিক ঐক্য চিরতরে শেষ হয়ে যায়। জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে মুসলমানদের অগ্রযাত্রা বন্ধ হয়ে যায়। আজও কি আমরা সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে চাচ্ছি?

আমরা মনে করি একটি স্বাধীন দেশে মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে। কারু যদি কারু মত পসন্দ না হয়, তাহ’লে তিনি তার পাল্টা মত প্রকাশ করবেন স্বাধীনভাবে। অথবা তার বিরুদ্ধে আপীল করার জন্য দেশের আদালতে যাবেন। সেখানে আইনের ফায়ছালা আসবে। কিন্তু সেপথে না গিয়ে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া ও অন্যের প্রতি ভয়-ভীতি প্রদর্শন করা, দৈহিকভাবে হামলা ও নির্যাতন করা, তাদের জনসভা পন্ড করা, সর্বোপরি ইবাদতের স্থান মসজিদ ভাংচুর এবং কুরআন-হাদীছ ও ধর্মীয় কিতাবপত্র তছনছ ও লুট করা নিঃসন্দেহে জঘন্যতম অপরাধ ও মৌলিক মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লংঘন। দেশের সংবিধানের রক্ষাকারী হিসাবে পুলিশ ও আদালত জননিরাপত্তার এ বিষয়গুলি নিশ্চিত করতে না পারলে এদেশ কারু জন্য নিরাপদ এমনকি বাসযোগ্য থাকবে কি-না সন্দেহ। আমরা এই সন্ত্রাসী ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি এবং দোষী ব্যক্তিদের আইনানুগ শাস্তির দাবী জানাচ্ছি। দুর্ভাগ্য, বিভিন্ন পত্রিকায় হামলাকারীদেরকে ‘মুছল্লী’ হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। জানিনা মসজিদে হামলাকারীরা কিভাবে মুছল্লী হয়। বইটি আমরা পড়েছি। বইটিতে নিঃসন্দেহে ‘হক’ প্রকাশিত হয়েছে এবং পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের সুস্পষ্ট দলীল সমূহ দিয়েই বইটি লিখিত হয়েছে। বইটিতে ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) সহ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের সম্মিলিত আক্বীদা প্রতিফলিত হয়েছে। জানিনা পুলিশ কেন বইটি বাযেয়াফ্ত করার জন্য আগবেড়ে সুফারিশ করতে গেল।

এই সুযোগে এক শ্রেণীর পত্রিকা মাঠে নেমেছে। তারা এই সন্ত্রাসী হামলাকে সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা এবং ইসলামী আন্দোলনকে ‘বিষ নিয়ে নাড়াচাড়া’ করার সঙ্গে তুলনা করে পরোক্ষভাবে ইসলামের বিরুদ্ধে একচোট নিয়েছেন। সন্ত্রাসী হামলাকারীদের ‘ধর্মপ্রাণ’ বলে সাফাই গেয়ে তারা নিজেদের মাযহাবী গোঁড়ামি ও আহলেহাদীছ বিদ্বেষকে খোলামেলা করে দিয়েছেন। মূলতঃ এরাও অসাম্প্রদায়িকতার নামে নোংরা সাম্প্রদায়িক। তারা হানাফী ও আহলেহাদীছকে এক কাতারে শামিল করেছেন। তারা জানেন না যে, আহলেহাদীছ প্রচলিত অর্থে কোন ব্যক্তি পূজারী মাযহাবের নাম নয়। এটি একটি আন্দোলন। এ আন্দোলন ধর্মের নামে বিভিন্ন মাযহাব, তরীকা ও পীর-মুরীদীর ভাগাভাগিতে যেমন বিশ্বাসী নয়, তেমনি রাজনীতির নামে জনগণকে বিভিন্ন দলে বিভক্ত করে একে অপরের বিরুদ্ধে লড়াইয়েরও ঘোর বিরোধী। ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’ মুসলিম উম্মাহকে সকল দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের ভিত্তিতে একক ও ঐক্যবদ্ধ উম্মাহ হিসাবে গড়ে তুলতে চায়। এ আন্দোলন তাই যাবতীয় গোঁড়ামি ও দলাদলির বিরুদ্ধে সর্বদা জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা করে থাকে। সাংবাদিক বন্ধুদেরকে এ আন্দোলন সম্পর্কে আরও পড়াশোনার আবেদন জানাই। মাওলানা আব্দুর রঊফের কোন কোন বক্তব্যের সাথে আমরা একমত নই। কিন্তু আমরা চাই হিংসা ও গোঁড়ামির অবসান হৌক! উদারতা ও মানবতা জয়লাভ করুক! আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন-আমীন!