ইল্ম ও আলেমের মর্যাদা

ইসলাম টিকে থাকে আলেমদের মাধ্যমে। আলেমগণ হ’লেন আল্লাহ প্রেরিত অহি-র ইলমের ধারক, বাহক ও প্রচারক। হকপন্থী আলেমদের মাধ্যমেই যুগ যুগ ধরে দ্বীন বেঁচে আছে ও আগামীতেও থাকবে। ‘আল্লাহকে সত্যিকার অর্থে ভয় করেন আলেমগণ’ (ফাত্বির ৩৫/২৮)। ‘যারা আলেম ও যারা আলেম নয়, তারা কখনোই সমান নয়’ (যুমার ৩৯/৯)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ সেই ব্যক্তি যে কুরআন শিক্ষা করে ও অন্যকে শিক্ষা দেয়’।[1] তিনি বলেন, ‘যে ব্যক্তি ইল্ম শিক্ষার জন্য রাস্তায় বের হয়, আল্লাহ তাকে জান্নাতের রাস্তাসমূহের মধ্যে একটি রাস্তা বের করে দেন। ফেরেশতারা ইল্ম অন্বেষণকারী ব্যক্তির সন্তুষ্টির জন্য তাদের পাখা সমূহ বিছিয়ে দেয়। আলেমের জন্য ক্ষমা ভিক্ষা করে আসমান ও যমীনে যা কিছু আছে সবাই, এমনকি পানির মধ্যকার মাছগুলিও। একজন ইবাদতকারীর উপরে একজন আলেমের মর্যাদা পূর্ণিমা রাতে তারকারাজির উপরে চন্দ্রের মর্যাদার ন্যায়। আলেমগণ নবীদের উত্তরাধিকারী। নবীগণ কোন দীনার ও দিরহাম রেখে যাননি। তাঁরা রেখে গেছেন (আল্লাহ প্রেরিত অহি-র) ইল্ম। যে ব্যক্তি সেই ইল্ম অর্জন করেছে, সে ব্যক্তি যথেষ্ট অর্জন করেছে’।[2] অন্যত্র তিনি বলেন, ‘আবেদের উপরে আলেমের মর্যাদা তোমাদের উপরে আমার মর্যাদার ন্যায়’। অতঃপর তিনি বলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতা মন্ডলী এবং আসমান ও যমীনবাসী এমনকি গর্তের পিপীলিকা ও পানির মধ্যকার মাছ পর্যন্ত জনগণকে সুশিক্ষা দানকারী আলেমের জন্য দো‘আ করে থাকে’।[3] তিনি বলেন, ‘যে ব্যক্তি ইল্ম শিক্ষার পথে অগ্রসর হয়, আল্লাহ তাকে জান্নাতের পথ প্রদর্শন করেন’।[4] তিনি বলেন, ‘আল্লাহ যার মঙ্গল চান, তাকে দ্বীনের বুঝ দান করেন’।[5] অন্যত্র তিনি বলেন, ‘যে ব্যক্তি মানুষকে কল্যাণের পথ দেখায়, সে ব্যক্তি কল্যাণকারী ব্যক্তির সমপরিমাণ ছওয়াব পায়’।[6] তিনি বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ বান্দাদের মধ্য হ’তে ইল্মকে ছিনিয়ে নেবেন না। বরং তিনি ইল্ম উঠিয়ে নেবেন আলেম উঠিয়ে নেবার মাধ্যমে। ফলে এমন অবস্থা হবে যে, প্রকৃত আলেম আর কেউ থাকবে না। তখন লোকেরা জাহিল নেতাদের কাছে যাবে ও তাদের কাছে বিভিন্ন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবে। তখন তারা বিনা ইল্মে ফৎওয়া দিবে। ফলে তারা নিজেরা পথভ্রষ্ট হবে ও অন্যকে পথভ্রষ্ট করবে’।[7] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘যখন মানুষ মারা যায়, তখন তার সমস্ত আমল বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তিনটি আমল ব্যতীত। ১- ছাদাক্বায়ে জারিয়াহ ২- উপকারী ইল্ম ও ৩- সুসন্তান, যে তার জন্য দো‘আ করে’।[8]তিনি আরও বলেন, মৃত্যুর পর ক্বিয়ামত পর্যন্ত বান্দার সাতটি আমল প্রবহমান থাকে। (১) দ্বীনী ইলম শিক্ষাদান (২) নদী-নালা প্রবাহিত করণ (৩) কূপ খনন (৪) খেজুর বৃক্ষ রোপণ (৫) মসজিদ নির্মাণ (৬) কুরআন বিতরণ (৭) এমন সন্তান, যে পিতার মৃত্যুর পর তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে’ (সিলসিলা ছহীহাহ হা/৫৯১৫)

আলেমদের মধ্যে স্তরভেদ রয়েছে। কেউ কুরআনের ইলমে পারদর্শী, কেউ হাদীছের ইলমে, কেউ উভয় ইলমে যোগ্য। যার মধ্যে কুরআন ও হাদীছের গভীর ইল্মের সাথে সাথে তাক্বওয়া, দূরদর্শিতা ও সূক্ষ্মদর্শিতার নে‘মত আল্লাহ পাক দান করেছেন, তিনিই সত্যিকার অর্থে ফক্বীহ, মুজতাহিদ ও মুফতী হওয়ার যোগ্যতা রাখেন। এই ধরনের হকপন্থী আলেমের সংখ্যা চিরদিনই কম। যাদেরকে খুঁজে নিয়ে তাদের অনুসরণ করা জনগণের দায়িত্ব। বিশ্বের সকল প্রান্তে এ ধরনের স্বল্পসংখ্যক ক্ষণজন্মা ওলামায়ে কেরামের মাধ্যমেই দ্বীন যিন্দা রয়েছে। তারা কখনোই দ্বীনের অসম্মানকে বরদাশত করেননি। কোন অপশক্তির রক্তচক্ষুকে ভয় করেননি। যদিও আলেম নামধারী একদল কুচক্রী সর্বদা এঁদের বিরোধিতা করেছে এবং সকল প্রকার ক্ষতি সাধনের চেষ্টা করেছে। চার ইমামের কেউই এদের হিংসা ও চক্রান্ত থেকে রেহাই পাননি। বিদ‘আতী ও দলবাজ আলেম ও রাষ্ট্রনায়কদের অত্যাচারে নির্যাতিত হয়েছেন ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (৬৬১-৭২৮ হিঃ), হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম (৬৯১-৭৫১ হিঃ) প্রমুখ হাদীছপন্থী ওলামায়ে কেরাম।

পাক-ভারত উপমহাদেশে দিল্লীর অলিউল্লাহ পরিবার ও তাদের মুকুটমণি জিহাদী সন্তান শাহ ইসমাঈল (১৭৭৯-১৮৩১ খ্রিঃ)-এর অকুতোভয় লেখনী, বাগ্মিতা ও জিহাদী তৎপরতা সারা ভারতবর্ষকে আন্দোলিত করেছিল। দখলদার ইংরেজ ও তাদের এদেশীয় দালাল হিন্দু-মুসলমান জমিদার-নবাব-নাইটরা সর্বশক্তি নিয়ে হকপন্থী আলেমদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ঘুষ, চক্রান্ত, মিথ্যা অপবাদ, বিশ্বাসঘাতকতা ইত্যাদির মাধ্যমে এইসব সরল-সিধা দ্বীনদার মুজাহিদ ওলামায়ে কেরামকে নির্যাতিত ও নিশ্চিহ্ন করা হয়েছিল। বড় বড় বিলাসী পীরের সুরম্য প্রাসাদরাজি ও সমাধিসৌধ দেখা গেলেও বালাকোটের শহীদদের কবরের চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায় না। সৈয়দ আহমদ ব্রেলভী (১৭৮৬-১৮৩১ খৃ.) ও শাহ ইসমাঈলের লাশকে টুকরা টুকরা করে কাগান নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। যাতে দুনিয়ার মানুষ তাদের কোন সন্ধান না পায়। তাদের সেদিনকার রক্ত আখরে লেখা শাহাদাতের সিঁড়ি বেয়েই আসে ছাদিকপুর পাটনার আলী ভ্রাতৃদ্বয়ের নেতৃত্বে শতবর্ষ ব্যাপী জিহাদ আন্দোলন। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে জেঁকে বসা অপশক্তি ছাড়াও ধর্মীয় ক্ষেত্রে জেঁকে বসা শিরক ও বিদ‘আতের শিখন্ডীদের বিরুদ্ধেও ছিল তাঁদের জিহাদ। ফলে একদল নামধারী আলেম ছিল তাঁদের প্রধান গৃহশত্রু। এদের ফৎওয়ার শিকারে পরিণত হয়েছিলেন সেদিন এইসব হকপন্থী ওলামায়ে দ্বীন। লা-মাযহাবী, লা-দ্বীনী ইত্যাদি নামে সেদিন এঁদেরকে সমাজে কোণঠাসা করার চেষ্টা করা হয়েছিল। যাদের অবিরত জিহাদী তৎপরতায় অতিষ্ঠ হয়ে দখলদার ইংরেজ অবশেষে ভারত ছাড়তে বাধ্য হ’ল, সেই জিহাদী আহলেহাদীছ ওলামায়ে কেরামকে এখন ইংরেজের লাইসেন্সপ্রাপ্ত ‘আহলেহাদীছ’ নামের অধিকারী দল বলে কিছু সংখ্যক দুষ্টমতি আলেম আজও কালি-কলম খরচ করে চলেছেন। ধর্মের নামে মাযহাবী দলাদলি করে মুসলিম উম্মাহকে বিশেষ করে সুন্নী মুসলমানদেরকে অসংখ্য তরীকা ও মাযহাবে বিভক্ত করে যারা ফায়েদা লুটছেন। যারা স্ব স্ব মাযহাব ও তরীকা থেকে সামান্য বিচ্যুতিকে ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যাওয়ার শামিল মনে করেন, তাদের এই সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে গিয়ে মুসলিম উম্মাহকে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ শক্তিশালী মহাজাতিতে পরিণত করার জন্য যে আন্দোলনের মাধ্যমে জনগণকে সংগঠিত করার চেষ্টা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে, সেই মহান আন্দোলনের নামই ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’। এই আন্দোলনের নেতৃস্থানীয় ওলামায়ে কেরাম চিরকাল হক-এর আওয়ায বুলন্দ করে গেছেন। আজও করে চলেছেন। ক্বিয়ামত অবধি এই দাওয়াত তারা দিয়ে যাবেন ইনশাআল্লাহ। যে সকল হকপন্থী আলেম অন্যায়ের বিরুদ্ধে এবং দ্বীনে হক-এর পক্ষে সোচ্চার হবেন, আমরা সর্বদা তাঁদের পাশে থাকব। পূর্বকালের মুসলিম রাষ্ট্রনায়কদের ন্যায় আজও যদি কেউ কোন দ্বীনদার আলেমের অমর্যাদা করেন, তাহ’লে আমরা অবশ্যই তার প্রতিবাদ করি এবং আল্লাহপাকের নিকটে এর বিরুদ্ধে ফরিয়াদ জানাই। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন- আমীন!


[1]. বুখারী হা/৫০২৭; মিশকাত হা/২১০৯।

[2]. আহমাদ হা/২১৭৬৩; তিরমিযী হা/২৬৮২; মিশকাত হা/২১২, সনদ হাসান।

[3]. তিরমিযী হা/২৬৮৫; মিশকাত হা/২১৩, সনদ হাসান। 

[4]. বায়হাক্বী, শু‘আব হা/৫৭৫১; মিশকাত হা/২৫৫, সনদ ছহীহ। 

[5]. বুখারী হা/৭১; মুসলিম হা/১০৩৭; মিশকাত হা/২০০।

[6]. মুসলিম হা/২৬৭৪; মিশকাত হা/১৫৮।

[7]. বুখারী হা/১০০; মুসলিম হা/২৬৭৩; মিশকাত হা/২০৬।

[8]. মুসলিম হা/১৬৩১; মিশকাত হা/২০৩।