ভালোবাসি

সঊদী আরবের ত্বায়েফ প্রবাসী আত-তাহরীক-এর জনৈক পাঠক আমাদের বিগত সম্পাদকীয় ‘ভালো আছি’ পড়ে প্রভাবিত হয়ে ‘ভালোবাসি’ নামে আরেকটি সম্পাদকীয় উপহার দেওয়ার দাবী জানিয়ে পত্র লিখেছেন। হজ্জ ও কুরবানী তথা বিশ্ব মুসলিম মহাসম্মেলন ও আল্লাহর জন্য জীবন উৎসর্গ করার প্রতিজ্ঞা গ্রহণের মহান ব্রত পালন শেষে আমরা কি ভালোবাসি, সেকথা আজ বন্ধু পাঠককে জানিয়ে দিতে চাই।

আমরা ভালোবাসি এমন একটি মানব সমাজ, যেখানে মানুষ আল্লাহর গোলামীতে পরস্পরে ভাই হ’য়ে বসবাস করবে। যেখানে মানবতা বিকশিত ও সমুন্নত হবে এবং পশুত্ব দমিত ও শৃংখলিত হবে। আমরা ভালোবাসি আল্লাহভীরু এমন কিছু মানুষকে, যারা অনুরূপ কিছু মানুষকে খুঁজে বের করে আল্লাহর বিধানে প্রশিক্ষিত করে গড়ে তোলে। অতঃপর অন্য মানুষকে অনুরূপভাবে গড়ে তুলতে সদা সচেষ্ট থাকে। আমরা ভালোবাসি এমন একটি জামা‘আত বা সংগঠনকে, যারা জীবনের সর্বক্ষেত্রে আল্লাহর বিধান বাস্তবায়নের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে পরস্পরে সীসাঢালা প্রাচীরের ন্যায় দৃঢ়তার সাথে কাজ করে যায়। আমরা ভালোবাসি এমন একটি সমাজকে, যেখানে মানুষ মানুষের ব্যথায় ব্যথিত হবে। অপরের মানবাধিকার রক্ষায় এগিয়ে যাবে। এমনকি যেকোন প্রাণীর অধিকার রক্ষায় দরদী মন নিয়ে সচেতন থাকবে। যেখানে দলের নামে, ধর্মের নামে, মাযহাব ও তরীকার নামে, রাজনীতির নামে, ভাষা ও আঞ্চলিকতার নামে, রক্ত ও বর্ণের কারণে মানুষে মানুষে বিভেদ ও হানাহানি থাকবে না। থাকবে না পারস্পরিক দ্বন্দ্ব, হিংসা ও বিদ্বেষ। থাকবে না ছোট-বড় ভেদাভেদ। যেখানে সাদা-কালো, ধনী-গরীব সকল মানুষের অধিকার সমান থাকবে কেবল ‘তাক্বওয়া’ ব্যতীত। যারা আল্লাহর বিরোধিতায় ত্বাগূতের সাথে কোনরূপ আপোষ করবে না।

আমরা ভালোবাসি আমাদের মাটিকে, আমাদের দেশকে, দেশের মানচিত্রকে। এই মাটিতে আল্লাহ আমাদের সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয়ই তার পিছনে আল্লাহ পাকের কোন কল্যাণ উদ্দেশ্য রয়েছে। এই মাটি ও মানুষের প্রতি তাই আমাদের রয়েছে সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব ও কর্তব্য। দেশবাসীর নৈতিক ও বৈষয়িক উন্নয়ন এবং দেশের প্রতি ইঞ্চি মাটির স্বাধীনতা রক্ষা করা আমাদের মানবিক ও নাগরিক দায়িত্ব। বঙ্গোপসাগরের কোলঘেঁষা সবুজ-শ্যামলিমায় ভরা, অফুরন্ত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি, নদীবিধৌত আজকের বাংলাদেশ পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র। তাই এদেশের বাসিন্দা হ’তে পেরে আমরা ‘ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়ের প্রতিরোধে’ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আমরা তাই ভালোবাসি সেই সামাজিক জীবনকে, যেখানে ন্যায়নীতি বিজয়ী হবে ও দুর্নীতি পরাজিত হবে। যেখানে মযলূম সাহায্যপ্রাপ্ত হবে ও যালিম ধিকৃত ও বিতাড়িত হবে। যেখানে মা-বোনেরা সম্মানিত হবেন, সুশিক্ষিতা হবেন ও মার্জিতা হবেন। যেখানে প্রতিটি মানব শিশু নির্ভয়ে নির্বিঘ্নে বর্ধিত ও সুশিক্ষা প্রাপ্ত হবে। যে শিক্ষার উদ্দেশ্য হবে আখেরাতে মুক্তির লক্ষ্যে দুনিয়ার যথাযথ ব্যবহার। যে শিক্ষা মানুষকে ধর্মীয় ও বৈষয়িক উভয় জ্ঞানে পারদর্শী করে। যে শিক্ষা মানুষকে তার সৃষ্টিকর্তার প্রতি আনুগত্যশীল করে তোলে ও সৃষ্টির সেবায় উদ্বুদ্ধ করে। আমরা ভালোবাসি এমন এক রাষ্ট্রব্যবস্থা, যা আল্লাহর সার্বভৌমত্বের অধীনে তাঁর প্রেরিত সর্বশেষ অহি-র বিধান পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ অনুযায়ী পরিচালিত হবে। আমরা চাই আজকে সাংগঠনিকভাবে প্রতিষ্ঠিত ‘ইমারতে শারঈ’ আগামী দিনে ‘ইমারতে মুল্কী’ হিসাবে বাস্তবতা লাভ করুক! বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ একটি আদর্শ ও কল্যাণ রাষ্ট্র হিসাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াক! আল্লাহ আমাদের এই প্রার্থনা কবুল করুন-আমীন!

আমরা ভালোবাসি এমন একটি সমাজ, যেখানে অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে। যেখানে হালাল উপার্জনের সকল পথ খোলা থাকবে ও সেদিকে মানুষকে উৎসাহিত করা হবে এবং হারাম উপার্জনের সকল পথ বন্ধ থাকবে ও সেদিক থেকে মানুষকে বিরত রাখা হবে। যে সমাজে পুঁজির তারল্য থাকবে। মনিব শ্রমিককে ঠকাবে না। শ্রমিক তার কাজে ফাঁকি দিবে না। সকলের পকেটে পয়সা থাকবে, মুখে হাসি থাকবে। যে সমাজে যাকাত নেওয়ার মত লোক খুঁজে পাওয়া যাবে না। কোন ফকীর-মিসকীনের দেখা মিলবে না। গাছতলা ও পাঁচতলার বৈষম্য থাকবে না। অর্থের জন্য মানুষ মানুষকে খুন করবে না। চাঁদাবাজি করবে না, সন্ত্রাস করবে না। দেশের মায়া ছেড়ে মানুষ স্রেফ অর্থোপার্জনের জন্য বিদেশে পাড়ি জমাবে না। যেখানে থাকবে না সূদ-ঘুষ, জুয়া-লটারী ইত্যাদির মাধ্যমে পুঁজিবাদী শোষণের প্রতারণাপূর্ণ অর্থব্যবস্থা। থাকবে না পীর-মুরীদী আর কবরপূজার ব্যবসা ফেঁদে ধর্মের নামে ভক্তের পকেট ছাফ করার ধোঁকাবাজিপূর্ণ ব্যবস্থা। থাকবে না সমাজতন্ত্র ও কম্যুনিজম-এর দাবী অনুযায়ী ‘হাতের পাঁচ আঙ্গুল সমান করার’ অবাস্তব রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা। যেখানে থাকবেনা গণতন্ত্রও ধর্মনিরপেক্ষতার নামে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবন থেকে আল্লাহর আইনকে বিতাড়নের আত্মঘাতী কুফরী ব্যবস্থা।

আমরা ভালোবাসি এমন একটি রাজনৈতিক সমাজ, যেখানে প্রতিষ্ঠিত নেতৃত্বের পিছনে সমস্ত জাতি সীসাঢালা প্রাচীরের ন্যায় ঐক্যবদ্ধ থাকবে। যেখানে একদিকে থাকবে কঠোরভাবে আইনের শাসন। অন্যদিকে থাকবে ‘দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন’ নীতির যথার্থ বাস্তবায়ন। যেখানে সরকারী ও বিরোধী দলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা থাকবে না। থাকবে না দলীয়করণের উৎকট নোংরামি।

আমরা ভালোবাসি এমন একটি বিচার ব্যবস্থা, যেখানে আল্লাহর আইনের যথার্থ বাস্তবায়ন হবে। ইলাহী আইনের নিরপেক্ষ প্রয়োগে আল্লাহর বান্দারা ইহকালীন ও পরকালীন কল্যাণ লাভে ধন্য হবে। মানুষের রচিত আইনে মানুষের জেল-যুলুম ও ফাঁসি হবে না। বরং সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর আইনকেই সে মাথা পেতে গ্রহণ করবে। পরকালীন মুক্তির স্বার্থে ও জাহান্নামের কঠিন আযাব থেকে বাঁচার ঈমানী তাকীদে অপরাধী আদালতে এসে দৃঢ়ভাবে অকপটে তার অপরাধ স্বীকার করবে ও ‘আমাকে পবিত্র করুন’ বলে হাসিমুখে আল্লাহ নির্ধারিত অতিবড় কঠিন শাস্তিও মাথা পেতে নিবে মা‘এয আল-আসলামীর মত, গামেদী মহিলার মত।

সর্বোপরি আমরা ভালোবাসি শিরক ও বিদ‘আতমুক্ত এমন একটি ইসলামী সমাজ, যেখানে সর্বত্র তাওহীদে ইবাদত বিজয়ী থাকবে ও ছহীহ সুন্নাহর পাবন্দী থাকবে। যেখানে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব এবং তাঁর প্রেরিত অহি-র বিধান সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার লাভ করবে। সকল মানুষ শান্তি, নিরাপত্তা ও কল্যাণ লাভে ধন্য হবে। আমরা সেই সমাজকে মনেপ্রাণে ভালোবাসি ও সেই সমাজের প্রতিষ্ঠা কামনা করি। আল্লাহ আমাদের মনষ্কামনা পূর্ণ করুন- আমীন!