তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রসঙ্গ

দলীয় শাসনে পিষ্ট মানুষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অপেক্ষায় দিন গুণছিল। অবশেষে গত ১৫ই জুলাই’০১ বাদ মাগরিব তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা সদ্য অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি জনাব লতিফুর রহমান ও দশজন উপদেষ্টার শপথ গ্রহণের মধ্য দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাস্তবে এসেছে। ১৯৯১ ও ১৯৯৬-এর পরে এটি হ’ল তৃতীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার। প্রথম তত্ত্বাবধায়ক বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান ছিলেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট বিচারপতি শাহাবুদ্দীন আহমাদ। মানুষ হাফ ছেড়ে বেঁচেছে। অনেকে শোকরানা ছালাত আদায় করেছে। অনেকে আনন্দ মিছিল করেছে। দলীয় শাসন যে কত হিংস্র, কত নোংরা ও কত অমানবিক হ’তে পারে, গত দু’দুটি দলীয় সরকার তা বাংলাদেশের মানুষকে ভালভাবে বুঝিয়ে দিয়ে গেছে। প্রথম সরকারে কিছুটা রাখঢাক থাকলেও দ্বিতীয় সরকারে এসবের কোন বালাই ছিল না। রাষ্ট্র ও সমাজের এমন কোন গুরুত্বপূর্ণ সেক্টর ছিল না, যা দলটির হিংস্র থাবা থেকে মুক্ত থাকতে পেরেছে। ফলে প্রথম সরকারের আমলে বাংলাদেশ বিশ্বের ৪ নম্বর দুর্নীতিগ্রস্থ দেশে পরিণত হয়। অতঃপর দ্বিতীয় সরকারের আমলে ১ নম্বর দুর্নীতিগ্রস্থ দেশ হিসাবে চিহ্নিত হয়। আর সেকারণেই অত্যাচার-নির্যাতন ও সন্ত্রাসে নিষ্পিষ্ট সাধারণ মানুষ এ সরকারের পতন এবং নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আগমনের অধীর অপেক্ষায় ছিল।

এক্ষণে প্রশ্ন আসে : দলীয় সরকার ভাল, না নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার ভাল? জবাব নিশ্চয়ই এটা যে, নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকার ভাল। অথচ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ মাত্র ৯০ দিন বা তিন মাস। তারপরেই আবার যেতে হবে পুনরায় আরেকটি দলীয় সরকারের অন্ধকার গলিতে। আমরা কেন তাহ’লে ভাল থেকে মন্দের দিকে ধাবিত হ’তে যাচ্ছি? আমরা কি দেশের জ্ঞানী-গুণী-যোগ্য ও দক্ষ ব্যক্তিদের নিয়ে স্থায়ীভাবে একটি নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকার ব্যবস্থা কায়েম করতে পারি না? সুশাসন যদি উদ্দেশ্য হয়, দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন যদি নীতি হয়, সমৃদ্ধিশালী ও শান্তিময় সমাজ প্রতিষ্ঠা যদি কাম্য হয়, তাহ’লে দলীয় সরকার ব্যবস্থার ন্যায় অশিষ্ট শাসন ব্যবস্থা আমরা কোন কারণে প্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছি? অথচ আল্লাহ বলেন, ‘কোন সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ যেন তোমাদেরকে সুবিচার বর্জনে প্ররোচিত না করে। তোমরা ন্যায়বিচার কর, যা আল্লাহভীতির অধিকতর নিকটবর্তী... (মায়েদাহ ৫/৮)। এটা কে না জানে যে, দলীয় শাসন কখনোই নিরপেক্ষ প্রশাসন উপহার দিতে পারেনা, যদি না তারা আল্লাহভীরু হয়। তারা কখনো নিরপেক্ষ ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। অথচ জ্বলন্ত আগুনের দিকে উড়ন্ত পতঙ্গের ন্যায় বহুদলীয় নির্বাচন ব্যবস্থার দিকে আমরা ছুটে চলেছি। আর এটা সকলেই জানেন যে, পৃথিবীর কোন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই সামাজিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা নেই।

সরকার পদ্ধতি গণতন্ত্রায়ণের নামে সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনী গ্রহণের সময় দেশের দু’টি প্রধান রাজনৈতিক দল প্রধানমন্ত্রী কেন্দ্রিক স্বৈরাচারী সরকার ব্যবস্থাকে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার বলে অভিহিত করে। প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতাহীন একটি প্রতীকী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার বিষয়ে দু’টি দলই অভিন্ন মত পোষণ করে। যেকারণে সরকার ব্যবস্থায় কোনরূপ Check and balance-এর বিধান রাখা সম্ভব হয়নি। ফলে পরবর্তী দুই মেয়াদের দুই প্রধানমন্ত্রী ভিত্তিক দু’টি দলীয় স্বৈরাচারী শাসনে অতিষ্ঠ জনগণকে শান্ত করার জন্য উভয় দলই অন্ততঃ নির্বাচনের সময় নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান পাশে একমত হয়।

ত্রয়োদশ সংশোধনীতে বর্ণিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ক্ষমতা ও বৈশিষ্ট্য এই যে, এই সরকারে একমাত্র প্রেসিডেন্ট ব্যতীত আর কেউ নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি নন (যদিও প্রেসিডেন্ট মূলতঃ সংসদ সদস্যগণ কর্তৃক নির্বাচিত হন)। জনগণের সার্বভৌমত্বের প্রতীক হিসাবে প্রেসিডেন্টের কাছেই প্রধান উপদেষ্টাসহ সকল উপদেষ্টা দায়ী থাকেন এবং জওয়াবদিহী করতে বাধ্য থাকেন। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ও নিরংকুশ ক্ষমতা এ সময়ে মূলতঃ এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে ওঠে। সংবিধানের Sole Custodian হিসাবে প্রেসিডেন্ট হন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা বিধানের একক দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার তাই কোন ক্ষমতাহীন সরকার নয়। বরং নির্বাচিত সরকারের ন্যায় এটিও একটি যথোচিত ক্ষমতা সম্পন্ন সরকার। এই সরকারকে বরং প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতির সরকার বলা যেতে পারে।

উপরে বর্ণিত দু’টি পদ্ধতির সরকারের সাথে ইসলামী ইমারত ও শূরা পদ্ধতির সরকারের পার্থক্যসমূহ নিম্নরূপ।-

(১) জনগণের মধ্যকার সদগুণাবলী সম্পন্ন নির্বাচক মন্ডলী কর্তৃক দল ও প্রার্থীবিহীন নীতিতে দেশের ‘আমীর’ নির্বাচিত হন। তিনি আল্লাহভীরু, যোগ্য ও দক্ষ একটি ‘পরামর্শ সভা’ নিয়োগ দেন। যাকে ‘মজলিসে শূরা’ বা আধুনিক পরিভাষায় ‘পার্লামেন্ট’ বলা হয়। তাদের পরামর্শক্রমে তিনি রাষ্ট্রের সর্বস্তরে যোগ্য ও দক্ষ প্রশাসক মন্ডলী নিয়োগ করেন। আমীর সকল ক্ষেত্রে শূরার পরামর্শ নিয়ে কাজ করেন। তবে কুরআন ও সুন্নাহ বিরোধী কোন পরামর্শ মানতে তিনি বাধ্য থাকেন না। দেশে কোন সরকারী বা বিরোধী দলের অস্তিত্ব থাকে না। দুর্নীতি বা অযোগ্যতা প্রমাণিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যেকোন সময়ে মন্ত্রী, শূরা বা সংসদ সদস্য কিংবা যেকোন পর্যায়ের কর্মকর্তা বরখাস্ত হ’তে পারেন। ইসলামী ইমারত পদ্ধতিতে দেশের বিচার ব্যবস্থা সম্পূর্ণ স্বাধীন থাকে। আদালতে দোষী বা অযোগ্য সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত ‘আমীর’ আজীবন স্বপদে বহাল থাকেন।

(২) ইসলামী ইমারতে সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক হন আল্লাহ। তাই আল্লাহর আইনের অনুকূলেই দেশের সকল আইন ও সংবিধান রচিত হয়। আমীর রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ যিম্মাদার হ’লেও তাকে আল্লাহ ও জনগণের নিকটে জবাবদিহী করতে বাধ্য থাকতে হয়। সাধারণ আসামীর মত আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়। অনুরূপভাবে রাষ্ট্রের সর্বস্তরের কর্মকর্তাকে আল্লাহ ও আমীর বা তাঁর প্রতিনিধির নিকটে জবাবদিহী করতে হয়। কুরআন ও সুন্নাহর অনুকূলে প্রদত্ত আমীরের আদেশ মান্য করায় নেকী পাওয়া যায়। এই শ্রদ্ধাবোধ ও ছওয়াবের আকাঙ্ক্ষা সুষ্ঠু প্রশাসন পরিচালনায় চালিকাশক্তি হিসাবে কাজ করে। দু’চার বছর অন্তর মেয়াদভিত্তিক নেতৃত্ব নির্বাচনের ব্যবস্থা না থাকায় সমাজে গ্রুপিং ও নেতৃত্বের কোন্দল সৃষ্টির সুযোগ থাকে না। ফলে সমাজে শান্তি-শৃংখলা ও অগ্রগতি সুনিশ্চিত হয়।

পক্ষান্তরে দলীয় সরকার ব্যবস্থায় দলীয় স্বার্থ বড় হ’য়ে দেখা দেয়। জনস্বার্থ গৌণ হয়। প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতি ইসলামী ইমারত পদ্ধতির কাছাকাছি হ’লেও সেখানে সার্বভৌম ক্ষমতা থাকে প্রেসিডেন্টের হাতে। যা তাকে স্বেচ্ছাচারী করে এবং যা ইসলামী ইমারতের আদর্শ বিরোধী। বহুদলীয় গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা ইসলামী সরকার ব্যবস্থার বিপরীত একটি জগাখিচুড়ী সরকার ব্যবস্থা। বরং বলা চলে যে, এটি একটি অর্থ, অস্ত্র ও সন্ত্রাস নির্ভর দুর্নীতিগ্রস্থ সরকার ব্যবস্থা মাত্র। যার জন্য জান-মাল, সময় ও শ্রম ব্যয় করার পিছনে কোন ইসলামী তাকীদ নেই। এর বিপরীতে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অনেকাংশে একটি ভাল ব্যবস্থা। যদিও সেখানে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব নেই। নিরপেক্ষভাবে ও শক্ত হাতে প্রশাসন চালানোই এ সরকারের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব। কেননা নিরপেক্ষতা কোন পক্ষকেই সন্তুষ্ট করতে পারে না। আল্লাহ আমাদের ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে শান্তি দান করুন। আমীন![1]

বিঃদ্রঃ ‘এই সাথে পাঠ করুন মাননীয় লেখকের ‘ইসলামী খেলাফত ও নেতৃত্ব নির্বাচন’ শীর্ষক বইটি। -সম্পাদক।