আফগানিস্তানে মার্কিন হামলা

গত ১১ই সেপ্টেম্বর ২০০১ মঙ্গলবার সকাল ৯-টায় নিউইয়র্কের বিশ্ববাণিজ্য কেন্দ্র টুইন টাওয়ারে ও ওয়াশিংটনের সামরিক প্রতিরক্ষা কেন্দ্র পেন্টাগনে যুগপৎ হামলার প্রতিশোধের নামে বিনা প্রমাণে উসামা বিন লাদেনকে দায়ী করে গত ৭ই অক্টোবর রবিবার রাতের অন্ধকারে যুক্তরাষ্ট্র স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র আফগানিস্তানের উপরে বর্বরোচিত হামলা শুরু করেছে। আজও চলছে সে মর্মান্তিক অভিযান। মরছে শত শত মানুষ। ধ্বংস হচ্ছে অগণিত স্থাপনা। পাথর-বালির দেশ আফগানিস্তানে পোড়ামাটি নীতি অনুসরণ করে চলেছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ। মুখে বলছে ৫০ বছরেও যুদ্ধ শেষ হবে না। এতেই বুঝা যায়, তাদের মতলবটা কি? তাদের উদ্দেশ্য উসামা নয়, বরং উদ্দেশ্য অন্য কিছু।

বর্তমান বিশ্বের একক খ্রিষ্টান পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী তার শক্তিবলয় বিস্তার ও সুপ্রতিষ্ঠিত করতে চায়। গত শতাব্দীর আশির দশকে তারা তাদের প্রতিপক্ষ রুশদেরকে আফগানিস্তানের উপরে লেলিয়ে দেয়। অন্যদিকে স্বাধীনচেতা আফগানদেরকে অস্ত্র দিয়ে তাদের মাধ্যমে সোভিয়েত রাশিয়াকে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মিটিয়ে দেয়। ৯০-এর দশকে বর্তমান বুশ-এর পিতা সিনিয়র বুশ ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দামকে লেলিয়ে দেন কুয়েতের বিরুদ্ধে। অন্যদিকে নিজে ত্রাণকর্তা সেজে কুয়েত ও সঊদী আরবের মাটিতে সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের সুযোগ করে নেন। তারপর জাতিসংঘের মাধ্যমে অবরোধ চাপিয়ে দিয়ে গত একযুগ ধরে শক্তিশালী ইরাককে পঙ্গু করে ফেলে ও এযাবত সেখানকার প্রায় ১৫ লাখ বনু আদমকে তারা অনাহারে-অপুষ্টিতে মৃত্যুবরণে বাধ্য করেছে। বর্তমানে একমাত্র পরমাণু শক্তির অধিকারী মুসলিম দেশ পাকিস্তানকে করায়ত্ত করা ও অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের উপরে ছড়ি ঘুরানো এবং প্রতিবেশী উযবেকিস্তান, তাযিকিস্তান সহ মধ্য এশিয়ার তৈলসমৃদ্ধ গরীব দেশগুলিকে কব্জা করার উদ্দেশ্যে আফগানিস্তানকে তাদের খুবই প্রয়োজন। সে লক্ষ্য পূরণের জন্যই তারা মরিয়া হয়ে বোমা ফেলছে আফগানিস্তানে।

আমেরিকা নিজ দেশের নাগরিকদের উপরে যেমন সে সন্ত্রাস করে, পরদেশের উপরেও তেমনি। ৬০-এর দশকে নিজ দেশের কৃষ্ণাঙ্গদের মানবাধিকার দমন করার জন্য সিআইএ-এর মাধ্যমে সেদেশের মানবাধিকার নেতা মার্টিন লুথার কিং-কে তারা হত্যা করে। ৯০-এর দশকে অন্যতম কৃষ্ণাঙ্গ নেতা রুডনী কিং-এর উপরে অবর্ণনীয় পুলিশী নির্যাতনের কাহিনী সবার জানা আছে। মার্কিন শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসবাদী দল কু-ক্লাক্স-ক্ল্যান সম্পর্কে তারা সম্পূর্ণ নীরব। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মূল আদিবাসী রেড ইন্ডিয়ানরা আজ নির্যাতিত ও নিষ্পেষিত হয়ে ‘নিজ দেশে পরবাসী’ অবস্থায় ধুঁকে ধুঁকে মরছে। পরদেশে মার্কিনীদের ও তাদের দোসরদের সন্ত্রাসের নযীরের শেষ নেই। ১৯১৪ সালে ভারতের জালিওয়ানওয়ালা বাগে সমবেত জনসভায় বৃটিশ জেনারেল ডায়ার বিনা উসকানিতে মেশিনগানের গুলি চালিয়ে ১৫ হাযার মানুষকে হত্যা করে। ১৯৪৫ সালে ৬ ও ৯ আগষ্ট যুক্তরাষ্ট্র জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে আণবিক বোমা হামলা চালিয়ে মাত্র ২ মিনিটে প্রায় দেড় লক্ষ জাপানীকে হত্যা করে, যার রেশ আজও চলছে। কোরিয়াতে হাযার হাযার মানুষকে হত্যার পর ভিয়েতনামে ৩০ হাযারের ঊর্ধ্বে বনু আদমকে তারা অস্ত্রের খোরাক বানিয়েছে। তাদেরই প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় গত ৫২ বছর ধরে ইহূদী ইস্রাঈলের হাতে ফিলিস্তীনী মুসলমানদের রক্ত ঝরছে। তৎকালীন গেরিলা নেতা ও বর্তমানে ইস্রাঈলী প্রধানমন্ত্রী এরিয়েল শ্যারণ ১৯৮২ সালে লেবাননে হামলা চালিয়ে সাড়ে সতেরো হাযার উদ্বাস্ত্ত ফিলিস্তীনীকে হত্যা করেন। কেবল শাবরা-শাতিলা উদ্বাস্ত্ত শিবিরেই একদিনে হত্যা করেন তিন হাযার ফিলিস্তীনী আবাল-বৃদ্ধ-বণিতাকে। এই ব্যক্তি এখন পশ্চিমাদের কাছে Honourable man এবং ইয়াসির আরাফাত হচ্ছেন ‘সন্ত্রাসী’। ১৯৪৮ সালে পালেস্টাইনের দার ইয়াসীন গ্রামের সকল ফিলিস্তীনীকে হত্যা করে তাদের লাশগুলি রাস্তায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রেখে বুক ফুলিয়ে দম্ভ করেছিল যে মোনাহিম বেগিন, পরবর্তীতে সেই সন্ত্রাসী ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী হন এবং ভূষিত হন নোবেল শান্তি পুরস্কারে। শ্যারণ, বেগিন, শামির, মোশে দায়ান প্রমুখদের রাইফেলের গুলির বিপরীতে অসহায় কোন ফিলিস্তীনী যদি পাথর ছুঁড়ে মারে, তাহ’লে সে হয় সন্ত্রাসী ও মৌলবাদী। আজও তেমনি বিনা প্রমাণে স্রেফ সন্দেহবশে অসহায় আফগানদের উপরে টন কে টন বোমা ফেলা হচ্ছে, তবুও আমেরিকা সন্ত্রাসী নয়, সন্ত্রাসী হ’ল মুক্তিকামী তালিবান যোদ্ধারা। মুসলিম নেতারা সহ তাবৎ গণতান্ত্রিক বিশ্ব এই অন্যায় ও অমানবিক দৃশ্য চুপচাপ দেখে চলেছে। কারু মুখে কথা নেই। ধিক তোমাদের রাজনীতির, ধিক তোমাদের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বুলির।

অনুরূপভাবে গণতন্ত্রের লেবাসধারী ইঙ্গ-মার্কিন-রাশিয়া চক্রের পরোক্ষ মদদে কাশ্মীরে ভারতীয় ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসকরা সেখানকার ৯০% মুসলিম জনসাধারণের রক্ত ঝরাছে বিগত ৫২ বছর ধরে। লিবিয়া ও ইরাকের উপরে একই চক্রের ইঙ্গিতে জাতিসংঘের অবরোধ চলছে বছরের পর বছর ধরে। আর ধুঁকে ধুঁকে মরছে সেসব দেশে হাযার হাযার বনু আদম। সুদান, সোমালিয়া, বসনিয়া-হার্জেগোভিনা, কসোভো ও চেচনিয়াতেও চলেছে তাদের মাধ্যমে ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম বর্বরতা। বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী জন মেজর হুমকি দিয়ে বলেছিলেন, ইউরোপে কোন মুসলিম রাষ্ট্রের উত্থান ঘটতে দেওয়া হবে না’। তারই বাস্তবতা ঘটানো হয়েছে জাতিসংঘ সনদের দোহাই দিয়ে বসনিয়াকে খন্ড-বিখন্ড করে দেওয়ার মাধ্যমে এবং কসোভোকে ন্যাটো বাহিনীর অধীনে প্রকারান্তরে সার্বীয় দস্যুদের সাথে যুক্ত রাখার মাধ্যমে। মার্কিনীরা সেখানকার খ্রিষ্টান বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মদদ দিয়ে চলেছে। এরাই লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলীতে প্রেসিডেন্ট গাদ্দাফীকে হত্যা করার জন্য সন্ত্রাসী বিমান হামলা চালিয়ে তার ৯ বছরের বোবা মেয়েকে হত্যা করেছে। এরাই মাদক পাচারের খোঁড়া অজুহাতে পানামার জনপ্রিয় রাষ্ট্রনায়ক নারিয়েগাকে সামরিক অভিযান চালিয়ে তস্করের মত অপহরণ করে নিয়ে গেছে। এরাই বারবার কিউবার রাষ্ট্রপ্রধান ফিডেল ক্যাস্ট্রোকে হত্যার ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালিয়েছে। এরাই হাইতির সাবেক প্রেসিডেন্টকে সামরিক অভিযান চালিয়ে পদচ্যুত করেছে। এরাই ১৯৯৮ সালের ২৪শে আগস্ট উসামা বিন লাদেনকে হত্যার জন্য আফগানিস্তানে বিমান হামলা চালিয়েছে। এধরনের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের ভুরি ভুরি নযীর মার্কিনীরা সৃষ্টি করেছে।

আফগানিস্তানে আজকের Operation crusade Kabul হচ্ছে তথাকথিত গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ধ্বজাধারী ইহূদী-খ্রিষ্টান চক্রের সর্বশেষ সন্ত্রাসী সংযোজন মাত্র। বর্তমানে এই চক্রের সাথে হাত মিলিয়েছে ব্রাহ্মণ্যবাদী ভারত। তাদের উদ্দেশ্য, এই সুযোগে কাশ্মীর ও পাকিস্তানকে ঘায়েল করা। কিছু না হোক মার্কিন গোয়েন্দাদের মাধ্যমে পাকিস্তানের ২৪টি পারমাণবিক বোমা চুরি করা অথবা এর প্রযুক্তি কৌশল হস্তগত করা। ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোলাম ইসহাক খান মধ্য এশিয়ার মুসলিম প্রধান ৬টি দেশ নিয়ে একটি ‘ইসলামী ব্লক’ গঠনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তখন থেকেই আমেরিকার শ্যেনদৃষ্টিতে পড়ে পাকিস্তান। কেননা এই অঞ্চলে কোন ইসলামী শক্তির উত্থান ঘটুক, আমেরিকা বা ভারত তা কখনোই চায় না।

তাই সবশেষে বলব, আফগানিস্তানের উপরে হামলা কেবল সেখানেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, এ হামলা সকল মুসলিম বিশ্বে পরিচালিত হবে। অতএব আমাদেরকে অবশ্যই আমাদের অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে। আমরা ইহূদী-খ্রিষ্টান-ব্রাহ্মণ্যবাদী চক্রের সন্ত্রাসের সহযোগী হব, না মযলূম মানবতার সাথী হব, এ বিষয়ে আমাদের জনগণকে ও সর্বোপরি বর্তমান জোট সরকারকে স্পষ্ট সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমরা মযলূম আফগান ভাইদের জন্য আল্লাহর পক্ষ হ’তে গায়েবী মদদ প্রার্থনা করছি। আল্লাহ বিশ্বের সর্বত্র ইসলাম ও মুসলমানদেরকে ও মযলূম মানবতাকে হেফাযত করুন -আমীন!

৭ই নভেম্বর ও রামাযান : ১৯৭৫-এর ৭ই নভেম্বর ছিল দেশের মুক্তি ও স্বাধীনতার মাইলফলক। আমরা এ দিনটিকে স্বাগত জানাই। আসছে রামাযান আমাদের আধ্যাত্মিক মুক্তির প্রশিক্ষণের মাস। আমাদের দেশ চিরস্বাধীন থাক ও রামাযানের সাধনার মাধ্যমে আমাদের আত্মা পবিত্র হৌক এই কামনা করি- আমীন!