এশিয়ার দুর্গের পতন। অতঃপর..

Citadel of Asia বা ‘এশিয়ার দুর্গ’ আফগানিস্তানের পতন হয়েছে আগ্রাসী আমেরিকার হাতে। গত শতাব্দীর শেষাংশে একবার তার পতন হয়েছিল রাশিয়ার হাতে। আর বর্তমান শতাব্দীর শুরুতে পতন হ’ল আমেরিকার হাতে। দু’টি পতনেরই মূলে ছিল অর্থ ও পদলোভী দেশপ্রেমহীন আফগান নেতৃবৃন্দ। ৮০-এর দশকে রাশিয়ার পুতুল সরকার নূর মুহাম্মাদ তারাকী ও নাজীবুল্লাহদের পতনের পর আজ আবার জাতিসংঘের ছদ্মাবরণে মার্কিনীদের চাপিয়ে দেওয়া ২৯ সদস্যের অন্তর্বর্তীকালীন পুতুল সরকারের প্রধান হিসাবে পশতু নেতা আব্দুল হামীদ কারজাই দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন। ইতিমধ্যে ক্ষমতা নিয়ে তাদের মধ্যে শুরু হয়েছে তুমুল কোন্দল। তাযিক, উযবেক, শী‘আ, মাসঊদ গ্রুপ, দোস্তাম গ্রুপ, পশতু নেতা পীর সৈয়দ আহমাদ গীলানী ও অন্য এক উপদল নেতা আব্দুর রাসূল সাইয়াফের মধ্যে অন্তর্দলীয় দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করেছে।

‘তালিবান’ উৎখাতের পরে উত্তরাঞ্চলীয় জোট সেদেশে এখন আর কোন বিদেশী সৈন্য চাচ্ছে না। সম্প্রতি কান্দাহারে হামলাকারী আমেরিকান দু’টি বিমানকে লক্ষ্য করে কারা গুলী ছুঁড়ল, এখনো সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। আমেরিকা হয়ত এবার উত্তরাঞ্চলীয় জোট নেতাদের পিছনে তাদের মধ্য থেকেই একটা বি-টীম সৃষ্টি করবে এদের জব্দ করার জন্য। এটা নিশ্চিত যে, কারজাই সরকার আফগানিস্তানে স্থিতিশীলতা আনতে পারবে না। ১৯৯০ থেকে ১৯৯৫ পর্যন্ত এ জোটই ক্ষমতায় ছিল। তখন আপোষে মারামারির কারণে পুরা আফগানিস্তানের উপরে তারা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়নি। শী‘আপন্থী ‘হিযবে ওয়াহদাত’ ও আহমাদ শাহ মাসঊদ গ্রুপের পিছনে ইরান ও রাশিয়ার মদদ না থাকলে দেশের বাকী অংশটুকুর উপরে তারা অতি সহজে নিয়ন্ত্রণ লাভে সক্ষম হ’ত। যতদূর জানা যায় তালিবানরা পরাজিত হয়ে নয়, বরং ইচ্ছাকৃতভাবে কাবুল ও কয়েকটি শহর থেকে সরে না গেলে এত দ্রুত আমেরিকার বিজয় আসতো না। শীর্ষস্থানীয় একটি তালিবান সূত্রের বর্ণনা মতে তারা যুদ্ধ কৌশল হিসাবে তাদের নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গিয়েছে। ৬ মাস তারা বর্তমান জোট সরকারকে সময় দেবে। তারপর তাদের বিশৃঙ্খল অবস্থার সুযোগে পুনরায় ব্যাপক গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে কাবুল সহ সারা আফগানিস্তানে তাদের শাসন প্রতিষ্ঠা করবে।

হার-জিত যাই বলুন, আমেরিকাসহ ইসলাম বিরোধী বিশ্বচক্র তাদের পরিকল্পনা মত এগিয়ে চলেছে। সন্ত্রাস দমনের নামে আফগানিস্তানের উপরে দখল কায়েম করে তারা আণবিক বোমার অধিকারী পাকিস্তানকে তার নিকটতম বন্ধু প্রতিবেশী ইসলামী আফগানিস্তান থেকে বঞ্চিত করেছে। এখনকার আফগানিস্তান আর পাকিস্তানের সেফগার্ড বন্ধুরাষ্ট্র নয়। ফলে পাকিস্তানের চারদিক এখন শত্রু রাষ্ট্র দিয়ে ঘেরা। এরপরেই সন্ত্রাস দমনের নামে মার্কিনীরা হাত রাখবে কাশ্মীর উপত্যকায় ভারতের ঘাড়ে বন্দুক রেখে। ১৩ই ডিসেম্বর ভারতীয় পার্লামেন্টে হামলা চালিয়ে ১৩ জনকে হত্যা করে তারা তার প্রাথমিক মহড়া শুরু করেছে এবং সন্দেহভাজন উসামা বিন লাদেনের ন্যায় এখানেও যথারীতি দু’টি পাকিস্তান ভিত্তিক কাশ্মীরী মুজাহিদ গ্রুপকে সন্দেহ করা হয়েছে। এমনকি এখানেও উসামার আল-কায়েদা গোষ্ঠীর হাত থাকতে পারে বলা হচ্ছে। অতএব এবার শুরু হবে প্রতিশোধের নামে প্রথমে কাশ্মীর ও পরে পাকিস্তান ধ্বংসের পালা। এমনকি সন্ত্রাসীরা আশ্রয় নিয়েছে এই সন্দেহ করে সোমালিয়া ও সূদানের উপরে এবং ইরাকের উপরেও মার্কিন হামলা আসন্ন বলে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে তথ্য প্রকাশিত হয়েছে।

অনেকেরই ধারণা পারভেয মোশাররফ ইচ্ছাকৃতভাবে আমেরিকাকে সমর্থন দিয়েছেন। কিন্তু ব্যাপারটা কি এতই সাদামাটা? বর্তমান পাকিস্তানের দ্বিতীয় ক্ষমতাধর জেনারেলের মতে তা নয়। ১১ই সেপ্টেম্বর টুইন টাওয়ারে হামলার দু’দিন পর প্রথমে পররাষ্ট্রমন্ত্রী কলিন পাওয়েল ও তার দু’ঘণ্টা পর প্রেসিডেন্ট বুশ পাকিস্তানী প্রেসিডেন্টকে ফোন করে বলেন, আমরা আফগানিস্তানে হামলা করতে যাচ্ছি। পাকিস্তানের সাহায্য চাই। নইলে তাদের আণবিক স্থাপনা এবং কাশ্মীরের উপর ঝুঁকি আসবে’। এমন ধমক খাওয়ার পর ৩৭০০ কোটি ডলার ঋণের বোঝা বহনকারী পাকিস্তানী নেতা সঙ্গতকারণেই চুপসে যান। যদি বলি কাছাকাছি একই অবস্থা বাংলাদেশ সহ অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রগুলির, তাহ’লে এরূপ ধারণা সম্ভবতঃ মিথ্যা হবে না। কারণ সর্বত্র অর্থনৈতিক সন্ত্রাস সৃষ্টির মাধ্যমেই যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী তার সামরিক ও সাম্রাজ্যবাদী শোষণের জাল বিস্তার করে থাকে। পাকিস্তানী সমর্থন ব্যতিরেকে তালেবানরা এক ঘণ্টাও টিকে থাকতে পারবে না বলে একটা কথা চালু ছিল। যদি তাই-ই হয়, তাহ’লে পাকিস্তান, সঊদী আরব ও আরব-আমিরাত তাদের সমর্থন প্রত্যাহার ও কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার পরেও তালেবানরা কেন আত্মসমর্পণ করেনি? যদি কেউ বলেন যে, এটা তাদের ঈমানী জাযবা ও নিখাদ দেশপ্রেমের কারণেই সম্ভব হয়েছে, তাহ’লে এটাও পরিষ্কার যে, ঐ দু’টি বস্ত্ত কখনোই নিঃশেষ হবার নয়। এই আগুন আফগানিস্তানের বর্তমান দখলদার শাসনকে একদিন জ্বালিয়ে দেবে। সাথে সাথে পার্শ্ববর্তী মুসলিম দেশগুলিতেও তা জ্বলে উঠবে। দুনিয়াসর্বস্ব রাজনীতিকদের হিসাব-নিকাশ হয়তবা সেদিন সব মিথ্যা প্রতিপন্ন হবে।

New world order বা ‘নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা’ নামে বুশ-এর ঘোষিত নীতি মূলতঃ বিশ্বব্যাপী যু্ক্তরাষ্ট্রের একক কর্তৃত্ব সম্প্রসারণের অপকৌশল মাত্র। বর্তমানে আমেরিকা ও রাশিয়ার হাতে প্রায় ১২ হাযার মেগাটন পারমাণবিক বিস্ফোরণ ক্ষমতা রয়েছে। অর্থাৎ বিশ্বের প্রতিটি মানুষের জন্য মাথাপিছু বিস্ফোরক বরাদ্দ হ’ল ৩ টন টিএনটি। গত শতাব্দীতে পৃথিবীর যেখানে যত যুদ্ধ, গৃহযুদ্ধ ও সন্ত্রাস ঘটেছে, প্রায় সবগুলিতেই মার্কিন অস্ত্র, অর্থ ও কূটনীতি মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে এবং সর্বত্র তার মূল লক্ষ্য থেকেছে সম্ভাবনাময় মুসলিম শক্তি বা শক্তিবলয়কে ভিতর ও বাহির থেকে দুর্বল অথবা ধ্বংস করে দেওয়া।

তৈল অস্ত্রের উদ্গাতা বাদশাহ ফায়ছালকে তারাই হত্যা করিয়েছে। ইসলামী পারমাণবিক বোমার উদ্গাতা যুলফিকার আলী ভুট্টোকে তারাই মেরেছে। পরবর্তীতে ইসলামী আফগানিস্তানের স্বপ্নদ্রষ্টা যিয়াউল হক-কে তারাই সুকৌশলে হত্যা করেছে। সবকিছুই ‘ওপেন সিক্রেট’। আজকে আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস দমনের নামে ভুখা-নাঙ্গা নিরীহ নিরপরাধ আফগানদের উপরে যুদ্ধের হিংস্রতা চাপিয়ে দিয়েছে তারাই। ফিলিস্তীন ও কাশ্মীরেও তাদের হিংস্রতা স্পষ্ট। ফলে মুসলিম বিশ্ব এখন সন্ত্রাস থেকে মহা সন্ত্রাসের ভয়ে ভীত ও বিপন্ন। আমাদের নেতৃবৃন্দের বিলাস নিদ্রা ভঙ্গ হবে কি? আল্লাহ আমাদের রক্ষা করুন- আমীন!