ধর্মনিরপেক্ষতার ভয়াল রূপ

ভারতের গুজরাট রাজ্যের প্রধান শহর আহমদাবাদের অনতিদূরে গোদরা রেলস্টেশন ও তৎসন্নিহিত এলাকা ছাড়িয়ে অন্যূন ৩৭টি শহরে ও গ্রামে চলছে সংখ্যালঘু মুসলমানদের জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করার বহ্ন্যুৎসব। নিকটাত্মীয়ের শেষ বিদায়কালে অশ্রুসিক্ত নয়নে দরদভরা অন্তরে প্রার্থনা করার বদলে কলিজার টুকরা সন্তান যে দেশে তাদের মা-বাপের মুখে আগুন দিয়ে বিদায় করে এবং তাতেও ক্ষান্ত না হয়ে শ্মশানঘাটে নিয়ে পুড়িয়ে মা-বাপের নগ্নদৃশ্য অবলোকন করে। অতঃপর খাড়া হয়ে যাওয়া দগ্ধীভূত কংকালটিকে পুনরায় লাঠি মেরে চূর্ণ করা যাদের মানবরচিত ধর্মীয় বিধানের অন্তর্ভুক্ত। ধর্মের নামে জীবন্ত নরবলি ও সতীদাহ প্রথা যাদের মাত্র সেদিনের ঘটনা। এহেন লোকদের হাতে তরতাযা মানুষ তাও যদি সে তাদের ভাষায় যবন, ম্লেচ্ছ মুসলমান হয়, তাহ’লে তো তাকে পুড়িয়ে হত্যা করা রীতিমত উৎসবের বিষয় বৈ-কি। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, হিন্দু চরমপন্থী নেতাদের সাম্প্রদায়িক হিংসা ও দাঙ্গাবাজি রাজনীতির কারণেই ‘মুসলিম লীগ’ নেতারা বাধ্য হয়ে সেদিন ভারতবর্ষের বিভক্তিতে সম্মত হয়েছিলেন। আজও পর্যন্ত তাদের সেই মুসলিম বিদ্বেষ ষোলআনা বজায় রয়েছে। বিভক্তির পর থেকে বিগত ৫৫ বছরে একটি বিদেশী পত্রিকার হিসাব মতে ভারতে ছোট-বড় অন্যূন ১৮০০০ প্রকাশ্য দাঙ্গা সংঘটিত হয়েছে। যেখানে হিন্দুরা ঘোষণা দিয়ে মুসলমানদের খুঁজে খুঁজে হত্যা করেছে এবং যেখানে নিহত মুসলিমের সংখ্যা ৫ থেকে ৬ লক্ষের মত। অসংখ্য কবরস্থানকে বানানো হয়েছে খেলার মাঠ কিংবা গরুর বাথান। দখল করা হয়েছে অগণিত মসজিদ। এমনকি মসজিদকে ক্লাব, সিনেমা হল বা গরুর গোয়াল বানানোর ঘটনাও ঘটেছে প্রচুর।

কিন্তু মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশে বিগত ৫৫ বছরে অনুরূপ ৫টি দাঙ্গার ঘটনা কেউ দেখাতে পারবেন কি? যেখানে মুসলিম দাঙ্গাবাজরা কেবল ধর্মের কারণে হিন্দুদের খুঁজে খুঁজে প্রকাশ্যে হত্যা করেছে? নেই, একটিও নেই। তার কারণ ‘ইসলাম’। ইসলাম তার অনুসারীদেরকে পরধর্মে সহিষ্ণু হ’তে শিখিয়েছে। মানুষকে আল্লাহর সেরা সৃষ্টি মানুষ হিসাবে ভালবাসতে শিখিয়েছে। দ্বীনের ব্যাপারে কারো উপরে যবরদস্তি না করার নির্দেশ দিয়েছে। বিশ্বধর্ম ইসলামের এই বিশ্বজয়ী আদর্শকে বিশ্বের বৈষয়িক শক্তিধর মোড়লরা সর্বদা ভয়ের চোখে দেখে। আর তাই ইসলামের অগ্রযাত্রাকে তারা যেকোন মূল্যে রুখে দিতে চায়। অজুহাত না পেলেও নিজেরা অজুহাত সৃষ্টি করে বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রে বসবাসকারী মুসলমানদের উপরে তারা চালিয়ে যাচ্ছে একের পর এক লোমহর্ষক নিধনযজ্ঞ। ইহূদী-খ্রিষ্টান ও ব্রাহ্মণ্যবাদী লবী একাট্টা হয়ে আজ নিশ্চিহ্ন করে চলেছে ফিলিস্তীন, কাশ্মীর ও আফগানিস্তানের মুসলিম পরিচিতিকে। ইরাকে বিগত সোয়া একযুগ ধরে তারা চালিয়ে যাচ্ছে নিষ্ঠুর ধ্বংসযজ্ঞ। সোমালিয়া, চেচনিয়া, ফিলিপাইনে চলছে তাদের হিংস্র আগ্রাসন। লিবিয়া ও ইরানের প্রতি রয়েছে তাদের সদা শ্যেনদৃষ্টি। সর্বাধিক মুসলিম অধ্যুষিত দেশ ইন্দোনেশিয়া থেকে পূর্ব তিমূর প্রদেশটিকে তারা ইতিমধ্যে বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছে। লৌহমানব বলে খ্যাত সুহার্তোকে হটিয়ে বহুদলীয় হৈ চৈ তন্ত্র সৃষ্টি করে সেখানে তাদের আজ্ঞাবহ দুর্বল শাসক বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। ৩৭০০ কোটি ডলার ঋণের জালে আটকিয়ে পাকিস্তানী জেনারেলকে কাবু করে প্রথমে আফগানিস্তানকে পদানত করেছে। অতঃপর পাকিস্তানের ইসলামী শক্তিগুলিকে তার হাত দিয়েই নিশ্চিহ্ন করার নীলনকশা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। বাকী রইল তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র বাংলাদেশকে পকেটস্থ করা। বর্তমানে তারই প্রক্রিয়া চলছে। যদিও এর সূচনা হয়েছে ভারত বিভক্তির পর থেকেই। কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন কিছু তাযা ইস্যু সৃষ্টি করার এবং তার চাইতে বেশী প্রয়োজন হিন্দুবাদী নেতা বাজপেয়ী ও আদভানীর ক্ষমতায় টিকে থাকার।

প্রথমোক্ত কারণে গত ১লা অক্টোবর জাতীয় নির্বাচনের পরপরই তাদের এদেশীয় এজেন্টদের মাধ্যমে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের জিগির তোলা হয় এবং সেইসব নির্যাতনের কল্পচিত্র সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য কলিকাতায় বসেই নীলনকশা আঁকা হয়। কিন্তু তাতে কোন লাভ হয়নি। গত ২২শে নভেম্বর জনৈক শীর্ষ ভারতীয় এজেন্ট ও ঘাদানিক নেতা ভিডিও-সিডি সহ ঢাকা বিমানবন্দরে হাতেনাতে ধরা পড়ায় তাদের সব জারিজুরি ফাঁস হয়ে যায়। ফলে এর মাত্র দু’মাসের মাথায় নতুন আরেকটি ইস্যু সৃষ্টির জন্য ২২শে জানুয়ারী কলিকাতার মার্কিন কনস্যুলেটে হামলা চালিয়ে দোষ চাপানো হয় বাংলাদেশের উপরে।

কিন্তু না, ষড়যন্ত্র বসে থাকবেনা। বাজপেয়ী-আদভানীকে ভারতের ক্ষমতায় টিকে থাকতেই হবে। তাই যে হিন্দুত্বকে উস্কে দিয়ে বিজেপি রাতারাতি ভারতের প্রধান রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়েছিল ও তাদের নেতা বাজপেয়ী ও আদভানী যথাক্রমে প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হ’তে পেরেছিলেন, সেই প্রেসক্রিপশনকে কাজে লাগিয়ে বিজেপি শাসিত গুজরাট প্রদেশে গত ২৭শে ফেব্রুয়ারী মুসলিম নিধনযজ্ঞ শুরু করা হ’ল। তার আগে তারা কেন্দ্রীয় কোয়ালিশন সরকারের অন্যতম শরীক দল ‘বিশ্ব হিন্দু পরিষদ’ ও তার সহগামী শিবসেনা, বজরং প্রভৃতি জঙ্গী দলের মাধ্যমে ও বিশেষ করে কর সেবকদের মাধ্যমে ১৯৯২ সালের ৬ই ডিসেম্বর বিজেপি নেতাদের ইন্ধনে ধ্বংসপ্রাপ্ত ঐতিহাসিক বাবরী মসজিদের স্থলে রামমন্দির নির্মাণের জন্য ১৫ই মার্চ ২০০২ শুক্রবার তারিখ ঘোষণা করে। যদিও এবিষয়ে সেদেশের সুপ্রিম কোর্টের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। উদ্দেশ্য ছিল, এর মাধ্যমে মুসলমানদের ক্ষুব্ধ করা এবং তাদেরকে নিধন করার জন্য ইস্যু তৈরীর সাথে সাথে নিজেদেরকে হিন্দুত্বের সোল এজেন্ট হিসাবে যাহির করা। যাতে সর্বত্র হিন্দুত্বের উন্মাদনা সৃষ্টি হয় ও এর মাধ্যমে আগামী জাতীয় নির্বাচনে পুনরায় ক্ষমতায় আসা যায়। অতএব কাজটি হঠাৎ করে ঘটেনি; বরং পূর্ব পরিকল্পিতভাবে অত্যন্ত সুনিপুণভাবে করা হয় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকায় গিয়েই।

‘কর সেবক’ নামীয় এইসব ধর্মান্ধরা গোদরা স্টেশনে নেমে একজন বৃদ্ধ মুসলিম দোকানদারের দাড়ি ধরে টানাটানি করে ও তাকে মারধর করে। এমতাবস্থায় তার ষোড়শী কন্যা বাপকে বাঁচাতে আসলে তারা বৃদ্ধকে রেখে তার মেয়েটিকে ট্রেনে উঠিয়ে নেয়। সন্তানকে উদ্ধারের জন্য বৃদ্ধের আর্ত চিৎকারে দু’জন হকার লাফিয়ে চলমান ট্রেনে উঠে চেইন টেনে ট্রেনটিকে স্টেশনের অদূরে থামিয়ে দেয়। তখন ট্রেনে অবস্থানরত কর সেবকরা লাঠিসোটা নিয়ে জনতার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এভাবেই শুরু হয় মারামারি। এক্ষণে ঐ উন্মত্ত জনতার মাঝে উগ্রবাদী শিবসেনা, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও বজরং প্রভৃতি দলের ক্যাডাররা যে লুকিয়ে ট্রেনে আগুন ধরিয়ে দেয়নি- একথা কে হলফ করে বলবে? অথচ মুসলমানদের নামে এই অগ্নিকান্ডের গুজব দ্রুত ছড়িয়ে দেওয়া হয় সর্বত্র। অতঃপর শুরু হয় ব্যাপক মুসলিম নিধনযজ্ঞ। যে গুজরাটের মাটি মুসলমানদের রক্তে বারবার রঞ্জিত হয়েছে এবং যা মুসলমানদের বধ্যভূমি বলে পরিচিত, সেখানকার ভীত-কম্পিত মুসলমানেরা কোন সাহসে হিন্দুবাদী বিজেপির শাসনকালে হিন্দুদেরকে পুড়িয়ে মারার সাহস করবে? তাই আসল বিষয়টি বুঝতে কারু কষ্ট হওয়ার কথা নয়।

অতএব, হে ভারতীয় নেতৃবৃন্দ! ধর্মনিরপেক্ষতার নামাবলী ছেড়ে প্রকৃত ধার্মিক হৌন! দেশে ধর্মীয় শিক্ষা ও পরিবেশ বজায় রাখুন। ধর্মান্ধ নয়, প্রকৃত ধার্মিক নাগরিক সৃষ্টি করুন। কেননা ধার্মিক ব্যক্তিগণ কখনোই ধর্মের কারণে সহিংসতা করেন না। কারু জান-মাল-ইযযতের উপরে হামলা করেন না। বাংলাদেশী ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরাও সাবধান হৌন। আল্লাহ আমাদের সবাইকে দ্বীনদার ও ন্যায়নিষ্ঠ মানুষ হওয়ার তাওফীক দিন। আমীন![1]


[1]. ৫ম বর্ষ, ৬ষ্ঠ সংখ্যা, মার্চ ২০০২।