বর্তমান সময়ে ’৫২-এর চেতনা, ’৭১-এর চেতনা, জুলাই ’২৪-এর চেতনা ইত্যাদির ভিড়ে বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম প্রায় ভুলতেই বসেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূল চেতনা কী ছিল। আমাদেরকে সর্বদা মনে রাখতে হবে যে, ১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশ বিভক্ত হয়েছিল দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে (TWO NATION'S THEORY)। এই তত্ত্ব মোতাবেক ইসলাম-ই ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূল চেতনা। পরবর্তীকালে সেই চেতনায় দুর্বলতা সৃষ্টি হওয়ায় অখন্ড পাকিস্তান ভেঙে দু’ভাগ হয়ে যায় এবং স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। স্বাধীনতার এই মূল চেতনাই হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাংলাদেশকে পৃথক করেছে। যদি এই চেতনা ভঙ্গুর হয়ে যায়, তাহ’লে বাংলাদেশের স্বতন্ত্র অস্তিত্বের নৈতিক ভিত্তি হারিয়ে যাবে। প্রতিবেশী ভারতের আধিপত্যবাদের পোড়ামাটি নীতি প্রতি পদে পদে আমাদেরকে শংকিত করে। ২০১৫ সালের ৩১শে আগস্ট বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ছিটমহল বিনিময় চুক্তি বাস্তবায়িত হয়। এতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকা ভারতের ১১১টি ছিটমহল (১৭,১৬০ একর) এবং ভারতের অভ্যন্তরে থাকা বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল (৭,১১০ একর) বিনিময় হয়। তবে সীমান্ত এলাকার লোকজনের অভিযোগ, ভারত ঐ বিনিময়ে জমির দিক থেকে লাভবান না হওয়ায়, পরবর্তীতে বিভিন্ন অমীমাংসিত জমি দখল করে নেয়। যেলা প্রশাসন ও স্থানীয় সূত্রের তথ্যমতে, তেঁতুলিয়া উপযেলার বাংলাবান্ধা ইউনিয়ন, পঞ্চগড় সদর উপযেলার হাড়িভাষা ইউনিয়ন ও বোদা উপযেলার বড়শী ইউনিয়নে বড় অংশের জমি সহ ৬-৭শ’ একর জমি ভারতের দখলে রয়েছে। সীমান্তবাসীর অভিযোগ, বিগত প্রায় দেড় যুগ ধরে সরকার ভারতের অনুকূলে নীরব ভূমিকা পালন করেছে। জমি হারালেও কার্যকর কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এভাবে বিগত ৫৩ বছর যাবৎ ভারতীয় চেতনার কাছে বাংলাদেশী চেতনা মার খাচ্ছে। স্বাধীন ও সাহসী নেতৃত্ব না থাকায় বাংলাদেশ তার প্রাপ্য হক থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। শংকাগ্রস্ত হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার চেতনাকে মযবূতভাবে ধারণ করতে চাইলে আমাদেরকে কয়েকটি বিষয়ে নযর দিতে হবে। যেমন- (১) দেশের স্বাধীনতাকে অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য শুধু দেশপ্রেমিক নেতৃত্ব নয়, প্রয়োজন দক্ষ ও দূরদর্শী নেতৃত্ব। অন্যথায় নেতৃত্বের দুর্বলতা ও চেতনাহীনতা অনেক সময় জাতীয় দুর্যোগ ডেকে আনে। যেমন নবাব আলীবর্দী খাঁ তাঁর আপন ভগ্নিপতি মীরজাফরকে প্রধান সেনাপতি করেছিলেন এবং ভেবেছিলেন, তিনি তরুণ নবাব সিরাজুদ্দৌলার মুরববী হবেন ও তাকে সার্বিক সুরক্ষা দিবেন। যেভাবে জাহাঙ্গীরের প্রধান সেনাপতি বৈরম খাঁ তরুণ সম্রাট আকবরকে সুরক্ষা দিয়েছিলেন। কিন্তু হয়েছিল তার বিপরীত। একইভাবে প্রশাসনের প্রধান ৭টি পদের ৬টি পদেই তিনি হিন্দুদের বসিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, এর ফলে তারা কৃতজ্ঞ থাকবে। কিন্তু হয়েছিল তার বিপরীত। মূল পদগুলি নিজেদের হাতে না রেখে তথাকথিত উদারতা দেখিয়ে সিরাজুদ্দৌলা আদর্শ ও চেতনাগতভাবে ভুল করেছিলেন। এক্ষেত্রে তিনি আল্লাহর নির্দেশ উপেক্ষা করেছিলেন। কেননা আল্লাহ বলেছেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমাদের পূর্বে যারা কিতাব প্রাপ্ত হয়েছে, তাদের মধ্য থেকে যারা তোমাদের দ্বীনকে খেল-তামাশার বস্ত্ত মনে করে, তাদের ও কাফেরদের বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর যদি তোমরা ঈমানদার হয়ে থাক’ (মায়েদাহ ৫/৫৭)। যার ফল ভোগ করেছেন সিরাজুদ্দৌলা এবং সাথে সাথে বাংলার মানুষ। অতএব সর্বদা বিচক্ষণ ও দূরদর্শী হ’তে হবে এবং কোন অবস্থাতেই আত্মবিস্মৃত হওয়া যাবে না।
(২) ইসলামের মূলনীতির উপর সর্বদা দৃঢ় থাকতে হবে এবং অমুসলিম নেতাদের প্রতারণার ফাঁদে পা দেওয়া যাবে না।
(৩) ব্যক্তিস্বার্থ রাজনীতিকে প্রভাবিত করে। অতএব মাল ও মর্যাদালোভী ব্যক্তিদের থেকে সাবধান থাকতে হবে। পলাশীর প্রান্তরে রবার্ট ক্লাইভের ৩৫০০ সৈন্যের কাছে নবাব সিরাজুদ্দৌলার ৫০,০০০ সৈন্যকে পরাজয় বরণ করতে হয়েছিল। যার মূল কারণ ছিল অনৈক্য এবং ক্ষমতালোভী স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর ষড়যন্ত্র। সেকারণ পলাশীর সবচেয়ে বড় শিক্ষা এই যে, ধর্মীয় ও জাতীয় স্বার্থে যেকোন মূল্যে সর্বদা সকলকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।
সিরাজুদ্দৌলার বাংলাদেশ ও আজকের বাংলাদেশ এর মধ্যে মাটির পার্থক্য নেই। পার্থক্য রয়েছে নেতৃত্বের। সেদিন সিরাজুদ্দৌলার মধ্যে যে স্বাধীন দেশাত্মবোধ ও ধর্মীয় চেতনা ছিল, বর্তমানে বাংলাদেশী নেতাদের মধ্যে সেই চেতনা অক্ষুণ্ণ থাকতে হবে। ঘাপটি মেরে থাকা মীরজাফর, জগৎশেঠ ও উমিচাঁদরা যেন স্বাধীন ও সাহসী নেতৃত্বকে পেছন থেকে টান দিয়ে থামিয়ে না দেয়।
৭১-এর স্বাধীনতার পর থেকে এদেশে সেক্যুলার নেতৃত্ব চলছে। ইসলামের নামে স্বাধীন হওয়া এ দেশের ইসলামী চেতনাকে বারবার পদদলিত করা হচ্ছে। অপরদিকে সেক্যুলার প্রভাবিত ইসলামী দলগুলিও দ্ব্যর্থহীনভাবে ইসলামী খেলাফত কায়েমে সচেষ্ট নয়। তারা বরং গণতন্ত্র কায়েমে গলদঘর্ম। যেখানে কুরআন ও সুন্নাহর বিধান চূড়ান্ত নয়, বরং অধিকাংশ এমপির রায়ই চূড়ান্ত। যেখানে আল্লাহ সার্বভৌম ক্ষমতার উৎস নন। বরং জনগণই সার্বভৌম ক্ষমতার উৎস। যেখানে ইসলামী দলগুলি ক্ষমতায় গেলে তাদের ইতিপূর্বেকার ঘোষিত নীতি হবে ‘দেশে যে মাযহাবের লোক সংখ্যা অধিক, সেই মাযহাব অনুযায়ী আইন হওয়াটাই স্বাভাবিক’। অথচ হওয়া উচিৎ ছিল, পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ অনুযায়ী আইন হওয়াটাই স্বাভাবিক। এভাবে অধিকাংশের রায়ের মাধ্যমে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের বিধানকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়ার নীতি কোন মতেই সমর্থন যোগ্য নয়। আমরা কখনই নীরব হবো না, নিস্তব্ধ হবো না, যতদিন না পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছকে দেশের আইন ও সংবিধান রূপে দেখতে পাব। কারণ ইসলামই এদেশের স্বাধীনতার মূল চেতনা। এই চেতনা ধ্বংস হ’লে দেশের স্বাধীনতা ধ্বংস হবে। ’৫২-এর চেতনা, ’৬৯-এর চেতনা ছিল কতগুলি ঘটনা ভিত্তিক ও সাময়িক। কিন্তু ইসলামী চেতনা স্থায়ী ও সামগ্রিক। এই চেতনাই দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ববকে অক্ষুণ্ণ রাখতে পারে। নইলে চেপে বসা ভারতীয় ও পাশ্চাত্যের গোলামীর চেতনা থেকে দেশ মুক্ত হ’তে পারবে না। ১৭৫৭ সালের ২৩শে জুন পলাশীর আম্রকাননে কেবল যুদ্ধে পরাজয় ঘটেনি, বরং চেতনার পরাজয় ঘটেছিল। আজও সেই পরাজিত চেতনা আমাদেরকে তাড়িত করে। আল্লাহ তুমি এদেশবাসীকে স্বাধীন ইসলামী চেতনায় উজ্জীবিত হওয়ার তাওফীক দান কর- আমীন! (স.স.)।