বিভিন্ন নামে ও মুখোশে শয়তান যুগে যুগে তার প্রতারণার জাল বিস্তার করেছে। কখনো শয়তান সাময়িকভাবে জয়ী হ’লেও চূড়ান্ত বিচারে সে সর্বদা পরাজিত। তার কৌশল সর্বদা দুর্বল (নিসা ৪/৭৬)। বিগত যুগের ‘আদ, ছামূদ, নমরূদ ও ফেরাউনরা যেমন ধ্বংস হয়েছে, এযুগের ফেরাউনরাও তেমনি সর্বদা মার খাচ্ছে ও খাবে। কিন্তু শয়তানের তাবেদাররা এগুলো অনুধাবন করতে চায় না। তারা সিডর-নার্গিস, ঝড়-বন্যাকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বলে এবং যালেম নেতা-নেত্রীদের চূড়ান্ত পরিণতিকে রাজনৈতিক বিপর্যয় বলে। এসবের পিছনে আল্লাহর নির্দেশ যে কার্যকরী আছে, সেকথা এরা অন্তর থেকে বিশ্বাস করে না।
সম্প্রতি ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর নেতৃবৃন্দের উপর দিয়ে যে নির্যাতনের ঝড় বয়ে গেল, তাতে নিরপরাধ নেতা-কর্মীদের সাময়িক কষ্ট হ’লেও তাদের ঈমান বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। এটাকে তারা আল্লাহর পক্ষ হ’তে তাদের ঈমানের পরীক্ষা বলে হাসিমুখে বরণ করে নিয়েছেন। এর বিনিময়ে তারা পরকালে নাজাতের আশা করেন। তারা সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর উপরে ভরসা করেছিলেন। তাই আল্লাহ তাদের হৃদয়ের কান্না শুনেছিলেন। ফলে নির্যাতনকারীদের উপরে আল্লাহর যে কঠোর শাস্তি ও মর্মান্তিক দুনিয়াবী গযব নেমে এসেছে এবং যা এখনও অব্যাহত রয়েছে, তার দৃষ্টান্ত নিকট অতীতে কোন দেশে আছে কি? বাংলাদেশে এমন কোন রাজনৈতিক শক্তি ছিল না, যারা ওদের টুটি চেপে ধরতে পারত। তাই ঈমানদার মযলূমদের পক্ষে আল্লাহ নিজ হাতেই ওদের দমন করেছেন। এরপরেও কি লোকদের চোখ খুলবে না?... বস্ত্ততঃ ঈমানদারগণকে সাহায্য করা আল্লাহর দায়িত্ব (রূম ৩০/৪৭)।
ইসলামের অনুসারীদেরকে প্রকৃত ইসলাম থেকে ফিরিয়ে নেবার জন্য শত্রুরা নিত্যনতুন মতবাদের জন্ম দেয় ও মুসলিম দেশগুলিতে তার পরীক্ষা চালায়। এজন্য তারা ব্যয় করে অঢেল অর্থ। তাদের সর্বোচ্চ থিংক ট্যাঙ্কের সাম্প্রতিক রিপোর্ট (২০০৭) অনুসারে, পাশ্চাত্যের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় পার্টনার হ’ল মুসলমানদের মধ্যকার চারটি দল : ধর্মনিরপেক্ষ (Secularists), উদারপন্থী (Liberals), মডারেট সুন্নী (Moderate traditionalists) এবং ছূফী (Sufis)। এখানে ‘মডারেট’ বলতে ঐসব সুন্নীদের বুঝানো হয়েছে, যারা সুবিধাবাদী চরিত্রের লোক। যাদের নিকট সবকিছুই হযমযোগ্য। তাদের ভাষায় They are natural allies of the west অর্থাৎ ‘তারা হ’ল পাশ্চাত্যের স্বাভাবিক মিত্র’। অপরদিকে তারা সালাফীদের ‘মৌলবাদী’ (Fundamentalists) বলেছেন এবং তাদের বিরুদ্ধে অন্য সকল দলকে সর্বপ্রকারের সাহায্য করার জন্য মার্কিন সরকারকে ও পাশ্চাত্য শক্তিবলয়কে পরামর্শ দিয়েছেন। দেড় শতাধিক পৃষ্ঠার দীর্ঘ এই রিপোর্টে সালাফীদের বিরুদ্ধে তীব্র বিষোদগার সত্ত্বেও এক স্থানে গবেষকগণ স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন যে, Over the long term, the social costs of the spread of the salafi movement to the masses would be very high. অর্থাৎ ‘দূর ভবিষ্যতে সালাফী দাওয়াত প্রসারের সামাজিক মূল্য জনগণের মাঝে অতি উচ্চে অবস্থান নিবে’। শুধু তাই নয়, রিপোর্টের শেষে পাশ্চাত্যের পোষ্য কিছু মুসলিম নামধারী লোকদের দিয়ে মুসলমানদের আহবান জানানো হয়েছে অন্ধকারের পথ ছেড়ে আলোর পথে ফিরে আসার জন্য। আর আহবানকারী হিসাবে যে ১২ জনের নাম রয়েছে, তাদের মধ্যে আছে তাসলীমা নাসরীন, সালমান রুশদী, মারিয়াম নামাযী, মেহদী মুযাফফরী, আইয়ান হিরসী আলী প্রমুখ ধিকৃত লোকগুলি।
পাশ্চাত্যের দৃষ্টিতে একমাত্র সালাফীরাই আছে অন্ধকারে। বাকী সব মুসলিম দল ফিরে গেছে তাদের দেখানো তথাকথিত আলোর পথে। আসলে কি তাই? অথচ ইসলামে মডারেট ও মৌলবাদী বলে কোন ভাগ নেই। কুরআন ও হাদীছের যথার্থ অনুসারী ব্যক্তিই হ’লেন প্রকৃত মুসলিম। আর সেকারণেই ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর নেতৃবৃন্দের উপরে নেমে এসেছে নির্যাতনের স্টীম রোলার বিদেশী শক্তিবলয়ের স্বার্থরক্ষাকারী এদেশীয় সরকারের মাধ্যমে। তাই এ মুহূর্তে নির্ভেজাল তাওহীদে বিশ্বাসী পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের অনুসারী ঈমানদার ভাইদের কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তারা নির্যাতনের ভয়ে শত্রুদের পাতানো ফাঁদে পা দিবেন? নাকি নিজ আক্বীদা ও আমলের উপরে দৃঢ় থাকবেন? তারা সুদৃঢ় সাংগঠনিক ঐক্যের মাধ্যমে বাতিল শক্তির মুকাবিলা করবেন, নাকি শয়তানী মতবাদের সামনে আত্মসমর্পণ করবেন? এরূপ কঠিন সংকট মুহূর্তে আল্লাহ স্বীয় রাসূলকে যেকথা শুনিয়েছিলেন, আমরাও আমাদের সাথী ভাই-বোনদের সেকথা শুনাতে চাই। আল্লাহ স্বীয় রাসূলকে বলেন, ‘ইহূদী-নাছারারা কখনোই তোমার উপর সন্তুষ্ট হবে না, যে পর্যন্ত না তুমি তাদের ধর্মের অনুসরণ করবে। তুমি বল, নিশ্চয়ই আল্লাহর দেখানো পথই সঠিক পথ। আর যদি তুমি তাদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ কর, তোমার নিকটে (অহি-র) জ্ঞান এসে যাওয়ার পরেও, তবে আল্লাহর কবল থেকে তোমাকে বাঁচাবার মতো কোন বন্ধু বা সাহায্যকারী নেই’ (বাক্বারাহ ২/১২০)। আমরা সর্বদা আল্লাহর সাহায্য কামনা করি এবং তাঁর আশ্রয় ভিক্ষা করি। আল্লাহ প্রেরিত ‘অহি’ পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের দেখানো পথকেই আমরা ছিরাতে মুস্তাক্বীম বা সরল পথ মনে করি। শয়তানের দেখানো অাঁকাবাঁকা পথে আমরা যেতে চাই না। যুগের পরিবর্তনে ইসলামের কোন পরিবর্তন হয় না। বরং ইসলাম যুগকে পরিবর্তন করে। এটাই হ’ল চিরন্তন আলোর পথ। আর এপথের শেষ ঠিকানা হ’ল জান্নাত। বাকী সবই অন্ধকারের পথ। যার ঠিকানা হ’ল জাহান্নাম। আল্লাহ আমাদেরকে সর্বদা ছিরাতে মুস্তাক্বীমের আলোকোজ্জ্বল রাজপথে সুদৃঢ় রাখুন- আমীন![4]
[1]. আহমাদ হা/১৫১৯৫; মিশকাত হা/১৭৭, সনদ হাসান।
[2]. আলে ইমরান ৩/১৫৪, মায়েদাহ ৫/৫০; বাক্বারাহ ২/২৭৭।
[3]. আহমাদ হা/১৭৬৭১; মিশকাত হা/১৯১, সনদ ছহীহ।
[4]. ১২তম বর্ষ, ১ম সংখ্যা, অক্টোবর ২০০৮।
দীর্ঘ ৩ বছর ৬ মাস ৬ দিন হাজতের নামে কারা নির্যাতন ভোগের পর ২৮শে আগষ্ট’০৮ বৃহস্পতিবার বাদ মাগরিব বগুড়া যেলা কারাগার থেকে যামিনে বের হয়ে এটাই ছিল আমীরে জামা‘আতের প্রথম সম্পাদকীয়।- প্রকাশক।