‘আল্লাহ ছাড়া কোন মা‘বূদ নেই’। সৃষ্টিকর্তা হিসাবে, জীবন ও মরণ দাতা হিসাবে, আইন ও বিধানদাতা হিসাবে, রোগ ও আরোগ্যদাতা হিসাবে, রূযী ও শক্তিদাতা হিসাবে, বুদ্ধিমত্তা ও জ্ঞানদাতা হিসাবে, বিপদহন্তা ও হেফাযতকারী হিসাবে আল্লাহ ব্যতীত কেউ নেই, কোন শক্তি নেই। কোন উপাস্য নেই। যার তন্দ্রাও নেই, নিদ্রাও নেই। তিনি নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের ধারক ও সবকিছুর ব্যবস্থাপক। বিপদে ও সম্পদে আমরা তাঁকেই ডাকি, তাঁর কাছেই আশ্রয় ভিক্ষা করি। তাঁকে রাযী-খুশী করার জন্যই আমরা আমাদের সবকিছুকে বিলিয়ে দেই। পরকালের চিরস্থায়ী জীবনে আমরা তাঁরই রহমতের ছায়াতলে আশ্রয় চাই। জাহান্নামের কঠিন শাস্তি ভোগ করার মত সাধ্য আমাদের নেই। পুলছিরাতের নীচের জ্বলন্ত অগ্নিগহবরে আমি পড়তে চাই না। সেখানকার বাঁকানো আংটায় আমি বিঁধে যেতে চাই না। আমি ঐ উত্তপ্ত হুতাশন পেরিয়ে যেতে চাই বিদ্যুৎ বেগে, আলোর গতিতে। যেন জাহান্নামের অগ্নিদাহের কোন অাঁচ আমার গায়ে না লাগে। চোখের পলকে পুলছিরাত পেরিয়ে আমি জান্নাতে প্রবেশ করতে চাই। এজন্য আমি দুনিয়ার এ পরীক্ষাগারে কেবল আল্লাহরই বিধান মানতে চাই। তাঁর রাসূলের দেখানো পথে চলতে চাই। কিন্তু ....
কিন্তু আমি পারছি কই! কে আমাকে বাধা দিচ্ছে? হ্যাঁ, বাঁধা আমার ঘরে-বাইরে, চারপাশে সর্বত্র। আল্লাহ্কে পেতে গেলে গায়রুল্লাহকে ত্যাগ করতে হয়। পুণ্য অর্জন করতে গেলে পাপ বর্জন করতে হয়। আল্লাহর দাসত্ব করলে শয়তানের দাসত্ব ছাড়তে হয়। আমি একজন কর্মক্ষম মানুষ। হালাল রূযীর সন্ধানে বেরিয়েছি। কিন্তু সর্বত্র সূদ-ঘুষের পুঁজিবাদী অর্থনীতি জোঁকের মত ধেয়ে আসছে, যা আমাকে জাহান্নামের খোরাক বানাবে। আমি স্বাধীনভাবে আল্লাহর আইন ও রাসূলের বিধান মেনে চলব। কিন্তু দেশের আইন ও প্রচলিত বিধানসমূহ আমাকে পদে পদে বাধা দিচ্ছে। আমি রাসূলের দেখানো ছহীহ হাদীছের পথে নিরিবিলি ইবাদত করব। কিন্তু বিভিন্ন মাযহাব ও তরীকার ধূম্রজালে আমি মোহগ্রস্ত হয়ে পড়ছি। দুনিয়া পূজারীরা নানাবিধ রঙিন বেশে ও চটকদার কথায় আমাদের ভুলাতে চায়। স্বার্থপরদের অন্যায় দাবী আমাদের বিপর্যস্ত করে ফেলে। হিংসুকেরা প্রতি মুহূর্তে আমাদের লক্ষ্যচ্যুত করতে চায়। ওরা দুনিয়ার ক্ষতি করে আমাদের ভয় দেখাতে চায়। আখেরাত থেকে আমাদের বঞ্চিত করতে চায়। কিন্তু জান্নাত পিয়াসী মুমিন কি দুনিয়ার বিনিময়ে আখেরাত হারাতে পারে?
হে মুমিন! তুমি সবকিছু ছেড়ে জান্নাতের পানে ধাবিত হও। ধর্মীয় ক্ষেত্রে, রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যেসব শক্তিধররা রব-এর আসন দখল করে বসে আছে, জগদ্দল পাথরের ন্যায় যারা জনগণের ঘাড়ের উপর চেপে আছে, তুমি এদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও। ছাফা পাহাড়ে দাঁড়িয়ে দেড় হাযার বছর পূর্বে শেষনবীর সেই দ্ব্যর্থহীন ঘোষণার ন্যায় তুমি বলে ওঠো ‘লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হ’। ‘আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই’। নকল উপাস্যদের ছেড়ে তুমি বেরিয়ে যাও তোমার প্রকৃত উপাস্যের দিকে। যেমন বেরিয়ে গিয়েছিলেন একদিন তোমার পিতা ইবরাহীম জন্মভূমি ছেড়ে এই বলে যে, ‘আমি চললাম আমার প্রভুর পানে। সত্বর তিনি আমাকে পথ প্রদর্শন করবেন’ (ছাফফাত ৩৭/৯৯)।
সেদিন ইবরাহীমের সাথে কেউ ছিল না স্ত্রী সারাহ ও ভাতিজা লূত ব্যতীত। তাঁর ভাগ্যে জুটেছিল কওমের গালি, অপবাদ ও রাষ্ট্রীয় নির্যাতন। তবুও তিনি ভেঙ্গে পড়েননি। তাহ’লে তুমি কেন ভেঙ্গে পড়বে?
ইবরাহীমের শ্রেষ্ঠ সন্তান মুহাম্মাদের ভাগ্যেও জুটেছিল নিজ কওমের দেওয়া অন্যূন ১৬ রকমের অপবাদ ও গালি, দৈহিক ও মানসিক নির্যাতন ও অবশেষে হত্যার পরিকল্পনা ও পরিণতিতে হিজরত। কা‘বা চত্বরে সিজদারত নবীর মাথায় উটের ভুড়ি চাপানো, গলায় কাপড় পেচিয়ে মেরে ফেলার চেষ্টা, সম্মুখে ও পশ্চাতে নিন্দা ও অভিশাপ প্রদান, মুখে থুথু নিক্ষেপ ও কুরআন পাঠের সময় হৈ চৈ করা, ত্বায়েফের মর্মান্তিক নির্যাতন কোনকিছুই সেদিন নিঃসঙ্গ নবীকে লক্ষ্যচ্যুত করতে পারেনি। ওহোদ যুদ্ধে গমনরত নবীকে ভীত করার জন্য পথিমধ্যে হাযারের মধ্যে সাড়ে তিনশ’ মুনাফিকের দলত্যাগ ও নানা অপবাদ দান ও অপকৌশল সমূহ নির্ধারণ- কোনকিছুই নবী ও তাঁর নির্ভেজাল সাথীদেরকে আদর্শচ্যুত করতে পারেনি। তবে আজ কেন হে পরপারের পথিক! তুমি ভেঙ্গে পড়বে? কেন তুমি দুনিয়ার ফাঁদে পা দিবে? জান্নাত যে তোমায় হাতছানি দিয়ে ডাকছে। তোমার স্নেহশীল পিতা-মাতার ন্যায় তোমাকেও তো কাল ভূপৃষ্ঠ ছেড়ে ভূগর্ভে (কবরে) স্থান নিতে হবে। তবে কিসের এত পিছুটান? যালেমদের যুলুমের ভয়? দুনিয়ার লোভ? মনে রেখ মযলূম ইবরাহীম ছিলেন বিশ্বনেতা, যালেম নমরূদ নয়। সম্বলহীন মূসা ছিলেন সকলের শ্রদ্ধেয় নেতা, ধনকুবের ক্বারূণ নয়। অতএব হে মুমিন! যতদিন হায়াত পাও, সাধ্যমত শেষনবীর আদর্শ মেনে চল। ডাইনে-বামে তাকিয়ো না। অন্যের জৌলুসে ভুলো না। গোনাহ থেকে তওবা কর। নেকীর প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি কর। ফিরে চলো তোমার প্রভুর পানে। তিনিই তোমার জন্য যথেষ্ট। আল্লাহ আমাদের শক্তি দিন- আমীন![1]
[1]. ১২তম বর্ষ, ৭ম সংখ্যা, এপ্রিল ২০০৯।