২৫শে মে’০৯ দুপুর ২-টা ও তার পরের ঘটনা। দূর থেকে দেখা গেল নদী ফুঁসে উঠে পাহাড়ের মত উঁচু ধবধবে সাদা পানির স্রোত, সামনে ধেয়ে আসছে। দূর থেকে বাঁধে দাঁড়িয়ে এ দৃশ্য উপভোগ করছে অনেকে। ভাবতেই পারেনি যে, এতদূর থেকে পানি এত দ্রুত কাছে আসবে। কিন্তু ভুল ভাঙলো কিছু পরেই। পিছন ফিরে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌঁড়ালো সবাই। বাড়ী এসে দেখা গেল ছেলে-বৌ সব যে যার মত চলে গেছে। বাড়ী-ঘর গবাদি-পশু হাঁস-মুরগী সব ফেলে জান নিয়ে ছুটলো সবাই। কিন্তু না। আইলা ধরে ফেলল অনেককে। চোখের পলকে বাপ-বেটা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। তিনদিন পরে বাপকে পাওয়া গেল প্রায় তিন মাইল দূরে একটা উপড়ানো গাছের ডাল-পালার মধ্যে। বিকৃত লাশ চেনা গেল তার কোমরে বাঁধা গামছা দেখে। ঘেরের মাছ বিক্রির ৩৫ হাযার টাকা ঘরে বালিশের নীচে আছে। কিন্তু রাস্তা থেকে ঘরে গিয়ে টাকা গুলো আনার ফুরছত পায়নি। গত বছরে ৬০ হাযার টাকায় কেনা ৪টি গরু মাত্র ২৬ হাযার টাকায় বেঁচে দিল বাধ্য হয়ে সুযোগ সন্ধানী এক ধনীর কাছে পশুখাদ্যের অভাবে। অগণিত লাশ ট্রাকে ও লঞ্চে ভরে নিয়ে গেল সেনাবাহিনী চোখের সামনে দিয়ে, যাদের পরিচয় আর কেউ কখনো জানবে না। এগুলি হ’ল সাতক্ষীরা শ্যামনগরের দুর্গত এলাকার কিছু ঘটনা। এরূপ অসংখ্য ঘটনা ঘটে গেছে দক্ষিণাঞ্চলে মুহূর্তের মধ্যে অবিশ্বাস্য গতিতে। যার সঠিক ইতিহাস কখনোই লিখিত হবে কি-না সন্দেহ। অথচ মাত্র এক সপ্তাহ পর ত্রাণ দিতে গিয়ে ঐ নদী পার হ’লাম নৌকায়। পানি নেমে গেছে তীর থেকে অনেক নীচে। কতই না শান্ত-শিষ্ট। চিন্তাই করা যায় না যে, এই নদী এক সপ্তাহ পূর্বে ফুঁসে উঠে বাঁধ ছাপিয়ে সবকিছু ভেঙ্গে-চুরে কি তান্ডব না ঘটিয়ে গেছে তীরবর্তী মানব বসতিগুলোর উপর দিয়ে।
পানি অবলা। বাতাস কথা বলে না। ওরা রাগে না, কাঁদে না, হাসে না। ওরা প্রাণহীন, অনুভূতিহীন। তাহ’লে কিভাবে ওরা ফুঁসে উঠলো? কিভাবে ওরা মানুষগুলোকে তাড়া করল? তাদের হত্যা করল ও বাঁধ-ভেড়ী ভেঙ্গে রাস্তা-ঘাট বাড়ী-ঘর একাকার করে আবার শান্ত হয়ে নিজ স্থানে ফিরে এল? কর্ম আমরা দেখলাম। অথচ কর্তা নেই। কথা শুনছি অথচ কথক নেই। লেখা পড়ছি অথচ লেখক নেই। ধোঁয়া দেখছি অথচ আগুন নেই। এমন কথা কেউ বিশ্বাস করবে কি? আমরা আইলার রুদ্ররূপ দেখলাম। কিন্তু এর সৃষ্টিকর্তা ও হুকুমদাতা কেউ নেই, এরূপ কথা বিশ্বাস করা যাবে কি? মূর্খরা বলে, এটা প্রকৃতির খেয়ালিপনা মাত্র। কিন্তু প্রকৃত জ্ঞানী যারা তারা বিশ্বাস করেন যে, এসবের পিছনে আছেন এক মহাশক্তিধর প্রজ্ঞাময় সত্তা, যিনি আল্লাহ। যার হুকুমেই এ পৃথিবী ও সমস্ত মাখলূক্বাতের সৃষ্টি হয়েছে। যার একক নির্দেশেই চলে সবকিছু। অবাধ্য সন্তানকে বাধ্য করার জন্য স্নেহময় পিতা যেমন অনেক সময় কঠোর হন, দয়াময় আল্লাহ তেমনি অবাধ্য বান্দাদের সোজা পথে ফিরিয়ে আনার জন্য মাঝে-মধ্যে আযাব প্রেরণ করে থাকেন। আর তখনই তাঁর হুকুমে শান্ত নদী হঠাৎ ফুঁসে ওঠে। মৃদুমন্দ বায়ু হঠাৎ ঘুর্ণিঝড়ে পরিণত হয়। নিথর সাগর হঠাৎ উত্তাল হয়ে জলোচ্ছ্বাসে পরিণত হয়। মুষ্টিমেয় পাপীর লাগামহীন পাপকর্মের জন্য হাযারো মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অপরাধী ও নিরপরাধ সবধরনের মানুষ এতে আক্রান্ত হয়। পাপীদের শাস্তি দেখে অন্য পাপীরা সাবধান হয়। ফলে পৃথিবী আপাততঃ শান্ত হয়। মুমিন যারা মারা পড়ে, তারা শহীদের মর্যাদা পেয়ে ধন্য হয়।[1] অন্যেরা পাপীদের শিক্ষা হাছিলের বস্ত্ত হয় এবং আল্লাহর করুণার পাত্র হয়।
‘আইলা’ নিয়ে গেছে সবকিছু। অনেকের ভিটে-মাটি নেই। খাবার পানি নেই, খাদ্য নেই। ঘেরের মাছ সব ভেসে গেছে। তীব্র লোনা পানিতে গাছ-পালা মরে যাচ্ছে। অমাবশ্যা-পুর্ণিমার গোনে পানি উঠানামা করছে। ভীত সবাই। আগামী অক্টোবর পর্যন্ত এভাবেই থাকবে। এমতাবস্থায় আমরা যারা বেঁচে আছি ও সুস্থ আছি, আমাদের কর্তব্য কী?
আমাদের প্রথম কর্তব্য হ’ল নিজ নিজ পাপ থেকে তওবা করা ও অনুতপ্ত হৃদয়ে আল্লাহর নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা করা। সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহর বিধান অনুযায়ী জীবন পরিচালনার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়া। দ্বিতীয় কর্তব্য হ’ল, দুর্গত মানবতার সেবায় এগিয়ে যাওয়া ও তাদের দুর্দশা লাঘবে সাধ্যমত চেষ্টা করা। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, তোমরা যমীনবাসীর উপর রহম কর, আসমানবাসী (আল্লাহ) তোমাদের উপর রহম করবেন।[2] তিনি বলেন, আল্লাহ বান্দার সাহায্যে অতক্ষণ থাকেন, যতক্ষণ বান্দা তার ভাইয়ের সাহায্যে থাকে।[3] ‘যে ব্যক্তি কোন মুসলিমের একটি বিপদ দূর করে দেয়, আল্লাহ ক্বিয়ামতের দিন তার একটি বিপদ দূর করে দেবেন।[4] তিনি বলেন, ঐ ব্যক্তি মুসলিম নয়, যে পেট ভরে খায় ও তার প্রতিবেশী ক্ষুধার্ত থাকে’।[5] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, তিন প্রকারের লোক জান্নাতী। তন্মধ্যে এক- ঐ শাসক যিনি ন্যায়নিষ্ঠ, দানশীল এবং যাকে সৎকাজের যোগ্যতা দান করা হয়েছে। দুই- ঐ ব্যক্তি, যিনি দয়ালু এবং নিকট ও দূরের সকল মুসলিমের প্রতি কোমল হৃদয়’।[6] ‘আল্লাহ বলেন, হে বনু আদম! তুমি (আল্লাহর পথে) ব্যয় কর। আমি তোমার জন্য ব্যয় করব। আর যদি ব্যয় করতে গিয়ে গণনা কর (অর্থাৎ কৃপণতা কর), তাহ’লে আমিও (তোমাকে অনুগ্রহ করতে) হিসাব করব’।[7] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, গবাদি-পশু সহ (ক্ষতিকর নয় এমন) প্রত্যেক প্রাণীর জীবন রক্ষার জন্য তোমাদের অশেষ পুরস্কার রয়েছে।[8]। তিনি বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তার দয়াশীল বান্দাদের উপরে দয়া করে থাকেন’।[9]
উল্লেখ্য যে, যারা স্রেফ মানবিক তাকীদে দান করে থাকেন, তাদের এ দয়া ও দান দুনিয়া ও আখেরাতে ফলবলহীন। দুনিয়াতে ফলহীন এজন্য যে, তার এ তাকীদ হয় ক্ষণস্থায়ী এবং দ্রুত তা কোন একটি স্বার্থের দিকে ধাবিত হয়। পক্ষান্তরে যারা পরকালীন স্বার্থে দান করে থাকেন, তাদের তাকীদ হয় স্থায়ী। তাদের দান হয় দুনিয়া ও আখেরাতে বরকতমন্ডিত। ঐ দানের ছওয়াব দশগুণ থেকে সাতশত গুণ এমনকি আল্লাহ যাকে ইচ্ছা করেন তার চেয়ে বহু গুণ বেশী ছওয়াব দিয়ে থাকেন (বাক্বারাহ ২/২৬১)। যার কখনোই কমতি হয় না। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন- আমীন![10]
[1]. মুসলিম হা/১৯১৫; মিশকাত হা/৩৮১১।
[2]. আবুদাঊদ হা/৪৯৪১; তিরমিযী হা/১৯২৪; মিশকাত হা/৪৯৬৯; ছহীহ আত-তারগীব হা/২২৫৬।
[3]. মুসলিম হা/২৬৯৯; মিশকাত হা/২০৪।
[4]. বুখারী হা/২৪৪২; মুসলিম হা/২৫৮০; মিশকাত হা/৪৯৫৮।
[5]. বায়হাক্বী, শু‘আব হা/৫৬৬০; মিশকাত হা/৪৯৯১; ছহীহ আত-তারগীব হা/২৫৬২।
[6]. মুসলিম হা/২৮৬৫; মিশকাত হা/৪৯৬০।
[7]. বুখারী হা/৪৬৮৪; মুসলিম হা/৯৯৩; মিশকাত হা/১৮৬২।
[8]. বুখারী হা/২৩৬৩, মুসলিম হা/৫৯৯৬।
[9]. বুখারী হা/৭৩৭৬; মুসলিম হা/২৩১৯; মিশকাত হা/৪৯৪৭।
[10]. ১২তম বর্ষ, ১০ম সংখ্যা, জুলাই ২০০৯।