আদর্শ চির অম্লান

আমাদের প্রথম পরিচয় আমরা মানুষ। আমরা জ্ঞানসম্পন্ন প্রাণী। আমাদের দ্বিতীয় পরিচয় আমরা মুসলমান। আমরা সার্বিক জীবনে আল্লাহর দাসত্ব করি। আমাদের তৃতীয় এবং বৈশিষ্ট্যগত পরিচয় হ’ল আমরা আহলুল হাদীছ। আমরা সার্বিক জীবনে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের নিঃশর্ত অনুসারী। এ দু’টি উৎসের প্রতি অবিচল আস্থা ও পূর্ণ আনুগত্যের মাধ্যমেই মানুষ সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকতে পারে। কেননা মানুষের জ্ঞান কোন বিষয়ে সত্য ও মিথ্যার চূড়ান্ত ফায়ছালা দানের ক্ষমতা রাখে না। বরং সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর ‘অহি’ অভ্রান্ত সত্যের চূড়ান্ত উৎস। মানুষের জ্ঞান আল্লাহ প্রেরিত অহি-র বিধানের ব্যাখ্যাকারী হ’তে পারে। কিন্তু পরিবর্তনকারী বা রহিতকারী হ’তে পারে না। রাজনীতিকের রাজনীতি মিথ্যা হ’তে পারে। অর্থনীতিবিদের অর্থনীতি মিথ্যা হ’তে পারে। দার্শনিকের দর্শন মিথ্যা হ’তে পারে। বৈজ্ঞানিকের বিজ্ঞান মিথ্যা হ’তে পারে। কিন্তু পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের কোন বাণী মিথ্যা হবে না। পৃথিবীর সকল যুক্তিবাদী ও শান্তিবাদী মানুষকে এক সময় অহি-র বিধানের কাছে ফিরে আসতেই হবে। এখানে আত্মসমর্পণ করতেই হবে। নানাবিধ অপযুক্তির আড়ালে দুনিয়ার মানুষ সর্বদা কুরআন ও সুন্নাহকে এড়াতে চেয়েছে। ইসলামের নিয়ন্ত্রিত জীবনধারা থেকে মুক্ত হবার জন্য শয়তান সর্বদা মানুষকে কুমন্ত্রণা দিয়ে থাকে। আলেম-জাহিল, জ্ঞানী-মূর্খ কেউ শয়তানের খোঁচা থেকে মুক্ত নয়।

পাশ্চাত্যের রাজনৈতিক দর্শন আজ মানুষের শান্তিময় সমাজকে ক্ষমতালোভী অসংখ্য দলে বিভক্ত করে পরস্পরে সদা মারমুখী হিংস্র পশুর সমাজে পরিণত করেছে। ইহূদী-নাছারাদের পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক দর্শন মানুষের পারস্পরিক সহমর্মী সমাজকে হৃদয়হীন হাঙর-কুমীরের সমাজে পরিণত করেছে। ধর্মনিরপেক্ষ বস্ত্তবাদী দর্শন মানুষকে বস্ত্তসর্বস্ব ও স্বার্থান্ধ বানিয়েছে। চিরন্তন মানবীয় সম্প্রীতি ও পারস্পরিক সহানুভূতি আজ সমাজ থেকে বিদায় নিতে চলেছে। মানুষ্যকল্পিত নানাবিধ আচার-অনুষ্ঠান ধর্মের নামে ও রসম-রেওয়াজের নামে বদ্ধ জোয়ালের ন্যায় মানুষের কাঁধে চেপে বসে আছে।

এক্ষণে আহলেহাদীছের দায়িত্ব কী হবে? তারা কি পাশ্চাত্য রাজনীতির ও অর্থনীতির পদলেহী হবে? তারা কি সেক্যুলার, ছূফী ও মডারেট ইসলামিষ্ট সনদ নেবার জন্য গলদঘর্ম হবে? তারা কি ধর্মনিরপেক্ষ ও বস্ত্তবাদী সংস্কৃতির পুচ্ছধারী হবে? তারা কি আনুগত্যহীন দলবাজ হবে? কিংবা চরমপন্থী অস্ত্রবাজ হবে? কোনটাই নয়। কেননা সে তো কুরআন ও সুন্নাহর ধারক ও বাহক হ’তে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। ছাহাবা ও তাবেঈনের সনিষ্ঠ অনুসারী হওয়াই তো তার গতিপথ। পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছকে হাতে-দাঁতে আঁকড়ে ধরাই তার চিরন্তন বৈশিষ্ট্য। সে কখনোই পরিস্থিতির দোহাই দিয়ে বাতিলের সঙ্গে আপোষ করতে পারে না। বরং সর্বাবস্থায় সে পুঁতি-গন্ধময় পরিস্থিতি পরিবর্তনের সংগ্রাম করবে। কুরআন ও সুন্নাহর স্বচ্ছ আলোয় সে পথ দেখবে। মানুষের বানোয়াট তন্ত্র-মন্ত্রের চাকচিক্যে সে পথহারা হবে না। সে যদি কখনো একা হয়ে যায়, তথাপি তাকে কুরআন ও হাদীছের হেফাযতকারী হ’তে হবে। কোন অবস্থাতেই আলোর পথ ছেড়ে অন্ধকার গলিপথে যাওয়া যাবে না। কারণ ‘আহলেহাদীছ’ প্রচলিত অর্থে কোন মাযহাব, মতবাদ, ইযম বা School of thought-এর নাম নয়। বরং এটি একটি পথের নাম। যে পথ আল্লাহ প্রেরিত সর্বশেষ অহি-র পথ। পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের পথ। এ পথের শেষ ঠিকানা হ’ল জান্নাত‘আহলেহাদীছ’ তাই চরিত্রগত দিক দিয়ে একটি দাওয়াত বা একটি আন্দোলনের নাম। এ আন্দোলন ইসলামের নির্ভেজাল আদিরূপ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। আধুনিকতার চমক দেখে বা বিলাসিতার জৌলুসে এ আন্দোলনের সত্যিকারের কর্মীরা কখনো পথ হারায় না। জীবনের উত্তাল পথে কুরআন ও সুন্নাহর দু’টি রেলপথে এরা দৃঢ়ভাবে অবস্থান করে। যুলুম-অত্যাচারের ভয় ও প্রলোভনের ফাঁদ তাদেরকে এ আন্দোলন থেকে ফিরিয়ে নিতে পারে না। এ আন্দোলন বিশ্বমানবতাকে সকল বিভক্তি ও দলাদলি ভুলে শেষনবী মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের একক নেতৃত্বে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহর ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ মহাজাতিতে পরিণত করতে চায়।

বিপ্লবী আদর্শ ও পূর্ণাঙ্গ জীবন-বিধান হিসাবে আহলেহাদীছগণ ইসলামকে সর্বযুগীয় সমাধান বলে বিশ্বাস করেন এবং ইসলামের গতিশীল ও Dynamic হওয়ার স্বার্থেই ইজতিহাদকে সকল যুগে অবশ্য প্রয়োজনীয় এবং তাক্বলীদে শাখছীকে অবশ্য বর্জনীয় বলে মনে করেন। কিন্তু ইজতিহাদের নামে কুরআন ও হাদীছের প্রকাশ্য নির্দেশ ও মূলনীতিকে লংঘন করে মধুর বদলে বিষ ভক্ষণে তারা রাযী নন। ‘মতপার্থক্যসহ ঐক্যে’র নামে তারা শিরক ও বিদ‘আতকে হযম করে কোন ঐক্যজোট করতে পারেন না। তাওহীদ ও ছহীহ সুন্নাহর সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারকে অক্ষুন্ন রেখেই তারা মুসলিম উম্মাহকে একটি ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী জাতিতে পরিণত করতে চান। আহলেহাদীছের এই আদর্শ ও বৈশিষ্ট্য চির অম্লান ও শাশ্বত। যা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কেউ ‘আহলেহাদীছ’ থাকতে বা হ’তে পারে না। আল্লাহ আমাদের সকলকে হেদায়াত করুন- আমীন![1]


[1]. ১২তম বর্ষ, ৮ম সংখ্যা, মে ২০০৯।