মানবতার শেষ আশ্রয় ইসলাম

মানুষ বড় অসহায় সৃষ্টি। পৃথিবীতে ভূমিষ্ট হয়েই চিৎকার দিয়ে কান্নার মাধ্যমে সে তার অসহায়ত্ব প্রকাশ করে। তারপর মাতা-পিতা, দাদা-দাদী, নানা-নানীদের লালন পালনে সে ক্রমে বেড়ে ওঠে। যৌবনে ধনবলে-জনবলে বলিয়ান হয়ে সে অনেক সময় তার অসহায়ত্বের কথা ভুলে যায়। বার্ধক্যে সে আবার অসহায় হয়ে পড়ে। এভাবে এক সময় সে করুণ চাহনি দিয়ে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে দুনিয়া থেকে বিদায় হয়ে যায়। এতে প্রমাণিত হয় যে, তার জন্ম ও মৃত্যু, উত্থান ও পতন, উন্নতি ও অবনতি সকল ক্ষেত্রে সর্বদা সে অদৃশ্য কোন শক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হচ্ছে। সেই অদৃশ্য মহা শক্তিধর সত্তার নাম ‘আল্ল­াহ’। আসমান ও যমীনের সবকিছুই তাঁর অনুগত। তবে যেহেতু মানুষকে পরীক্ষার জন্য তার ইচ্ছাশক্তির স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে, তাই সে অনেক সময় তার সীমিত জ্ঞানের বড়াই করে। যিদ ও অহংকারে বুঁদ হয়ে নিজের ক্ষমতার দম্ভ করে। এক্ষণে যদি কেউ ভেবে থাকেন নিজেরা আইন বানিয়ে পুলিশ দিয়ে পিটিয়ে দেশ ঠিক করে ফেলব, তাহ’লে তাকে একবার পিছনের দিকে তাকাতে বলব।-

আমেরিকার ‘মদ্য নিবারক’ আইনটি ছিল গত শতাব্দীতে (১৯২০-১৯৩৩) বিশ্ব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সংস্কার প্রচেষ্টা, যা মাত্র চৌদ্দ বছরের মাথায় চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়। কারণ আমেরিকা তাদের শেষ আশ্রয় ভেবেছিল তাদের জনমত ও সিনেটরদের মতামতকে। শাশ্বত সত্য বলে কিছুই তাদের কাছে ছিল না, যার কাছে তারা মাথা নত করতে পারে। আর তাই ১৯২০ সালের জানুয়ারীতে ‘মদ্য নিবারক আইন’ পাস করলেও মদ হারানোর বিরহ বেদনায় ১৯৩৩ সালের ডিসেম্বরে তারা পুনরায় মদ বৈধ করার পক্ষে আইন পাস করে। অথচ আইনটি কার্যকর করতে গিয়ে চৌদ্দ বছরে ২০০ লোক পুলিশের গুলীতে নিহত হয়। ৫ লাখ ৩৪ হাযার ৩৩৫ জন লোক কারারুদ্ধ হয়। এতে বুঝা যায় যে, মদ নিষিদ্ধ করার মত একটি সর্বজনগ্রাহ্য বিষয়েও সেদেশের মানুষ একমত হ’তে পারেনি। অথচ দেড় হাযার বছর আগে মদীনায় যেদিন মদ নিষিদ্ধ করা হয়, সেদিন মুসলমানরা সাথে সাথেই মদ পরিত্যাগ করল, ভান্ডসমূহ গুড়িয়ে দিল। এর জন্য কোন পুলিশ বা জেলখানার প্রয়োজন হয়নি। কারণ একটাই। মুসলমানরা আল্লাহ্কেই সার্বভৌমত্বের মালিক বলে বিশ্বাস করেছিল এবং আখেরাতে মুক্তি অর্জনকে তাদের জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল। পক্ষান্তরে মার্কিন জাতি জনগণকেই সার্বভৌমত্বের মালিক ভেবেছিল এবং দুনিয়ার চাওয়া-পাওয়াকেই তাদের জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল। যা তাদেরকে সেক্যুলার ও পুঁজিবাদী বানিয়েছিল। বর্তমান পৃথিবীতে তাদের অনুসারী রাষ্ট্রগুলির অবস্থাও প্রায় একই রূপ। ফলে শান্তির সোনার হরিণ আজও অধরা রয়েছে।

প্রশ্ন হ’ল : এভাবেই কি চলতে থাকবে চিরদিন? বারবার দলবদল ও নেতাবদলে সমাজের কাংখিত পরিবর্তন হয়েছে কি কোনদিন? অজ্ঞ ও বিজ্ঞের ভেদাভেদহীন দল ও প্রার্থী ভিত্তিক নেতৃত্ব নির্বাচনে আগতদের মাধ্যমে সংসদে বসে ঝগড়া ও টেবিল চাপড়ানো ছাড়া ঠান্ডা মাথায় সৎ পরামর্শ ভিত্তিক নিরপেক্ষ প্রশাসন সম্ভব হবে কি কোনদিন? আইন রচনার শাশ্বত উৎস কোনটি? সার্বভৌমত্বের মালিক কে? -যার সামনে সকল সংসদ সদস্য মাথা নত করতে বাধ্য? এ প্রশ্নের সমাধান আজও হয়েছে কি? অথচ সেই সত্য তো কেবলমাত্র ‘আল্লাহ’। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষ তাঁরই সৃষ্ট বান্দা। তাঁর দেওয়া আলো-বাতাস, মাটি ও পানি যেমন সবার জন্য কল্যাণময়, তেমনি তাঁর প্রেরিত আইন ও আহকাম সকল মানুষের জন্য চিরন্তন কল্যাণ বিধান। নেপোলিয়ন, বার্নার্ডশ’, এম.এন. রায় প্রমুখ অগণিত মনীষী ইসলামী শাসনব্যবস্থার শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করে গিয়েছেন। ভারত বিভাগের পর মিঃ গান্ধী সেদেশে ওমরের শাসন কায়েমের জন্য নেতাদের প্রতি আহবান জানিয়েছিলেন। এভাবে জ্ঞানীগণ যুগে যুগে স্বীকার করলেও সমাজনেতাগণ তা মানতে চান না। কারণ তাতে তাদের স্বেচ্ছাচারিতা ব্যাহত হয়। আর সেকারণেই তারা ধর্মনিরপেক্ষতার ধুয়া তোলেন। যার একমাত্র লক্ষ্য সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনা থেকে ইসলামকে বিতাড়িত করা। ফলে যে সংসদে ছালাতের বিরতি দিয়ে আল্লাহর সামনে সিজদায় লুটিয়ে পড়া হয়। সেই সংসদেই আল্লাহর বিধানকে পদতলে পিষ্ট করে নিজেদের বিধান চালানো হয়। অতঃপর প্রশাসন ও বিচার বিভাগের মাধ্যমে জনগণকে তা মানতে বাধ্য করা হয়। এভাবে স্বাধীন মানুষকে আল্লাহর গোলাম না বানিয়ে মানুষের গোলাম বানানো হয়। ফলে এক দলকে দিয়ে আল্লাহ আরেক দলকে প্রতিরোধ করেন (বাক্বারাহ ২/২৫১)। সম্প্রতি ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর উপর বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার (২০০১-২০০৬ খৃ.) ইতিহাসের যে জঘন্যতম মিথ্যাচার ও অত্যাচার চালিয়েছে, তার কৈফিয়ত তারা আল্লাহর কাছে দিতে পারবেন কি? ট্রাজেডী এই যে, নেতারা কখনো নিজেদের অন্যায়ের কথা স্বীকার করেন না।

বৃটিশ চলে গেছে ৬১ বছর আগে। ইতিমধ্যে বহু নেতা এলেন আর গেলেন। কিন্তু নীতির কোন পরিবর্তন হয়েছে কি? হীনমন্য কিছু মুসলিম বুদ্ধিজীবী ইসলামকে টেনে-হিঁচড়ে প্রচলিত অমানবিক ও অযৌক্তিক মতবাদ সমূহের সাথে আপোষের চেষ্টা করেন। কিন্তু ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে তাঁরা ভয় পান। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ অনেকে ছালাত-ছিয়াম-হজ্জ ইত্যাদি পালন করেন। আর ভাবেন, ইসলামের আর কীইবা বাকী রাখলাম। অথচ তারা জানেন না যে, জীবনের সর্বক্ষেত্রে আল্লাহর বিধানের আনুগত্য করার নাম ‘ইসলাম’। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে পরিত্যাগ করে মানুষের সার্বভৌমত্বকে প্রতিষ্ঠা করা, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ইসলামী অর্থনীতি পরিত্যাগ করে পুঁজিবাদী অর্থনীতি বহাল রাখা, আদালতে আল্লাহর বিধান অনুযায়ী ফায়ছালা না করে নিজেদের রচিত বিধান অনুযায়ী ফায়ছালা করা, শিক্ষা ক্ষেত্রে তরুণ ছাত্রদেরকে আখেরাতমুখী শিক্ষা না দিয়ে দুনিয়াপূজারী ও বস্ত্তবাদী করে গড়ে তোলা কখনোই কোন মানবতাবাদী সরকারের কর্তব্য হ’তে পারেনা।

ইসলামের বাইরে সকল তন্ত্র-মন্ত্রই এক কথায় ‘জাহেলিয়াত’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি মানুষকে জাহেলিয়াতের দিকে আহবান জানালো, সে ব্যক্তি জাহান্নামীদের দলভুক্ত হ’ল। যদিও সে ছিয়াম পালন করে ও ছালাত আদায় করে এবং ধারণা করে যে, সে একজন মুসলিম’।[1] মুখে বলা হয় অধিকাংশ জনগণের রায় অনুযায়ী দেশ চলবে। অথচ এদেশের অধিকাংশ মানুষের আকীদা ও আমল হ’ল ‘ইসলাম’। তাদেরকে পাকিস্তানী শাসকরা সবসময় ধোঁকা দিত যে, ‘কুরআন ও সুন্নাহ পরিপন্থী কোন আইন করা হবেনা’। অথচ বলা হতো না যে, কুরআন-সুন্নাহ অনুযায়ী আইন করব। কথার এই মারপ্যাঁচ সরল ঈমানদার জনগণ অত বুঝে না। তাই তারা বারবার প্রতারিত হয়েছে, আজও হচ্ছে। সেক্যুলার সরকারের নিকট শাশ্বত সত্য বলে কিছু নেই। তারা তাদের খেয়াল-খুশীকেই আইনের মর্যাদা দিয়ে দেশ শাসন করে থাকেন। ফলে যা হবার তাই হচ্ছে। আল্লাহ বলেন, ‘জনপদের অধিবাসীরা যদি বিশ্বাস স্থাপন করত ও আল্লাহভীরু হ’ত, তাহলে আমরা তাদের উপর আকাশ ও পৃথিবীর বরকতের দুয়ারসমূহ খুলে দিতাম’ ..(আ‘রাফ ৭/৯৬) অতএব নেতৃবৃন্দ যদি সত্যিকার অর্থে জনগণের কল্যাণ ও সমৃদ্ধি কামনা করেন, তাহ’লে আল্লাহর আনুগত্যের প্রতি আন্তরিক হৌন। দেশকে ঈমানের পথে পরিচালিত করুন। আল্লাহ বলেন, ‘আর যে ব্যক্তি ‘ইসলাম’ ব্যতীত অন্য কোন দ্বীন তালাশ করে, তার নিকট থেকে তা কখনোই কবুল করা হবে না এবং ঐ ব্যক্তি আখেরাতে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে’ (আলে ইমরান ৩/৮৫)। অতএব মানবতার শেষ আশ্রয় হ’ল ইসলাম। মযলূম মানবতার পক্ষে তাই আমাদের আহবান, ‘ফিরে চলুন শাশ্বত সত্যের পথে, পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহর পথে’। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন- আমীন![2]


[1]. আহমাদ হা/১৭৮৩৩; তিরমিযী হা/২৮৬৩; মিশকাত হা/৩৬৯৪, সনদ ছহীহ।

[2]. ১২তম বর্ষ, ৪র্থ সংখ্যা, জানুয়ারী ২০০৯।