গাযায় লুণ্ঠিত মানবতা : বিশ্ব বিবেক জাগ্রত হও

ফিলিস্তীনের গাযা ভূখন্ডে তিন সপ্তাহব্যাপী মুসলিম নিধন ও ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর পর সম্প্রতি আগ্রাসী ইস্রাঈল সেখানে যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা করেছে। প্রায় দেড় সহস্রাধিক নারী-পুরুষ নিহত হয়েছে এবং আহত ও পঙ্গু হয়েছে পাঁচ সহস্রাধিক। নিহতদের এক তৃতীয়াংশই নিষ্পাপ শিশু। সমস্ত গাযা শহর ধ্বংসস্ত্তপে পরিণত হয়েছে। যারা এখনো বেঁচে আছে, তারা ইস্রাঈলের নিক্ষিপ্ত ফসফরাস গ্যাসে ও অন্যান্য কারণে জটিল স্নায়ুরোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। জাতিসংঘের প্রতিনিধিদল বিধ্বস্ত শহর পরিদর্শন শেষে গাযা পুনর্গঠনে অন্যূন দু’শো কোটি ডলার প্রয়োজন বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন। ধনকুবেররা হয়ত ডলার দিবেন, কিন্তু যে জীবনগুলি হারিয়ে গেছে, তা কি কেউ ফেরৎ দিতে পারবেন? প্রায় হাযার বছর পূর্বে খ্রিষ্টান ক্রুসেডাররা যখন ফিলিস্তীনে আগ্রাসন চালিয়েছিল, সে সময় তারা মসজিদুল আক্বছায় আশ্রয় গ্রহণকারী সত্তুর হাযারের অধিক মুসলমানকে এক সপ্তাহের মধ্যে হত্যা করেছিল। আজও সেই খ্রিষ্টান আমেরিকার সহায়তায় ইহূদী রাষ্ট্র ইস্রাঈলের নেতারা নির্বিবাদে মুসলিম হত্যা করে চলেছে। যার বিরুদ্ধে এখন খোদ ইহূদী জনগণ ফুঁসে উঠেছে।

হযরত ওমর (রাঃ)-এর খেলাফতকালে ১৫ হিজরী সনে ফিলিস্তীন ইসলামী খেলাফতভুক্ত হয়। তার পূর্ব থেকে এ যাবত ফিলিস্তীন সর্বদা একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট এলাকা। তুরস্কের ওছমানীয় খেলাফতের অধীনে দীর্ঘ প্রায় চারশো বছর ফিলিস্তীন এক প্রকার স্বাধীন রাষ্ট্রই ছিল। মুসলিম-ইহূদী সবাই সেখানে মিলেমিশে বসবাস করত। কিন্তু ১ম বিশ্বযুদ্ধের (১৯১৪) পর ইরাক ও ফিলিস্তীন যখন অন্যতম বিজয়ী পক্ষ ইংরেজদের দখলে চলে যায়, তখন থেকেই ফিলিস্তীনে ইহূদী রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা হ’তে থাকে। যা প্রকাশ্যে রূপ নেয় ১৯১৭ সালের ২রা নভেম্বর বৃটেন কর্তৃক বেলফোর ঘোষণার মাধ্যমে। বৃটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রী বেলফোর দুনিয়ার সকল ইহূদীর জন্য এখানে একটি ইহূদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন এবং জাতিসংঘের মাধ্যমে তা বাস্তবায়িত হয় ১৯৪৮ সালে।

ফিলিস্তীনের লোকসংখ্যার শতকরা ৯৩ ভাগ ছিল আরব এবং বাকী মাত্র ৭ ভাগ ছিল দেশীয় ইহূদী। অতঃপর শুরু হ’ল মুসলিম বিতাড়ন ও নির্যাতনের পালা। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের ধ্বজাধারীদের হাতে নির্যাতিত ও বিতাড়িত সংখ্যাগরিষ্ট মুসলিম অধিবাসীগণ রাতারাতি উদ্বাস্ত্ত হয়ে পার্শ্ববর্তী আরব রাষ্ট্র সমূহে আশ্রয় শিবিরের বাসিন্দা হয়ে জীবন কাটাচ্ছেন তখন থেকে আজ পর্যন্ত। বহিরাগত ইহূদীরা এসে ফিলিস্তীনীদের মাতৃভূমি দখল করে নিল। যারা সেখানে রয়ে গেছেন মাটি কামড়ে, তাদের উপরে চলছে ইঙ্গ-মার্কিন চক্রের অবৈধ সৃষ্টি ইস্রাঈলের বোমা হামলা ও রক্তের হোলি খেলা। হামাস-এর অপরাধ তারা ইস্রাঈলের অভ্যন্তরে রকেট হামলা করে। হ্যাঁ, বাঁচার জন্য তাদের এতটুকুরও অধিকার নেই। অতএব তাদের দমনের জন্য চালানো হয়েছে ট্যাংক ও বিমান হামলা। তাতে তিন সপ্তাহে ইস্রাঈলে নিহতের সংখ্যা তের। অথচ ফিলিস্তীনে নিহত হয়েছে দেড় সহস্রাধিক। বোমা হামলার সাথে চালানো হয়েছে নিষিদ্ধ ঘোষিত ফসফরাস গ্যাসের হামলা। এ গ্যাস বোমা যেখানে পড়ে সেখানে আগুন ধরে যায় এবং তার আশপাশের সব মানুষ পুড়ে যায়। এর প্রতিক্রিয়ায় অন্য মানুষ কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়। টিভি পর্দায় ও পত্রিকার পৃষ্ঠায় নিরপরাধ নারী, বৃদ্ধ ও ফুলের মত নিষ্পাপ শিশুদের সারিবদ্ধ লাশ প্রতিদিন দেখেছে দুনিয়ার মানুষ। তা দেখে কেঁদেছে মানবতা, কেঁদেছে বিবেক। কিন্তু কাঁদেনি তারা, যাদের হাতে আল্লাহ ক্ষমতা দান করেছেন। কাঁদেনি বুশ, কাঁদেনি ওবামা, কাঁদেনি এহুদ ওলমার্ট। কাঁদেনি মুসলিম বিশ্বের কাপুরুষ রাষ্ট্রনেতাদের বুক। কিন্তু সবকিছু দেখেছেন একজন, যিনি আছেন সবার অলক্ষ্যে সবার উপরে। নিশ্চয়ই তাঁর অমোঘ শাস্তি নেমে আসবে ঐ যালেমদের উপর। যারা শক্তির অপব্যবহার করছে ঠুনকো অজুহাত দেখিয়ে। কারণ যারা মরছে ওরা মুসলমান। ওরা বেঁচে থাকলে যে আল্লাহর নাম নিবে। অতএব ওদের খতম করাই কর্তব্য।

তাইতো দেখছি জর্জ ডব্লিউ বুশ (জুনিয়র) যখন ইস্রাঈলের গাযা অভিযানের পক্ষে সাফাই গান, তখন তার বিরোধী দলের ভাবী প্রেসিডেন্ট বারাক হোসেন ওবামা চুপটি মেরে থাকেন। এর কারণ বুশের রিপাবলিকান ও ওবামার ডেমোক্রেটিক উভয় দলই ইহূদী লবীর কাছে যিম্মী। তাই জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে ইস্রাঈলী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে একটা বিবৃতিতে স্বাক্ষর দিতেও সাহস করেননি বুশের প্রতিনিধি। এখন বরাক ওবামা কি পারবেন মযলূম মানবতার পক্ষে সাহসী ও উদার ভূমিকা রাখতে? ধন্যবাদ তুর্কি প্রধানমন্ত্রী রিসেপ এরদোগানকে, যিনি সুইজারল্যান্ডের ডাভোসে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের সম্মেলনে রণোন্মাদ ইস্রাঈলী প্রেসিডেন্ট শেমন পেরেজের মুখের উপর বলেছেন, ‘আপনি একজন খুনী। আপনার হাত ফিলিস্তীনীদের রক্তে রঞ্জিত’। অতঃপর গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ভড়ংধারী বিশ্বনেতাদের বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে ধিক্কার ও প্রতিবাদ জানিয়ে তিনি সম্মেলন ত্যাগ করে সোজা নিজ দেশে চলে এসেছেন। তাঁর এ সাহসী প্রতিবাদ সারা বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়েছে। ইস্তাম্বুল বিমান বন্দরে তাই হাযারো মানুষ তাকে বরণ করে নিয়েছে বীরোচিত সম্বর্ধনা দিয়ে। মযলূম মানবতার পক্ষে কথা বলার জন্য আমরাও তাকে অভিনন্দন জানাই। আমরা চাই মুসলমানের ঘুমন্ত ঈমান জেগে উঠুক! লুণ্ঠিত মানবতার পক্ষে বিশ্ব বিবেক জাগ্রত হউক! আল্লাহ তুমি সাহায্য কর- আমীন![1]


[1]. ১২তম বর্ষ, ৫ম সংখ্যা, ফেব্রুয়ারী ২০০৯।