টিপাইমুখ বাঁধ : আরেকটি ফারাক্কা

পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ বলে খ্যাত যে ভারতের ৩০ কোটি মানুষ দারিদ্র পীড়িত। যার মধ্যে প্রায় ১১ কোটি মানুষ দারিদ্র্য সীমার নীচে বসবাস করে, সেই ভারতের মানুষের একটা অংশ জোঁকের মত গরীবের রক্ত শোষণ করে পুঁজিবাদী আমেরিকা-ইংল্যান্ডকে ডিঙিয়ে এখন বিশ্বের সেরা ধনী হিসাবে নিজেদের দাঁড় করিয়েছে। সেই সাথে টাকার চাকতি আর মিথ্যা আশ্বাসের জালে আটকিয়ে গরীবের ভোট নিয়ে ঐসব পুঁজিবাদী শোষকরা নিজেরা বা নিজেদের অনুগতদের রাষ্ট্রক্ষমতায় বসিয়ে নিজ রাষ্ট্রের বা পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রের যেখানেই তাদের পুঁজির স্বার্থ দেখতে পায় সেখানেই তারা হামলে পড়ে পুঁজি বিনিয়োগ করে পুঁজির পাহাড় গড়ার জন্য। আর সেজন্য তারা তৈরী করে নানাবিধ প্রতারণার কৌশল। ভারতবর্ষ চিরকাল বিদেশী হামলাকারীদের লোভনীয় ভূমি হিসাবে পরিচিত। আর সবসময় তাদের সহযোগিতায় ছিল দেশীয় দালাল শ্রেণী। যারা বিদেশীদের দেওয়া জমিদার, নওয়াব, স্যার, নাইট ইত্যাদি লকবের তকমা এঁটে নিজ দেশীয় লোকদের উপর যুলুম করত ও তাদের রক্ত শোষণ করত। ’৪৭-এর স্বাধীনতা লাভের পর বিদেশী শোষকরা শাসনক্ষমতা ছেড়ে চলে গেলে দেশীয় শোষকরা ক্ষমতায় বসে দু’হাতে লুটেপুটে খেতে শুরু করে। বিদেশীরা যে শাসননীতি এদেশে রেখে যায়, তাতে শোষকদের ক্ষমতা লাভের সুন্দর সুযোগ থাকায় দেশীয় দালাল শাসকরা তার কোন পরিবর্তন ঘটায়নি। ফলে স্বাধীনতা লাভের পর বিগত ৬১ বছর যাবত ভারত বর্ষের কথিত স্বাধীন রাষ্ট্রগুলি বৃটিশের রেখে যাওয়া শোষণমূলক রাজনীতি ও অর্থনীতির পায়রবী করে চলেছে পুঙ্খানুপঙ্খভাবে। আর সেকারণেই ‘গরীবী হটাও’ শ্লোগান দিয়ে ‘গরীবী বাড়াও’-এর প্রতিযোগিতা চলছে দেশীয় প্রভুদের হাতেই।

পুঁজিবাদীদের নযর সর্বদা ভারতবর্ষের সর্বত্র সার্চ লাইটের আলোর মত ঘুরতে থাকে। শকুন যেমন আকাশে উঠেও মাটিতে নযর থাকে কোথায় একটা মড়া পাওয়া যায়, এইসব শোষকরা সর্বদা তাকিয়ে থাকে কোথায় গিয়ে শোষণের সুযোগ পাওয়া যায়। ফেরাঊন-হামান ও কারূণের গোষ্ঠী এইসব শোষকদের নযর থাকে সর্বদা ভারত-বাংলাদেশ-পাকিস্তান, আফগানিস্তান, মায়ানমার প্রভৃতি এলাকার স্বার্থ সংশ্লিষ্ট এলাকা সমূহের দিকে। চাই তা মাটির উপরে হৌক বা পানির নীচে ভূতলে হৌক।

প্রতিবেশী শকুনীরা এবার বিদেশী আন্তর্জাতিক শকুনদের সাথে মিলে উত্তর-পূর্ব ভারতের হিমালয় ও বরাক অববাহিকা অঞ্চলের প্রাকৃতিক সুবিধা ব্যবহার করে পানিবিদ্যুৎ প্রকল্পের মাধ্যমে ৬০ হাযার মেগাওয়াটের বেশী বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিশাল এক মুনাফা বাণিজ্যের আয়োজন করে চলেছে। যা ভারত ও বাংলাদেশ উভয় দেশকে চূড়ান্ত ক্ষতির মধ্যে ঠেলে দেবে।

বাংলাদেশের উপর দিয়ে ভারত থেকে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা প্রধান তিনটি নদী গিয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। গঙ্গা চাপাই নবাবগঞ্জে পদ্মা হয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছে। যার বিপরীতে মুর্শিদাবাদের ফারাক্কায় ভারত বাঁধ চালু করেছে ১৯৭৫ সালের ২১শে এপ্রিলে। এর ফলে রাজশাহী-খুলনা সহ উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যেলাগুলি মরুভূমিতে পরিণত হবে। সুন্দরবন শেষ হয়ে যাবে। দ্বিতীয়ঃ ব্রহ্মপুত্র নদী। যা কুড়িগ্রাম দিয়ে ঢুকে ব্রহ্মপুত্র-যমুনা ইত্যাদি নামে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। এর বিপরীতে ভারত ৩০টি সংযোগ খাল খনন করে ৩৭টি শাখা নদী সহ অন্যান্য নদীর মধ্যে আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প স্থাপন করে সব পানি উত্তর প্রদেশ, মধ্য প্রদেশ, রাজস্থান প্রভৃতি উজানের রাজ্যগুলিতে টেনে নিচ্ছে। ফলে বাংলাদেশের উত্তর বঙ্গ মরুভূমি হ’তে চলেছে। এই প্রকল্পের কাজ পুরোপুরি শেষ হবে ২০১৬ সালে। তৃতীয়ঃ মেঘনা নদী। যা বরাক নদী নামে মণিপুর রাজ্য থেকে সিলেটের জকিগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে সুরমা-কুশিয়ারা নামে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। অতঃপর মেঘনা নাম নিয়ে চাঁদপুরের উপর দিয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের ছোট-বড় অন্যূন ২৩০টি নদীর প্রায় সবগুলি এ তিনটির সাথে কোন না কোনভাবে যুক্ত। এগুলির মধ্যে উপরোক্ত বড় তিনটি সহ মোট ৫৪টি এসেছে ভারত থেকে এবং আরও ৩টি এসেছে মায়ানমার থেকে। এভাবে সর্বমোট ৫৭টি নদী হ’ল আন্তর্জাতিক নদী। যার মধ্যে কেবল গঙ্গা নদীর ব্যাপারে ভারতের সঙ্গে ফারাক্কা চুক্তি আছে কাগজে-কলমে নামকাওয়াস্তে। বাকীগুলির ব্যাপারে ভারত বা মায়ানমার কারু সাথে বাংলাদেশের কোন চুক্তি নেই। বাংলাদেশ ভাটিতে হওয়ায় সুযোগ নিচ্ছে ভারত। সবক’টির উজানে সে বাঁধ দিয়েছে কথিত পানি সেচ ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের নামে। যেগুলির মধ্যে সর্বাপেক্ষা ক্ষতিকর হ’ল, গঙ্গায় ফারাক্কা (পশ্চিমবঙ্গ), তিস্তায় গজলডোবা (জলপাইগুড়ি), ব্রহ্মপুত্রে আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প ও বরাকে টিপাইমুখ বাঁধ (মণিপুর)। বাঁধ সন্নিহিত ভারতীয় এলাকা সমূহ মজে উঠেছে। ফলে সংশ্লিষ্ট ভারতীয় এলাকা ও বাংলাদেশ এখন ডুবছে ও শুকাচ্ছে ও নাকানি-চুবানি খাচ্ছে।

ইতিমধ্যে উত্তরবঙ্গে মরুকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। নদীতে পানির স্রোত ও চাপ কমে যাওয়ায় স্থলভাগে সমুদ্রের লোনা পানির প্রবেশ ঘটছে। ফলে মিঠাপানির উৎস শেষ হয়ে যাচ্ছে। মাটির নীচ থেকে পানির সাথে আর্সেনিক বিষ উপরে উঠে আসছে। ফসল ও মৎস্য সম্পদ ধ্বংস হ’তে চলেছে। বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের প্রাণবৈচিত্র শেষ হ’তে চলেছে। ভারতের এই প্রতিবেশগত আগ্রাসন অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের মানবগোষ্ঠী নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। ফারাক্কা বাঁধের ফলে বাংলাদেশ যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গ তেমনি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। টিপাইমুখ বাঁধের ফলে তেমনি মণিপুর রাজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে। নিজ দেশের ক্ষতি করেও তারা এ আত্মঘাতি কাজ চালিয়ে যাচ্ছে জনগণের কল্যাণের নামে গুটিকয়েক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মুনাফাখোর পুঁুজিবাদী গোষ্ঠীর কপট স্বার্থ হাছিলের জন্য। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ প্রভৃতি পুঁজিবাদের বিশ্বমোড়লরা এসব প্রকল্পে অর্থ যোগান দিচ্ছে। যেমন ইতিপূর্বে ফারাক্কা বাঁধের সময় তারা দিয়েছিল। এর মধ্যে উভয় দেশের ভোটদাতা কোটি কোটি জনগণের কোন মঙ্গল নেই। আছে কেবলি ক্ষতি, বঞ্চনা আর সাক্ষাৎ ধ্বংসের যন্ত্রণা। এরপরেও নির্যাতিত মানবতা জেগে উঠবে কী?

সবচেয়ে বড় ক্ষতি যেটি দু’দেশের জন্য অপেক্ষা করছে, সেটি হ’ল ধ্বংসকারী ভূমিকম্প। যেসব বাঁধ তারা দিয়েছেন, তার ফলে নদীর স্রোত বাধাগ্রস্ত হয়ে ভূপৃষ্ঠে যে বিশাল বিশাল জলাধার সৃষ্টি হয়েছে, তার চাপে ভূতলের শিলাস্তরের উপর যে অস্বাভাবিক চাপের সৃষ্টি হয়, তাতে ভূমিকম্পের প্রবণতা বেড়ে যায়। জলাধার প্রভাবিত ভূমিকম্পের বিষয়টি প্রথম নযরে আসে ১৯৩২ সালে আলজেরিয়ার কুয়েড বাড্ডা বাঁধের ক্ষেত্রে। আর এযাবতকালে বিশ্বের সবচেয়ে তীব্র মাত্রার জলাধার প্রভাবিত ভূমিকম্প হয়েছে খোদ ভারতের মহারাষ্ট্রের কয়না বাঁধের কারণে ১৯৬৭ সালের ১১ই ডিসেম্বর তারিখে। ৬.৩ মাত্রার এই ভূমিকম্পটি তার কেন্দ্র থেকে ২৩০ কিঃমিঃ দূরেও তীব্র আঘাত হেনেছিল।

এসব জেনেশুনেও ভারত তার নিজ রাজ্য মণিপুরের যে স্থানে বরাক নদীর উপর টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ করছে, সেটি হ’ল পৃথিবীর ৬টি ভয়ংকর ভূমিকম্প প্রবণ এলাকার মধ্যে একটি। বাকী পাঁচটি হ’ল আমেরিকার ক্যালিফোর্ণিয়া, মেক্সিকো, জাপান, তুরস্ক ও তাইওয়ান। টিপাইমুখ বাঁধের ১০০ থেকে ২০০ কিঃমিঃ ব্যাসার্ধ্বের মধ্যে ১০০ থেকে ২০০ বছরের মধ্যে ৫ মাত্রা বা তার বেশী মাত্রায় ভূমিকম্প হয়েছে ১০০টিরও বেশী এবং ৭-এর বেশী মাত্রার হয়েছে দু’টি। তার মধ্যে একটিতো হয়েছে গত ১৯৫৭ সালে টিপাইমুখ থেকে মাত্র ৭৫ কিঃমিঃ দূরে। ভারত ও মায়ানমারের টেকটোনিক প্লেটের সংঘর্ষের জন্য এলাকাটি দুনিয়ার অন্যতম ভূমিকম্প প্রবণ এলাকা। কাজেই এরকম একটি এলাকায় ১৬৮.২ মিটার উচ্চতার একটি জলাধার নির্মাণ করা মানে বাংলাদেশ ও ভারতের পুরা এলাকার জন্য সেধে ঘন ঘন ভূমিকম্প ডেকে আনা। আর তাতে উভয় দেশের সর্বনাশ হয়ে যাবে।

পাকিস্তান সরকারের বিরোধিতার মুখে ভারত বাঁধ নির্মাণ করতে বা চালু করতে পারেনি। কিন্তু বাংলাদেশী শাসকদের নতজানু নীতির কারণে তারা একে একে বাঁধ দিয়েই চলেছে। টিপাইমুখ এখন সর্বশেষ বাঁধ, যার ভিত্তি দিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ডঃ মনমোহন সিং ২০০৬ সালের ১৬ই ডিসেম্বর এবং যা শেষ হবে ২০১১ সালে। এখন উভয় দেশের সচেতন জনগণের ঐক্যবদ্ধ চেতনাই পারে দেশী ও বিদেশী শোষকদের পরিকল্পিত শোষণ ও ধ্বংসের হাত থেকে দেশ ও জাতিকে রক্ষা করতে। মনে রাখতে হবে যে, নদী আল্লাহর দান। এটা কোন রাজা-মহারাজা বা সরকার প্রধানের দান-অনুদান নয়। আল্লাহর দেওয়া সূর্যের কিরণ, চন্দ্রের আলো, বায়ুর প্রবাহ ভোগের অধিকার যেমন সবার জন্য সমান, আল্লাহর সৃষ্ট নদীর পানি ভোগের অধিকার তেমনি সকলের জন্য সমান। তাই যেকোন মূল্যে আন্তর্জাতিক নদীগুলির স্রোত অব্যাহত রাখতে হবে। দেহের শিরা-উপশিরায় ব্লক হ’লে যেমন রক্তের স্রোত বন্ধ হয় ও তাতে চাপ সৃষ্টি হয়ে মানুষ মারা যায়, নদীতে বাঁধ দিলে তেমনি পানির স্রোত বন্ধ হয়ে পানির উত্থান-পতনে দেশ ধ্বংস হয়। তাই রাষ্ট্রের সীমানা দিয়ে পানির সীমানা বেঁধে দেওয়া যাবে না। এখানে-ওখানে বাঁধ দিয়ে নদী-মহানদীগুলিকে হরদ ও পুকুরে পরিণত করা যাবে না। ধর্ম-বর্ণ-ভাষা ও অঞ্চল নির্বিশেষে এই অন্যায় ও অমানবিক ক্রিয়া-কর্মের বিরুদ্ধে জাগ্রত বিবেকের শাণিত উত্থান চাই। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন- আমীন![1]


[1]. ১২তম বর্ষ, ৯ম সংখ্যা, জুন ২০০৯।