বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হ’ল মাদ্রাসা শিক্ষা। দ্বীনী জ্ঞান, আখলাক ও সমাজসংস্কারে আমাদের দেশের মাদ্রাসাগুলো যুগ যুগ ধরে অসাধারণ অবদান রেখে আসছে। কিন্তু এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, মাদ্রাসাগুলো নীতি, পদ্ধতি, শিক্ষা কারিকুলাম, অবকাঠামোর আধুনিকায়ন এবং উন্নত ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে যথেষ্ট পিছিয়ে আছে। ফলে এদেশের প্রায় ৮০ লক্ষ কওমী মাদ্রাসা শিক্ষার্থীসহ আলিয়া মাদ্রাসায় পড়ুয়া আরো প্রায় অনুরূপ শিক্ষার্থীরা শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তুলনায় অনেকটাই পিছিয়ে আছে। সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হ’ল, এদেশে ৩০ সহস্রাধিক কওমী মাদ্রাসা থাকলেও এগুলো সরকারীভাবে কোন বিশেষ নিয়ম-নীতি ও জবাবদিহিতার আওতাধীন নয়। এদেশের জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থাপনায় তাদের কোন আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতিও নেই। যদিও ২০১৭ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী কওমী মাদ্রাসার সর্বোচ্চ স্তর ‘দাওরায়ে হাদীছ’ (তাকমীল)-কে মাস্টার্স ডিগ্রীর সমমান ঘোষণা করেন, যা ২০১৮ সালে আইন পাসের মাধ্যমে আইনী স্বীকৃতি লাভ করে। এই স্বীকৃতির ফলে কওমী শিক্ষার্থীরা ইসলামিক স্টাডিজ এবং আরবী বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রী লাভের একটা সুযোগ পান। তবে নিচের স্তরের মান না দিয়ে সরাসরি সর্বোচ্চ স্তরটির মান দেয়ায় এই সনদ কোন কাজে আসছে না। এ সমস্যা সমাধানে কওমী মাদ্রাসা শিক্ষা সনদের স্বীকৃতির জন্য ‘বাংলাদেশ কওমী মাদ্রাসা শিক্ষা কমিশন’ গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু পরে তা বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও কওমী শিক্ষার্থীরা উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে উচ্চতর ডিগ্রী নিতে পারছে না। এজন্য কওমী মাদ্রাসার নিচের স্তরগুলোর মান নির্ধারণ করাসহ জাতীয় মানে আসার জন্য বিশেষ কিছু আইনী পদক্ষেপ গ্রহণ করা অতীব যরূরী। সম্প্রতি মাদ্রাসা শিক্ষা সংস্কারে অন্তর্বতী সরকার বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নিয়েছে, যা খুবই প্রশংসনীয়। এ বিষয়ে আমাদের যরূরী কিছু পরামর্শ নিম্নরূপ।-
(১) কওমী ধারার বোর্ডগুলিকে ও তার সনদগুলিকে সরকারী স্বীকৃতি দিতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে আলিয়া মাদ্রাসার ন্যায় কওমী মাদ্রাসাগুলির ভৌত কাঠামো উন্নয়নে সরকারকে সাহায্য করতে হবে। পাকিস্তানে পাঁচটি কওমী বোর্ডকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছে এবং সরকারী শিক্ষা বোর্ডের সাথে মাদ্রাসার সনদকে ধাপে ধাপে সমন্বয় করা হয়েছে। এবতেদায়ী (প্রাথমিক) থেকে আলিমিয়াহ (মাস্টার্স) পর্যন্ত প্রতিটি স্তরকে সমমান নির্ধারণ করে মাদ্রাসার পাঠ্যক্রমে সরকার নির্দেশিত কিছু বিষয় ইংরেজী, গণিত, সমাজবিজ্ঞান প্রভৃতি যুক্ত করা হয়েছে। পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণে প্রতিটি বোর্ড স্বতন্ত্রভাবে কাজ করে। ফলে সেখানকার মাদ্রাসার ছাত্ররা সরাসরি বিশ্ববিদ্যালয়ে এমফিল, পিএইচডি করার সুযোগ পাচ্ছে। এছাড়া সিভিল সার্ভিস, বিদেশে উচ্চ শিক্ষা সবকিছুতেই তারা সুযোগ পাচ্ছে। অনুরূপ রয়েছে ইন্ডিয়াতেও। যেমন দিল্লী ইউনিভার্সিটি, আলীগড় ইউনিভার্সিটি, এলাহাবাদ ইউনিভার্সিটি প্রভৃতি। যেখানে কওমী মাদ্রাসার সনদসমূহ স্বীকৃত। সুতরাং বাংলাদেশের কওমী মাদ্রাসাগুলোতেও প্রচলিত ২ বছরের ছানাবিয়াকে ইন্টারমিডিয়েট, ৪ বছরের কুল্লিয়াকে বি.এ অনার্স (বাকালুরিউস) এবং ১ বছরের তাখাছ্ছুছ-কে এম.এ (মাজিসতীর) মান দেয়া যেতে পারে। এ ধরনের রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ নিলে কওমী ধারার শিক্ষার্থীরা শুধু দ্বীনী জ্ঞানার্জনে নয়, রাষ্ট্র ও সমাজের মূলধারাতে সরাসরি সম্পৃক্ত হ’তে পারবে। দক্ষতার পাশাপাশি তাদের সততা ও আমানতদারিতা থেকে উপকৃত হবে সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিটি সেক্টর।
(২) সরকারী সাহায্যপুষ্ট আলিয়া মাদ্রাসার ভৌত কাঠামোগত উন্নয়ন যথেষ্ট হ’লেও শিক্ষা ব্যবস্থায় এতটাই অচলাবস্থা বিরাজ করছে যে, আদতে সেখানে কোন লেখাপড়া নেই। শিক্ষক-কর্মচারীগণ বড় জোর হাযিরা প্রদানেই সীমাবদ্ধ থাকেন। খাতা-কলমে বহু শিক্ষার্থী দেখানো হ’লেও বাস্তবে তেমন কিছুই নেই। এই অবস্থা দূরীকরণে ছাত্র হাযিরার পার্সেন্টেজ ব্যবস্থা চালু করতে হবে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সকল প্রকার রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে। সেই সাথে সহশিক্ষা, বিভিন্ন দিবস পালন, ছবি টাঙানো, শহীদ মিনার স্থাপন, এ্যাসেম্বেলীর নামে জাতীয় পতাকার সম্মানে দাঁড়িয়ে জাতীয় সংগীত গাওয়া ইত্যাদি অনৈসলামী প্রথা বন্ধ করতে হবে।
(৩) শিক্ষার মানোন্নয়নে কারিকুলাম সংশোধনের কোন বিকল্প নেই। আলিয়া মাদ্রাসাগুলোতে জেনারেল শিক্ষার বোঝা অত্যধিক। এতে একদিকে ইসলামী জ্ঞান অসম্পূর্ণ থেকে যায়, অন্যদিকে সাধারণ শিক্ষা নিয়েও তারা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পরিমার্জন করে আলিয়া মাদ্রাসায় ইসলামী বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেওয়া এবং জেনারেল বিষয়গুলোকে যথাযথ ভারসাম্যের মধ্যে রাখা প্রয়োজন। নতুবা এখান থেকে যারা বের হচ্ছে, তারা অধিকাংশই হচ্ছে না ঘারকা, না ঘাটকা। বর্তমানে প্রায় ৪০% আরবী বিষয় এবং ৬০% জেনারেল বিষয় দিয়ে আলিয়া মাদ্রাসার কারিকুলাম সাজানো আছে। ফলে বিদ্যমান সিলেবাস ও কারিকুলামে আরবী ভাষা ও ইসলামী শিক্ষায় দক্ষতা কাঙ্খিত মানের হয় না। অথচ আরবী ভাষার দক্ষতা অর্জনের উপরেই নির্ভর করে দ্বীনের গভীর জ্ঞান অর্জন করা। এজন্য অন্তত ৭০% ধর্মীয় বিষয় ও ৩০% সাধারণ বিষয় হওয়া আবশ্যক, যার উদ্যোগ ইতিমধ্যেই গ্রহণ করা হয়েছে। ফালিল্লাহিল হামদ।
(৪) ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা হ’ল পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে বিশুদ্ধ আক্বীদার উপর প্রতিষ্ঠিত জীবনব্যবস্থা। প্রচলিত মাদ্রাসার কারিকুলামে এই দিকটি উপেক্ষা করায় দ্বীন ও সমাজ উভয় ক্ষেত্রেই ব্যাপক বিভ্রান্তি তৈরি হয়ে আছে। ফলে এদেশের অধিকাংশ শিক্ষার্থীর মধ্যে শিরক-বিদ‘আত সম্পর্কে ধারণা খুবই অস্পষ্ট। এ অবস্থার নিরসনকল্পে পাঠ্যপুস্তকসমূহ ছহীহ আক্বীদা ও মানহাজের ভিত্তিতে রচনা করা আবশ্যক।
(৫) সর্বস্তরে যোগ্য শিক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে। এজন্য শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা অপরিহার্য। সেই সাথে শিক্ষকদের আক্বীদা ও আমল-আখলাক যাচাই করা আবশ্যক। সন্তান প্রতিপালনে প্রাথমিক ও সর্বপ্রধান দায়িত্ব অভিভাবকদের। তারা সন্তানকে যে পরিবেশে ও যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাখবেন, সন্তান সেভাবেই গড়ে উঠবে। প্রতিষ্ঠানের ইমারত কথা বলে না। কথা বলেন শিক্ষকগণ। অতএব যোগ্য ও আদর্শ শিক্ষক ব্যতীত আদর্শ শিক্ষার্থী গড়ে উঠতে পারে না।
আমাদের মনে রাখতে হবে যে, সংস্কার মানে মূল কাঠামো ধ্বংস করা নয়, বরং যুগোপযোগী করা। এজন্য মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদেরকে ইসলামের মৌলিক জ্ঞানে পারদর্শী হওয়ার সাথে সাথে তাদেরকে তথ্যপ্রযুক্তি, ভাষা, গবেষণা ও সমসাময়িক বিষয়ে দক্ষতা অর্জনের সুযোগ করে দিতে হবে। এতে একজন মাদ্রাসা শিক্ষার্থী বহুমুখী জ্ঞানে পারদর্শী হয়ে উঠবে। সেই সাথে রাষ্ট্র ও সমাজ পরিচালনায় একজন দক্ষ নাগরিক হিসাবে গড়ে উঠবে ইনশাআল্লাহ।
পরিশেষে বলব, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে বাংলাদেশে মাদ্রাসা শিক্ষা সংস্কারের যে সুযোগ এসেছে, তা দ্রুত গ্রহণ করা এবং এগিয়ে নেয়ার সময় এখনই। সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলগণ এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে এবং যতদ্রুত সম্ভব উপরোক্ত পরামর্শগুলো বিবেচনা করে কর্মপরিকল্পনা সাজালে মাদ্রাসা শিক্ষার সুদিন আবার ফিরে আসবে ইনশাআল্লাহ। সঠিক ইসলামী জ্ঞান ও আদর্শচর্চার সুযোগ পেলে মানুষ তাদের সন্তানদেরকে মাদ্রাসামুখী করার জন্য সচেষ্ট হবেন এবং মাদ্রাসা শিক্ষা নিয়ে তাদের মধ্যে যে নেতিবাচক ধারণাগুলো রয়েছে, তাও দূরীভূত হবে ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন।- আমীন! (স.স.)।