শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজনীতি নিষিদ্ধ করুন!

বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো আজ এক গুরুতর প্রশ্নের সম্মুখীন। যেমন এগুলি কি জ্ঞানের বাতিঘর, নাকি রাজনীতির আস্তানা? সাম্প্রতিক ডাকসু ও জাকসু নির্বাচন নিয়ে যে মাতামাতি হ’ল, পরস্পর কাদা ছোড়াছুড়ি হ’ল, যে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হ’ল- তাতে খুব স্বাভাবিকভাবেই এই প্রশ্নটি জোরেশোরে আসছে। অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের মত স্থানে অনেক বড় স্বপ্ন নিয়ে পাঠান, তখন তার উদ্দেশ্যই থাকে সন্তানকে জ্ঞান-গবেষণা এবং নৈতিক চরিত্র গঠনের মাধ্যমে আদর্শ সন্তান হিসাবে গড়ে তোলা। কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতা হ’ল, রাজনৈতিক সংঘাত আর ক্ষমতার লড়াই শিক্ষাঙ্গনকে দশকের পর দশক ধরে অস্থিতিশীল করে রেখেছে। নোংরা রাজনীতির বলি হয়ে প্রাণ হারিয়েছে কিংবা পথ হারিয়েছে অসংখ্য মেধাবী শিক্ষার্থী ও শিক্ষক। যে ক্লাসরুমে কেবল জ্ঞান ও আদর্শের চর্চা হওয়ার কথা, তা পরিণত হয়েছে রাজনৈতিক ক্ষমতার লড়াই আর স্বার্থদ্বন্দ্বের মঞ্চে। অথচ শিক্ষাঙ্গন যেকোন দৃষ্টিকোণ থেকেই ক্ষমতাচর্চার স্থান নয়; বরং স্রেফ জ্ঞান চর্চার স্থান। দেশের সুনাগরিক হিসাবে গড়ে ওঠার জন্য রাজনৈতিক সচেতনতা থাকা প্রয়োজন। কিন্তু সেজন্য রাজনৈতিক সন্ত্রাস কেন? কেন দেশের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তৈরী হবে ক্ষমতার জোর আর মাস্তানীর মাধ্যমে? প্রকৃত নেতৃত্ব তো তৈরী হয় শিক্ষা, নৈতিকতা ও দক্ষতার মাধ্যমে। রাজনীতি, সহিংসতা বা পেশীশক্তির মাধ্যমে নয়। নেতৃত্বের গুণাবলী শিক্ষার্থীরা অর্জন করবে জ্ঞানমূলক আয়োজন ও সামাজিক কার্যক্রমের মাধ্যমে। এগুলোই হবে ভবিষ্যতের সুস্থ সমাজ ও রাষ্ট্রের ভিত্তি। কোন লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি নয়।

দেশে যে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা আছে, শৃংখলা আছে, সেখানে কোন ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতি নেই। বরং শিক্ষক ও প্রশাসন সম্মিলিতভাবে শিক্ষার্থীদের প্রয়োজন পূরণে কাজ করে। সেখানে কোনো দেন-দরবার বা মিছিল-মিটিংয়ের প্রয়োজন হয় না। পারস্পরিক সহযোগিতা ও দায়িত্বশীলতার ভিত্তিতে সবকিছু পরিচালিত হয়। মেধার লালন ও উৎকর্ষ সাধন হয় সেখানে মূল লক্ষ্য। মেধার অপচয় নয়। এই ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলো প্রমাণ করে যে, শিক্ষার্থীদের প্রয়োজন পূরণ এবং তাদের নেতৃত্ব বিকাশের জন্য প্রচলিত ছাত্ররাজনীতির আদৌ প্রয়োজন নেই। বরং প্রশাসন যদি প্রয়োজন মনে করে, তবে অনুষদের সেরা মেধাবী শিক্ষার্থীদের নিয়ে একটি ফোরাম গঠন করতে পারে, যারা শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্ব করবে। এতে শিক্ষার্থীরা ভোটমুখী না হয়ে মেধামুখী হবে এবং অস্ত্রবাজির পরিবর্তে উন্নত চরিত্র গঠনে মনোযোগী হবে।

অথচ ছাত্ররাজনীতির কারণে দেশের প্রধান প্রধান পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলির পরিবেশ এতটাই শিক্ষাবিমুখ যে, সেখানে প্রবেশের পর শিক্ষার্থীরা সবকিছুর সাথে সম্পর্ক রাখলেও শিক্ষার সাথে সম্পর্ক হারিয়ে ফেলে। হারিয়ে ফেলে পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ। পড়ার টেবিল নয়, ক্যাম্পাস রাজনীতি, হল দখল আর অর্থহীন হৈচৈ করেই তাদের জীবন কাটে। অতএব, ঘটা করে নির্বাচনের আয়োজন নয়, বরং প্রচলিত ছাত্ররাজনীতিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে নিষিদ্ধ করাই সময়ের দাবি। এটি কেবল শিক্ষাঙ্গনের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনবে না, বরং জাতি গঠনে সত্যিকারের নেতৃত্ব বিকাশের পথও সুগম করবে। বর্তমান সরকারের জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারমূলক পদক্ষেপ হবে ইনশাআল্লাহ।

অন্যদিকে বর্তমানে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামী ছাত্র সংগঠনের বিজয়কে অনেকে ইসলামের বিজয় কিংবা দ্বীন প্রচারের বড় সুযোগ হিসাবে দেখছেন। আমরা বলব, গণতান্ত্রিক রাজনীতি কখনই ইসলাম প্রচারের জন্য সহায়ক নয়, বরং আদর্শহীনতার পথপ্রদর্শক। কারণ ধর্মনিরপেক্ষতাবাদকে সাথে নিয়ে চলতে হয় বলে এর সাথে জড়িত হয়ে কখনও ইক্বামতে দ্বীন তথা তাওহীদ প্রতিষ্ঠার কথা বলা যায় না। এর সাথে আপোষ করে ক্ষমতার রঙ্গমঞ্চে টিকে থাকার জন্য ইসলামের মৌলিক বহু আদর্শকে বিসর্জন দিয়ে টিকে থাকতে হয়। অথচ দ্বীন প্রতিষ্ঠাই একজন মুসলমানের সামাজিক দায়িত্ব, যা কখনও ক্ষমতার লড়াইয়ের মাধ্যমে অর্জন করা সম্ভব নয়। যে তথাকথিত ওয়েলফেয়ার স্টেটে ইসলামের গুরুত্ব নেই, আল্লাহর সার্বভৌমত্ব নেই, অহি-র বিধানের সর্বোচ্চ স্থান নেই, সেই রাষ্ট্রের জনগণ সবাই মুসলিম হলেও ইসলামের কিছুই যায় আসে না। সমাজেও প্রকৃতপক্ষে কখনও শান্তি প্রতিষ্ঠিত হ’তে পারে না। ইসলামে সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘুর কোন ভেদাভেদ নেই। ইসলামী আদর্শের বিপরীতে জনসমর্থনেরও কোন গুরুত্ব নেই। বরং অহি-র অভ্রান্ত সত্য বিধানের পক্ষে যদি একজনও কথা বলেন, সেটাই হবে গ্রহণীয়। অধিকাংশের রায় নয় বরং আল্লাহর কালেমাই একমাত্র সত্য ও ন্যায় দ্বারা পূর্ণ।

মনে রাখতে হবে যে, ইসলাম ব্যতীত সমাজের জন্য চিরন্তন কল্যাণমূলক কোন ব্যবস্থা নেই। ইহকাল ও পরকালে কল্যাণ লাভ করা এবং প্রকৃত কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার জন্য ইসলামই একমাত্র পথপ্রদর্শক। আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান আনে ও সৎকর্মসমূহ সম্পাদন করে, আল্লাহ তাদের ওয়াদা দিয়েছেন যে, তিনি তাদেরকে অবশ্যই পৃথিবীতে শাসন ক্ষমতা প্রদান করবেন, যেমন তিনি দান করেছিলেন পূর্ববর্তীদেরকে। আর তিনি অবশ্যই সুদৃঢ় করবেন তাদের ধর্মকে যা তিনি তাদের জন্য মনোনীত করেছেন এবং তিনি অবশ্যই তাদের ভয়-ভীতিকে নিরাপত্তায় বদলে দিবেন। (শর্ত হ’ল) তারা কেবল আমারই ইবাদত করবে এবং আমার সাথে কাউকে শরীক করবে না। এরপরে যারা অবাধ্য হবে তারাই হবে পাপাচারী’। অতঃপর আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা ছালাত কায়েম কর, যাকাত আদায় কর এবং রাসূলের আনুগত্য কর। যাতে তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহ প্রাপ্ত হ’তে পার’ (নূর ২৪/৫৫-৫৬)

এই আয়াতগুলো স্পষ্ট করে দেয় যে, শাসনক্ষমতা, নিরাপত্তা ও প্রকৃত শান্তি লাভের শর্ত হ’ল- ঈমান, সৎকর্ম, শিরক থেকে মুক্ত থাকা এবং রাসূল (ছাঃ)-এর আনুগত্য করা। অতএব মুসলিম উম্মাহর করণীয় হ’ল নিজেদের ব্যক্তিগত জীবন, পারিবারিক জীবন ও সামাজিক জীবনকে বিশুদ্ধ ঈমান ও আমলের পথে পরিচালিত করা। আর এভাবেই কেবল প্রতিষ্ঠিত হ’তে পারে প্রকৃত কল্যাণ রাষ্ট্র, যা মানবজাতিকে দেবে ইহকালীন শান্তি ও পরকালীন মুক্তি। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দিন।-আমীন! (স.স.)