মুনাফিকের পরিচয় ও আলামত

আল্লাহ বলেন, الْمُنَافِقُوْنَ وَالْمُنَافِقَاتُ بَعْضُهُم مِّن بَعْضٍ يَأْمُرُوْنَ بِالْمُنكَرِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمَعْرُوْفِ وَيَقْبِضُوْنَ أَيْدِيَهُمْ نَسُوْا اللهَ فَنَسِيَهُمْ إِنَّ الْمُنَافِقِيْنَ هُمُ الْفَاسِقُوْنَ- ‘মুনাফিক পুরুষ ও নারী পরস্পরে সমান। তারা অসৎ কাজের আদেশ দেয় ও সৎকাজে নিষেধ করে এবং তাদের হাত সমূহ বন্ধ রাখে। তারা আল্লাহকে ভুলে গেছে। ফলে আল্লাহ তাদের ভুলে গেছেন। নিশ্চয় মুনাফিকরাই হ’ল পাপাচারী’ (তওবা-মাদানী ৯/৬৭)

মুমিনরা যেখানে ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়ের নিষেধ করে থাকে, সেখানে মুনাফিকরা তার বিপরীতে মানুষকে অন্যায় কথা ও কাজের আদেশ দেয় এবং ন্যায় কথা ও কাজ করতে নিষেধ করে। ‘তারা তাদের হাত সমূহ বন্ধ রাখে’ অর্থ তারা আল্লাহর পথে ব্যয় থেকে কৃপণতা করে।

নিফাক্ব মানব চরিত্রের এক নিকৃষ্ট, নিন্দনীয় এবং বিপজ্জনক স্বভাব। এটি মনের রোগ। এ ব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তি প্রতারণা, আমানতের খেয়ানত, মিথ্যা ও অঙ্গীকার ভঙ্গের মত মারাত্মক দোষে দুষ্ট থাকে। তাদের বাহ্যিক রূপ ও আভ্যন্তরীণ বিশ্বাস সম্পূর্ণ বিপরীত। বর্তমান সমাজকে যে ব্যাধিগুলো কুরে কুরে খাচ্ছে। বাহ্যিকভাবে মুনাফিক নিজেকে সৎ হিসাবে যাহির করলেও তার ভিতরে বিরাজ করে এক ঘৃণ্য মানসিকতা। ফলে তার সৎকর্মগুলো ধ্বংস হয়ে যায়। জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে হয় তার ঠিকানা (নিসা-মাদানী ৪/১৪৫)। এজন্য সালাফে ছালেহীন সর্বদা মুনাফিকী থেকে সতর্ক থাকতেন।

মুনাফিকের পরিচয়

আরবী ‘নিফাক্ব’ (نفاق) শব্দ থেকে ‘মুনাফিক্ব’ (منافق) শব্দটি উদ্ভূত। অধিক প্রচলনের কারণে বাংলায় নিফাক ও মুনাফিক বলা হয়। এর আভিধানিক অর্থ হ’ল কোন কিছুতে প্রবেশ করে অন্য দিক দিয়ে বের হয়ে যাওয়া, প্রতারণা করা, কপটতা। মুনাফিককে এজন্য মুনাফিক বলা হয় যে, সে তার কুফরী বিশ্বাসকে মনের মাঝে লুকিয়ে রাখে।[1] শারঈ পরিভাষায়, যে ব্যক্তি মুখে ঈমানের স্বীকারোক্তি করে কিন্তু হৃদয়ে কুফরী ও ইসলামবিদ্বেষ লুকিয়ে রাখে, তাকে মুনাফিক বলা হয়। ইবনু জুরাইজ বলেছেন, মুনাফিক সেই, যার কথা ও কাজ, গোপন ও প্রকাশ্য, ভিতর ও বাহির এবং বাহ্যিক ও অদৃশ্য পরস্পরের বিপরীত।[2]

নিফাক বা কপটতা দুই প্রকার :

(১) বিশ্বাসগত নিফাক (বড় মুনাফিকী) : এটি সবচেয়ে মারাত্মক। এ ধরনের মুনাফিকরা অন্তরে ইসলামকে পুরোপুরি অস্বীকার করে, কিন্তু বাহ্যিকভাবে মুসলমান সাজার ভান করে।

এরা চিরস্থায়ী জাহান্নামী (নিসা ৪/১৪০, ১৪৫)

হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেছেন, ‘এক শ্রেণীর যিনদীক্ব রয়েছে যারা বাহ্যিকভাবে ইসলাম ও রাসূলগণের অনুসরণের কথা প্রকাশ করে এবং মনের মাঝে কুফর এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলগণের প্রতি শত্রুতা লুকিয়ে রাখে। এরাই মূলত মুনাফিক এবং এদেরই আবাসস্থল হবে জাহান্নামের নিম্নতম স্তরে’ (নিসা ৪/১৪৫)[3]

(২) কর্মগত নিফাক (ছোট মুনাফিকী) : এ ধরনের নিফাকে লিপ্ত ব্যক্তিরা অন্তরে ঈমান রাখলেও তাদের কাজে-কর্মে মুনাফিকদের বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠে, যেমন- মিথ্যা বলা, অঙ্গীকার ভঙ্গ করা, আমানতের খেয়ানত করা ইত্যাদি। এটি ব্যক্তিকে ইসলাম থেকে বের করে দেয় না, তবে এটি একটি গুরুতর পাপ।

আমলগত মুনাফিক জাহান্নামের চিরস্থায়ী অধিবাসী হবে না। বরং সে অন্য সকল কবীরা গুনাহগারদের কাতারভুক্ত। আল্লাহ চাইলে ক্ষমা করে তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন, আর চাইলে তার পাপের কারণে শাস্তি দিয়ে পরিশেষে জান্নাতের অধিবাসী করবেন।

মুনাফিকের আলামতসমূহ :

কুরআন ও সুন্নাহর বিভিন্ন স্থানে মুনাফিকদের প্রসঙ্গ এসেছে। সেখানে মুনাফিকদের স্বভাব-চরিত্র বা আলামতসমূহ তুলে ধরা হয়েছে এবং মুমিনদেরকে তাদের থেকে সাবধান করা হয়েছে। এমনকি মুনাফিকদের নিয়ে আল্লাহ তা‘আলা স্বতন্ত্র একটি সূরাই (মুনাফিকূন) নাযিল করেছেন। নিম্নে তাদের কিছু বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হ’ল।-

১. মিথ্যা বলা, অঙ্গীকার ভঙ্গ করা, আমানতের খেয়ানত করা এবং ঝগড়াকালে বাজে কথা বলা :

এ ৪টি চরিত্র মুনাফিকের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ এবং সুস্পষ্ট আলামত। আব্দুল্লাহ বিন আমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন,أَرْبَعٌ مَنْ كُنَّ فِيْهِ كَانَ مُنَافِقًا خَالِصًا، وَمَنْ كَانَتْ فِيْهِ خَصْلَةٌ مِنْهُنَّ كَانَتْ فِيْهِ خَصْلَةٌ مِنَ النِّفَاقِ حَتَّى يَدَعَهَا إِذَا حَدَّثَ كَذَبَ وَإِذَا عَاهَدَ غَدَرَ، وَإِذَا وَعَدَ أَخْلَفَ وَإِذَا خَاصَمَ فَجَرَ- ‘চারটি আচরণ যার মধ্যে থাকবে, সে নিরেট মুনাফিক বলে গণ্য হবে। আর যার মধ্যে সেগুলোর একটি আচরণ পাওয়া যাবে, যা পরিহার না করা পর্যন্ত তার মধ্যে মুনাফিকীর একটি আচরণ বিদ্যমান থাকবে। (১) যখন সে কথা বলে, মিথ্যা বলে। (২) যখন অঙ্গীকার করে, তা ভঙ্গ করে। (৩) যখন সে প্রতিশ্রুতি দেয়, তা অমান্য করে। (৪) যখন সে বিতন্ডা করে, বাজে কথা বলে’।[4]

এই ৪টি বৈশিষ্ট্য যার মধ্যে একত্রিত হয়, সে সুস্পষ্ট মুনাফিক হিসাবে পরিগণিত হয়, যদিও সে ছালাত-ছিয়াম পালন করে এবং নিজেকে মুসলমান বলে দাবী করে।

২. আল্লাহর আয়াত সমূহে ঠাট্টা করা :

মুনাফিকরা আল্লাহর আয়াত তথা কথা ও বিধিবিধান সমূহ নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে। তাদের এ আচরণের সমালোচনা করে আল্লাহ বলেন,يَحْذَرُ الْمُنَافِقُوْنَ أَنْ تُنَزَّلَ عَلَيْهِمْ سُوْرَةٌ تُنَبِّئُهُمْ بِمَا فِيْ قُلُوْبِهِمْ قُلِ اسْتَهْزِئُوْا إِنَّ اللهَ مُخْرِجٌ مَّا تَحْذَرُوْنَ- ‘মুনাফিকরা ভয় করে যে, মুসলমানদের উপর না জানি এমন কোন সূরা নাযিল হয়ে যায় যা তাদের অন্তরের কথাগুলি ওদেরকে জানিয়ে দেয়। বলে দাও, তোমরা উপহাস করতে থাক। নিশ্চয়ই আল্লাহ সেই সব বিষয় প্রকাশ করে দিবেন, যেসব বিষয়ে তোমরা ভয় করছ’ (তওবা-মাদানী ৯/৬৪)

৩. মুমিনদের সাথে ঠাট্টা করা :

আল্লাহ বলেন,وَإِذَا لَقُواْ الَّذِيْنَ آمَنُواْ قَالُواْ آمَنَّا وَإِذَا خَلَوْا إِلَى شَيَاطِيْنِهِمْ قَالُواْ إِنَّا مَعَكُمْ إِنَّمَا نَحْنُ مُسْتَهْزِئُوْنَ، اللهُ يَسْتَهْزِئُ بِهِمْ وَيَمُدُّهُمْ فِيْ طُغْيَانِهِمْ يَعْمَهُوْنَ- ‘তারা যখন ঈমানদারদের সাথে সাক্ষাৎ করে তখন বলে, আমরা ঈমান এনেছি, আবার যখন তাদের দুষ্টু নেতাদের সঙ্গে একান্তে মিলিত হয় তখন বলে, আমরা তোমাদের সঙ্গেই আছি। আমরা তো ওদের সাথে উপহাস করি মাত্র। বরং আল্লাহ তাদের উপহাসের বদলা নেন এবং তাদেরকে তাদের অবাধ্যতার মধ্যে ছেড়ে দেন বিভ্রান্ত অবস্থায়’ (বাক্বারাহ-মাদানী ২/১৪-১৫)

ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, মুনাফিকরা প্রত্যেকেই দ্বিমুখী আচরণকারী। এক মুখে তারা মুমিনদের সাথে মিলিত হয়। অন্য মুখে তারা ভোল পাল্টিয়ে তাদের কাফের ভাইদের সাথে মিলিত হয়। তাদের জিহবাও দু’টো। এক জিহবা দিয়ে তারা মুসলমানদের সাথে উপর উপর কথা বলে, আর অন্য জিহবা তাদের গোপন অবস্থার ভাষ্যকার।[5]

৪. কাফেরদের সাথে সম্প্রীতি বজায় রাখা :

মুনাফিকদের সখ্যতা ও সম্প্রীতি মুমিনদের সাথে নয় বরং কাফেরদের সাথে। কাফেরদের সাথে তাদের এই দহরম মহরমের জন্য আল্লাহ বলেন,بَشِّرِ الْمُنَافِقِيْنَ بِأَنَّ لَهُمْ عَذَاباً أَلِيْماً- الَّذِيْنَ يَتَّخِذُوْنَ الْكَافِرِيْنَ أَوْلِيَاءَ مِنْ دُوْنِ الْمُؤْمِنِيْنَ أَيَبْتَغُوْنَ عِندَهُمُ الْعِزَّةَ فَإِنَّ العِزَّةَ لِلّهِ جَمِيْعاً- ‘তুমি মুনাফিকদের সুসংবাদ দাও যে, তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি’। ‘যারা মুমিনদের ছেড়ে কাফেরদের বন্ধুরূপে গ্রহণ করে, তারা কি তাদের কাছে সম্মান কামনা করে? অথচ সকল সম্মান কেবল আল্লাহরই জন্য’ (নিসা ৪/১৩৮-১৩৯)

এখানে আল্লাহ তাঁর নবীকে লক্ষ্য করে বলেছেন, হে রাসূল! যারা আমার সাথে কুফরী করে এবং আমার দ্বীনের মধ্যে যারা নাস্তিকতার বীজ বপন করে মুমিনদের বাদ দিয়ে, তাদের সাথে যারা বন্ধুত্ব করে তারা মুনাফিক। এই মুনাফিকদের তুমি কঠিন শাস্তির সুসংবাদ দাও।[6]

৫. ছালাতে অলসতা ও ছালাতকে বোঝা মনে করা :

মুনাফিকরা ইবাদতে, বিশেষ করে ছালাত আদায়ে অত্যন্ত অলস্য প্রদর্শন করে। তারা কেবল লোক দেখানোর জন্য ছালাত আদায় করে।

আল্লাহ বলেন,إِنَّ الْمُنَافِقِينَ يُخَادِعُونَ اللهَ وَهُوَ خَادِعُهُمْ وَإِذَا قَامُوا إِلَى الصَّلَاةِ قَامُوا كُسَالَى يُرَاءُونَ النَّاسَ وَلَا يَذْكُرُونَ اللهَ إِلَّا قَلِيلًا- ‘নিশ্চয়ই মুনাফিকরা আল্লাহর সাথে প্রতারণা করে। আর তিনিও তাদের বদলা নেন। যখন তারা ছালাতে দাঁড়ায়, তখন অলসভাবে দাঁড়ায়। তারা লোকদের দেখায় এবং আল্লাহকে খুব কমই স্মরণ করে’ (নিসা-মাদানী ৪/১৪২)

নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন,لَيْسَ صَلاَةٌ أَثْقَلَ عَلَى الْمُنَافِقِينَ مِنَ الْفَجْرِ وَالْعِشَاءِ ‘মুনাফিকদের উপর সবচেয়ে ভারী ছালাত হ’ল ফজর ও আছরের ছালাত’।[7]

৬. ছালাত বিলম্বিত করা :

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,تِلْكَ صَلاَةُ الْمُنَافِقِ يَجْلِسُ يَرْقُبُ الشَّمْسَ حَتَّى إِذَا كَانَتْ بَيْنَ قَرْنَىِ الشَّيْطَانِ قَامَ فَنَقَرَ أَرْبَعًا لاَ يَذْكُرُ اللهَ فِيْهَا إِلاَّ قَلِيْلاً- ‘মুনাফিকের ছালাত হ’ল, যে বসে বসে সূর্য ডোবার অপেক্ষা করে। অতঃপর সূর্য যখন শয়তানের দুই শিঙের মাঝ বরাবর হয় অর্থাৎ একেবারে ডুবে যাবার উপক্রম হয় তখন চারটা ঠোকর মারে (অতি দ্রুত চার রাক‘আত আছর পড়ে)। তাতে সে আল্লাহকে নামমাত্র স্মরণ করে’।[8]

ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেছেন, তারা ছালাতকে আউয়াল ওয়াক্ত থেকে বিলম্বিত করে মরণাপন্ন ব্যক্তির দম বন্ধ হওয়ার উপক্রমের মুহূর্তে (একেবারে শেষ মুহূর্তে) আদায় করে। ফজর আদায় করে সূর্যোদয়ের মুহূর্তে এবং আছর আদায় করে সূর্যাস্তের সময়ে। কাক যেমন ঠোকর মারে তারাও তেমনি (সিজদার নামে) ঠোকর মারে। তা দৈহিকভাবে ছালাত হ’লেও আন্তরিকতাপূর্ণ ছালাত নয়। এ ছালাত আদায়কালে তারা শিয়ালের মত এদিক-ওদিক তাকাতে থাকে। কেননা তাদের বিশ্বাস হয়, এভাবে ছালাত আদায়ের জন্য তাদের তাড়িয়ে দেওয়া হ’তে পারে এবং কৈফিয়তের জন্য তলব করা হ’তে পারে।[9]

৭. ছালাতের জামা‘আতে শরীক না হওয়া :

জামা‘আত থেকে বিরত থাকাও মুনাফিকীর একটি লক্ষণ। আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, وَلَقَدْ رَأَيْتُنَا وَمَا يَتَخَلَّفُ عَنْهَا إِلاَّ مُنَافِقٌ مَعْلُومُ النِّفَاقِ وَلَقَدْ كَانَ الرَّجُلُ يُؤْتَى بِهِ يُهَادَى بَيْنَ الرَّجُلَيْنِ حَتَّى يُقَامَ فِى الصَّفِّ ‘নিশ্চয়ই আমি আমাদের মধ্যে দেখেছি যার মুনাফিকী সুবিদিত এমন লোক ছাড়া ছালাতের জামা‘আত থেকে কেউ পিছিয়ে থাকত না। এমনকি হাঁটতে পারে না এমন লোককেও দু’জনের কাঁধে ভর দিয়ে (মসজিদে এনে) লাইনের মাঝে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হ’ত’।[10]

৮. অহংকার প্রদর্শন :

মুনাফিকরা অহংকারী হয়ে থাকে। আল্লাহ বলেন,وَإِذَا قِيْلَ لَهُمْ تَعَالَوْا يَسْتَغْفِرْ لَكُمْ رَسُوْلُ اللهِ لَوَّوْا رُؤُوْسَهُمْ وَرَأَيْتَهُمْ يَصُدُّوْنَ وَهُم مُّسْتَكْبِرُوْنَ- ‘যখন তাদের বলা হয়, তোমরা এস আল্লাহর রাসূল তোমাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করবেন। তখন তারা মাথা ঘুরিয়ে নেয়। আর তুমি তাদের দেখবে, তারা দম্ভভরে মুখ ফিরিয়ে চলে যায়’ (মুনাফিকূন ৬৩/৫)

৯. দোদুল্যমান মনোভাব :

আল্লাহ তা‘আলা বলেন, مُذَبْذَبِيْنَ بَيْنَ ذَلِكَ لاَ إِلَى هَـؤُلاء وَلاَ إِلَى هَـؤُلاَءِ ‘এরা দোদুল্যমান অবস্থায় রয়েছে। না ওরা মুমিনদের দিকে, না ওরা কাফেরদের দিকে’ (নিসা ৪/১৪৩)

অত্র আয়াতের মর্মার্থ হ’ল, মুনাফিকরা তাদের দ্বীন সম্পর্কে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। তারা কোন বিশ্বাসেই স্থির হ’তে পারে না। না তারা মুমিনদের সাথে জাগ্রত জ্ঞানের উপর আছে, না কাফেরদের সাথে অজ্ঞতার উপর আছে। তারা বরং দুইয়ের মাঝে অস্থিরমতি হয়ে বিরাজ করছে।[11] ইবনু ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন,مَثَلُ الْمُنَافِقِ كَمَثَلِ الشَّاةِ الْعَائِرَةِ بَيْنَ الْغَنَمَيْنِ تَعِيرُ إِلَى هَذِهِ مَرَّةً وَإِلَى هَذِهِ مَرَّةً- ‘মুনাফিকের উদাহরণ দু’টি পাঁঠার মাঝে একটি গরম হওয়া বকরির মত। সে একবার এটার কাছে যায়, আরেকবার অন্যটার কাছে যায়’।[12]

১০. মুমিনদের সাথে ধোঁকাবাজি :

আল্লাহ বলেন,يُخَادِعُوْنَ اللهَ وَالَّذِيْنَ آمَنُوْا وَمَا يَخْدَعُوْنَ إِلاَّ أَنفُسَهُمْ وَمَا يَشْعُرُوْنَ- ‘তারা আল্লাহ ও ঈমানদারগণের সাথে প্রতারণা করে। অথচ এর মাধ্যমে তারা কেবল নিজেদের সাথেই প্রতারণা করে। কিন্তু তারা তা বুঝতে পারেনা’ (বাক্বারাহ ২/৯)

মুনাফিকদের তাদের রব ও মুমিনদের সাথে ধোঁকাবাজি এই যে, তারা মুখে কালেমা উচ্চারণ করে এবং আল্লাহকে বিশ্বাসের কথা বলে। কিন্তু অন্তরে আল্লাহর প্রতি সন্দেহ ও অবিশ্বাস লুকিয়ে রাখে। সরাসরি আল্লাহকে অস্বীকার করলে তার বিধান মৃত্যুদন্ড অথবা বন্দীত্ব। এই উভয় শাস্তি থেকে দুনিয়াতে নিজেদের বাঁচানোর জন্য তারা মুখে ঈমান যাহির করে এবং অন্তরে কুফর লুকিয়ে রেখে আল্লাহ ও আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসীদের ধোঁকা দিতে চেষ্টা করে।[13]

১১. তারা যা করেনি তার জন্যও প্রশংসা কামনা করে :

আল্লাহ বলেন,لاَ تَحْسَبَنَّ الَّذِيْنَ يَفْرَحُوْنَ بِمَا أَتَوْا وَّيُحِبُّوْنَ أَن يُحْمَدُوْا بِمَا لَمْ يَفْعَلُوْا فَلاَ تَحْسَبَنَّهُمْ بِمَفَازَةٍ مِّنَ الْعَذَابِ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيْمٌ- ‘যেসব লোকেরা তাদের কৃতকর্মে খুশী হয় এবং তারা যা করেনি, এমন কাজে প্রশংসা পেতে চায়, তুমি ভেব না যে, তারা শাস্তি থেকে বেঁচে যাবে। বস্ত্তত তাদের জন্য রয়েছে মর্মান্তিক আযাব’ (আলে ইমরান ৩/১৮৮)

আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর যুগে মুনাফিকদের কিছু লোক ছিল, যারা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন কোন যুদ্ধে বের হ’তেন, তখন তাঁর সাথে অংশ না নিয়ে পিছনে থেকে যেত। তারা এভাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে না যাওয়ায় আনন্দ প্রকাশ করত। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) যখন মদীনায় ফিরে আসতেন তখন তারা তাঁর সামনে নানা অজুহাত পেশ করত। তারা এসব অজুহাতের জন্য আল্লাহর নামে কসমও করত। সেই সঙ্গে তারা যে কাজ করেনি, সেই কাজ করেছে মর্মে তাদের প্রশংসা করা হ’লে তারা খুব খুশি হ’ত এবং এরূপ কাজ না করেও প্রশংসা পেতে তারা খুবই উন্মুখ থাকত। এতদপ্রেক্ষিতে আল্লাহ উক্ত আয়াত অবতীর্ণ করেন।[14]

উপসংহার : মুনাফিকের আলামতগুলো জানা প্রত্যেক মুমিনের জন্য আবশ্যক। যেন সে একদিকে সমাজে বিদ্যমান মুনাফিকদের থেকে সতর্ক থাকতে পারে এবং অন্যদিকে নিজের অজান্তেও যেন এসব ধ্বংসাত্মক বৈশিষ্ট্য নিজের চরিত্রে ধারণ না করে। এই আলামতগুলো একটি আয়নার মতো, যা দিয়ে নিজের ঈমান ও আমলকে প্রতিনিয়ত যাচাই করা যায়। যদি নিজের মধ্যে এর কোন একটিরও উপস্থিতি টের পাওয়া যায়, তবে সঙ্গে সঙ্গে বিশুদ্ধ চিত্তে আল্লাহর নিকটে তওবা করা এবং নিজেকে সংশোধন করা অপরিহার্য।

يَا مُقَلِّبَ الْقُلُوْبِ ثَبِّتْ قَلْبِي عَلٰى دِيْنِكَ،

 اَللَّهُمَّ مُصَرِّفَ الْقُلُوْبِ صَرِّفْ قُلُوْبَنَا عَلٰى طَاعَتِكَ

\ হে হৃদয় সমূহের পরিবর্তনকারী! আমার হৃদয়কে তোমার দ্বীনের উপর দৃঢ় রাখো’। ‘হে অন্তর সমূহের আবর্তনকারী! আমাদের অন্তর সমূহকে তোমার আনুগত্যের দিকে ফিরিয়ে দাও \

হে আল্লাহ! আমাদের সবাইকে প্রকাশ্য ও গোপন সকল প্রকার মুনাফিকী থেকে রক্ষা কর।-আমীন!


[1]. ইবনু মানযূর, লিসানুল আরব ১০/৩৫৭; ইবনু ফারিস, মু‘জামু মাকায়িসিল লুগাহ ৫/৪৫৫।

[2]. ইবনু কাছীর, তাফসীরুল কুরআনিল আযীম ১/১৭৬।

[3]. মুহাম্মাদ বিন আবুবকর ইবনুল ক্বাইয়িম দিমাশক্বী (৬৯১-৭৫১ হি.), তরীকুল হিজরাতায়েন ওয়া বাবুস সা‘আদাতায়েন, পৃ. ৫৯৫।

[4]. বুখারী হা/৩৪; মুসলিম হা/৫৮।

[5]. মাদারিজুস সালিকীন ১/৩৫০।

[6]. জামি‘উল বায়ান ৯/৩১৯।

[7]. বুখারী হা/৬৫৭; মুসলিম হা/৬৫১; মিশকাত হা/৬২৯।

[8]. মুসলিম হা/৬২২; মিশকাত হা/৫৯৩; রাবী আনাস (রাঃ)।

[9]. মাদারিজুস সালিকীন ১/৩৫৪।

[10]. মুসলিম হা/৬৫৪; মিশকাত হা/১০৭২।

[11]. ঐ ৫/৩৩২।

[12]. মুসলিম হা/২৭৮৪; মিশকাত হা/৫৭।

[13]. জামি‘উল বায়ান ১/২৭২।

[14]. বুখারী হা/৪৫৬৭; মুসলিম হা/২৭৭৭।