গোরাবা কারা?

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, إِنَّ الْإِسْلاَمَ بَدَأَ غَرِيبًا وَسَيَعُودُ غَرِيبًا كَمَا بَدَأَ فَطُوبَى لِلْغُرَبَآءِ، قِيلَ : مَنْ هُمْ يَا رَسُولَ اللهِ؟ قَالَ : الَّذِينَ يُصْلِحُونَ إِذَا فَسَدَ النَّاسُ- ‘ইসলাম নিঃসঙ্গভাবে যাত্রা শুরু করেছিল। সত্বর সেই অবস্থায় ফিরে আসবে। অতএব সুসংবাদ হ’ল সেই অল্পসংখ্যক লোকদের জন্য। বলা হ’ল, হে আল্লাহর রাসূল! তারা কারা? তিনি বললেন, যখন মানুষ নষ্ট হয়ে যায়, তখন তাদেরকে যারা সংস্কার করে’।[1]

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এমন অনেক ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন, যা সর্বকালের মুসলমানদের জন্য পথনির্দেশক হিসেবে কাজ করে। উক্ত হাদীছটি এর মধ্যে গভীর অর্থবহ অন্যতম একটি বিখ্যাত হাদীছ। হাদীছটির মূল বার্তা হ’ল ইসলাম সর্বদা সত্য, ন্যায় ও বিশুদ্ধতার উপর প্রতিষ্ঠিত। যখনই সমাজে বিকৃতি, অধঃপতন ও পথভ্রষ্টতা ছড়িয়ে পড়ে, তখন ইসলামের প্রকৃত অনুসারীরা সংখ্যালঘু ও একঘরে হয়ে পড়েন। এটি একদিকে যেমন বিশুদ্ধতাবাদী মুসলমানদের জন্য একটি সতর্কবার্তা, তেমনই তাদের জন্য বড় সুসংবাদ।

উক্ত হাদীছের ব্যাখ্যায় ক্বাযী ইয়ায (রহ.) বলেন, ‘ইসলাম অল্প কিছু সংখ্যক ও নগণ্য মানুষ দ্বারা শুরু হয়েছিল, অতঃপর এর প্রসার ঘটে এবং এটি বিজয় লাভ করে। এরপর পুনরায় এর মধ্যে অবক্ষয় ও দুর্বলতা প্রবেশ করবে, এমনকি শেষ পর্যন্ত এটি অল্প কিছু ও নগণ্য সংখ্যক মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়বে, ঠিক যেমনটি এর সূচনা হয়েছিল।[2]

এই হাদীছের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হ’ল ‘গোরাবা’-দের পরিচয়। এখানে রাসূল (ছাঃ) গোরাবা বলতে কেবল এমন ব্যক্তিদের বুঝাননি, যিনি ব্যক্তিগতভাবে সৎ, নিষ্ঠাবান এবং আল্লাহর ইবাদত করেন। তার সততা ও ধার্মিকতা মূলত তার নিজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বরং মূলতঃ তাদেরকে বুঝিয়েছেন যারা নিজে সৎ হওয়ার পাশাপাশি সমাজে বা অন্য মানুষের মধ্যে কোনো ভুল, অন্যায় বা বিকৃতি দেখলে তা সংশোধনের জন্য উদগ্রীব থাকেন এবং সক্রিয়ভাবে কাজ করেন।[3] তার কর্মপ্রচেষ্টার মাধ্যমে সমাজকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেন।

এর কারণ, একটি সমাজ ততক্ষণ পর্যন্ত টিকে থাকে, যতক্ষণ সেখানে সংস্কার ও সংশোধনের কাজ চালু থাকে। শুধু ব্যক্তিগতভাবে ভালো থাকা সমাজের সুরক্ষার জন্য যথেষ্ট নয়।

সুতরাং এই হাদীছ অনুযায়ী শেষ যামানার সেই সর্বোচ্চ সৌভাগ্যবান ‘গোরাবা’ হবেন তারাই, যারা নিষ্ক্রিয় বা আত্মকেন্দ্রিক দ্বীনদার হবেন না। বরং সমাজের অধঃপতন দেখে তারা ব্যথিত হবেন এবং সংশোধনের জন্য এগিয়ে আসবেন। আপ্রাণ চেষ্টায় ব্রতী হবেন। তারা মানুষের আক্বীদা, আমল, আখলাক এবং সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের মধ্যে ঢুকে পড়া শিরক, বিদ‘আত, অন্যায় ও অশ্লীলতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেবেন এবং মানুষকে পুনরায় কুরআন ও সুন্নাহর দিকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবেন।

শায়েখ ওছায়মীন (রহঃ) বলেন, যিনি ছালেহ বা সৎকর্মশীল তিনি কেবল নিজেরই উপকার করেন। এটা অনেক ইবাদতকারীর মধ্যেই পাওয়া যায়। কিন্তু তারা অন্যকে সংশোধন করার চেষ্টা করেন না। তিনি চোখের সামনে মন্দ কাজ হতে দেখেও তা থেকে নিষেধ করেন না। আরেক প্রকার মানুষ আছেন, যারা নিজেরা সৎ এবং সংস্কারক। এটিই সর্বোত্তম প্রকার। তিনি নিজের জন্য সৎ এবং অন্যের জন্য সংস্কারক। এ কারণেই আল্লাহ বলেছেন, ‘আর তোমার প্রতিপালক এমন নন যে, সেখানকার অধিবাসীরা সংস্কারক হওয়া সত্ত্বেও জনপদ সমূহকে তিনি যুলুমবশে ধ্বংস করে দিবেন (হূদ ১১/১১৭)। এখানে তিনি কেবল ছালেহ বলেননি। বরং বলেছেন (সমাজকে ধ্বংস থেকে বাঁচাতে হ’লে) পৃথিবীতে অবশ্যই ‘মুছলেহ’ বা সংস্কারক থাকতে হবে।[4] 

সংস্কারকদের ‘গরীব’ বা ‘অপরিচিত’ সম্বোধনের কারণ :

সংস্কারকের কাজ কখনোই সহজ নয়। যখন সমাজের অধিকাংশ মানুষ কোনো ভুল বা অন্যায়ের উপর অভ্যস্ত হয়ে যায়, তখন যিনি তা সংশোধনের জন্য দাঁড়ান, তিনি বিভিন্ন বাধার সম্মুখীন হন। সংস্কারক যা বলেন তা সমাজের প্রচলিত প্রথা, বিশ্বাস ও স্বার্থের বিরুদ্ধে যায়। ফলে সমাজের প্রভাবশালীরা তার বিরোধিতা করে। সাধারণ মানুষ যারা ভুলের উপর জীবনযাপন করে অভ্যস্ত, তারাও সংস্কারককে বিভেদ সৃষ্টিকারী বা ফিৎনাবাজ বলে আখ্যা দেয়।

সর্বোপরি সংস্কারের এই কঠিন পথে খুব কম মানুষই তার সঙ্গী হয়। ফলে তিনি নিজের সমাজেই একঘরে ও বন্ধুহীন হয়ে পড়েন। আর এ কারণেই সংস্কারকের পুরস্কার এত বেশী। তাদের জন্যই রয়েছে জান্নাতের অফুরন্ত কল্যাণ ও আল্লাহর সন্তুষ্টির সুসংবাদ। ইবনুল ক্বাইয়িম (রহ.) বলেন, মানুষের মধ্যে এরূপ মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য হওয়ার কারণেই তাদেরকে গোরাবা বলা হয়। আর তাদের মধ্যে যারা (সুন্নাহর দিকে) আহবান করে এবং বিরোধীদের অত্যাচারে ধৈর্যধারণ করে, তারাই হ’’লন সবচেয়ে বেশী গোরাবা।[5]

পরিশেষে বলব, উক্ত হাদীছটি একজন সংস্কারকামী মুসলিমের জন্য একটি বড় অনুপ্রেরণা ও সান্তনার উৎস। এটি আমাদের শিক্ষা দেয় যে, শেষ যামানায় সমাজ যখন ফিতনা-ফাসাদে ছেয়ে যাবে, তখন একজন মুমিনের দায়িত্ব শুধু নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা নয়, বরং সাধ্যমতো সমাজকে বাঁচানোর চেষ্টা করা। এই হাদীছ আমাদেরকে আত্মকেন্দ্রিক দ্বীনদারিতার ফাঁদ থেকে বের হয়ে এসে সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ হতে শেখায়। ‘গোরাবা’ হওয়া মানে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া নয়, বরং সমাজের ভেতরে থেকেই সমাজের সংশোধনের জন্য সংগ্রাম করা, যদিও এই পথ একাকীত্বের ও কণ্টকাকীর্ণ। তারাই প্রকৃত অর্থে নবী-রাসূলদের উত্তরসূরী, যারা মানুষ পথ হারালে তাদের আলোর দিকে ডাকেন। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সেই সৌভাগ্যবান ‘গোরাবা’-দের অন্তর্ভুক্ত করুন। আমীন! [বিস্তারিত দ্রঃ লেখক প্রণীত ‘সমাজ পরিবর্তনের স্থায়ী কর্মসূচী’ বই]


[1]. ত্বাবারাণী ছগীর হা/২৯০, ছহীহাহ হা/১২৭৩। রাবী ইবনু মাসঊদ (রাঃ)।

[2]. নববী, শরহ মুসলিম হা/১৪৭-এর ব্যাখ্যা দ্রঃ।

[3]. ইবনু রজব হাম্বলী, কাশফুল কুরবাহ ফী ওয়াছফি আহলিল গুরবাহ পৃ. ৩২০

[4]. তাফসীরুল ওছায়মীন, সূরা মায়েদাহ ৬৪ আয়াতের ব্যাখ্যা।

[5]. ইবনুল ক্বাইয়িম, মাদারিজুস সালেকীন ৩/১৮৬।