সত্য-মিথ্যার মানদন্ড

বস্ত্তবাদী ধারণায় দুনিয়ার আদালতই হ’ল সত্য-মিথ্যার সর্বশেষ মানদন্ড। ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অজ্ঞ মানুষ যখন নিজেরা ভবিষ্যৎ কল্যাণের জন্য আইন রচনা করে, তখন সেখানে খুঁৎ থেকে যায়। তবুও সেটা সে করে নিজের অক্ষমতা ও আল্লাহর প্রতি অবাধ্যতাকে আড়াল করার জন্য। সে অজ্ঞ হয়েও নিজেকে বিজ্ঞ দাবী করে এবং মুখে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহকে স্বীকার করলেও এবং তাঁর বিধানের কল্যাণকারিতাকে ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় মেনে নিলেও অনীহ অন্তর তা মানতে চায় না। তাই সে বহু চিন্তা-ভাবনা করে আইন তৈরী করে। যাতে সে অন্যায় করেও অন্ততঃ নিজে বাঁচতে পারে। ফলে আইনের ফাঁক-ফোকর দিয়ে এবং আইনী ব্যাখ্যার আড়ালে দুর্নীতির রাঘব-বোয়ালরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে আদালত গলিয়ে বেরিয়ে যায় এবং আগের চেয়ে দাপটে বুক ফুলিয়ে দুর্নীতি করে। কিন্তু পরিস্থিতির কারণে অনেকে আটকে যায়। আবার অনেক নির্দোষ মানুষ নির্যাতনের শিকার হয়।

বর্তমানে ধর্মনিরপেক্ষতার মুখোশে বিভিন্ন দেশে সর্বোচচ আদালতের রায়ে কখনও কখনও চূড়ান্ত স্বেচ্ছাচারিতার খবর পাওয়া যাচ্ছে। সম্প্রতি এর একটা নযীর দেখা গেল গত ১০ই জানুয়ারী’১৭ ইউরোপীয় মানবাধিকার আদালতের রায়ের মাধ্যমে। আদালত স্কুলে ছেলেদের সাথে মেয়েদের বাধ্যতামূলকভাবে একত্রে সাঁতার প্রশিক্ষণের পক্ষে রায় দিয়েছে। সুইজারল্যান্ডের বাসেলের এক মুসলিম দম্পতি স্কুলে তাদের মেয়েদের বাধ্যতামূলকভাবে ছেলেদের সাথে সাঁতার প্রশিক্ষণের বিরোধিতা করে আদালতের শরনাপন্ন হন। কিন্তু আদালত তাদের আপত্তি খারিজ করে দেয়। বাদী দম্পতি তাদের আবেদনে বলেছিলেন যে, সহশিক্ষা তাদের মুসলিম ধর্মবিশ্বাসকে লংঘন করে। এর বিপরীতে আদালত তাদের রায়ে বলেছেন, পিতা-মাতার ইচ্ছার চেয়েও সামাজিক একীকরণের লক্ষ্য অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ। বিচারকগণ স্বীকার করেন যে, এ বিষয়ক আইন ধর্মের সাথে সাংঘর্ষিক। কিন্তু তা মানবাধিকার লংঘন করে না। তারা বলেন, এ আইন হচ্ছে বিদেশী ছাত্র-ছাত্রীদের সামাজিক বিচ্ছিন্নতা থেকে রক্ষা করার জন্য। আদালতের রায়ে বলা হয়, মুসলিম মেয়েদের অবশ্যই ছেলেদের সাথে সাঁতার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে হবে’।

জনৈক নিবন্ধকার ড. এইচ.এ. হেলিয়ার বলেন, এ রায়কে ইউরোপব্যাপী মুসলিম বিরোধী মনোভাব থেকে পৃথক করা কঠিন। স্মরণযোগ্য যে, সুইজারল্যান্ড হ’ল সেই দেশ, যেখানে ২০০৯ সালে মসজিদের মিনার বিষয়ে গণভোট অনুষ্ঠিত হয় (যদিও সেখানে মিনারের সংখ্যা বিরল) এবং তার ফলস্বরূপ সুইসরা মিনার নিষিদ্ধ করে। তবে সুইসদের এ ঘটনা দিয়ে সার্বিকভাবে বিচার করা যায় না। কেননা সাধারণভাবে তারা সহিষ্ণু জাতি এবং তারা বৈচিত্র্য অনুমোদন করে। ...বর্তমানে ইউরোপ এক ভীষণ চ্যালেঞ্জিং সময় পাড়ি দিচ্ছে। মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সকলকে তাই সর্বোত্তমভাবে এগিয়ে যাবার ব্যাপারে তৎপর হ’তে হবে। সর্বশেষ এই ঘটনা এক্ষেত্রে ভালো উদাহরণ নয়। তবে কেউ পসন্দ করুক বা না করুক, মুসলমানরা ইউরোপীয়’ (দৈঃ ইনকিলাব, ১৫ই জানু’১৭)

নিবন্ধকারের উপরোক্ত মন্তব্যে এটা পরিষ্কার যে, গণভোট বা আদালতের রায় কোনটাই চূড়ান্ত নয়। ইউরোপীয় মুসলিমদের নিকট আল্লাহর বিধানই চূড়ান্ত। তাই আদালতকেই ইসলামের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হবে। এর কোন বিকল্প নেই।

সর্বদা বলা হয়ে থাকে যে, আদালত যাবতীয় অনুরাগ ও বিরাগের ঊর্ধ্বে। তাহ’লে ইউরোপীয় মানবাধিকার আদালতের উপরোক্ত রায় কিসের ভিত্তিতে হ’ল? বাক, ব্যক্তি ও ধর্মীয় স্বাধীনতা একটি সর্বস্বীকৃত বিষয়। অথচ ইসলামের বেলায় এর ব্যত্যয় কেন? গত ২০শে জানুয়ারী শুক্রবার সদ্য দায়িত্ব গ্রহণকারী আমেরিকার নতুন প্রেসিডেণ্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প খ্রিষ্টানদের বিভিন্ন শাখা এবং ইহূদী ও মুসলিম সহ ২৬ জন ধর্মগুরুর বাণী শ্রবণের পর বাইবেলের উপর বাম হাত রেখে ডান হাত উঁচু করে প্রধান বিচারপতির নিকট শপথবাক্য পাঠ করেন। তাঁর স্ত্রী একটি ট্রেতে করে বাইবেল ধরে রাখেন। তার আগে ট্রাম্প ও তার স্ত্রী গির্জায় গিয়ে প্রার্থনা করেন। যদিও সেদেশের সংবিধানে সরকারী পদ গ্রহণের জন্য কোন ধর্মপালনের বিধান নেই, তবুও অধিকাংশ প্রেসিডেণ্ট গির্জায় যান। কারণ সে দেশের জনগণের ‘গড’ ও যীশু খ্রিষ্টে রয়েছে অবিচল আস্থা। তাদের ভাষায় ও তাদের ডলারে রয়েছে, ‘ইন গড উই ট্রাষ্ট’। সেদেশের কোন মিডিয়া এ নিয়ে কোন উচ্চবাচ্য করেনি। অথচ বাংলাদেশের কোন প্রেসিডেণ্ট যদি শপথ নেওয়ার আগে বায়তুল মুকাররমে গিয়ে দু’রাক‘আত নফল ছালাত আদায় করতেন এবং দেশের ধর্মনেতাদের সামনে প্রধান বিচারপতির নিকট আল্লাহর নামে শপথ বাক্য পাঠ করতেন, তাহ’লে এ দেশের কথিত বস্ত্তনিষ্ঠ মিডিয়া ও বিশিষ্ট নাগরিকেরা (?) তাকে ‘মৌলবাদী’ বলে তুলোধুনা করতেন। উল্লেখ্য যে, উক্ত অনুষ্ঠানে একমাত্র মুসলিম ইমাম মুহাম্মাদ আব্দুল মজীদ সূরা হুজুরাত ১৩ এবং সূরা রূম ২২ আয়াত পাঠ করেন। অতঃপর তা ইংরেজীতে অনুবাদ করে শুনান। ট্রাম্প গভীর মনোযোগে তা অনুধাবন করেন। বলা বাহুল্য, নতুন প্রেসিডেণ্টের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রার্থনা রীতি তাদের প্রথম প্রেসিডেণ্ট জর্জ ওয়াশিংটনের সময় থেকে বিগত ২৪০ বছর ধরে চলে আসছে।

২০০৯ সালে দিল্লী হাইকোর্ট সমকামিতা ও সমলিঙ্গের বিয়ের পক্ষে রায় দিয়েছিল ব্যক্তি স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে। ২০১৩ সালে সুপ্রীম কোর্ট উক্ত রায় বহাল রাখে। কিন্তু ২০১৪ সালে তা অবৈধ ঘোষণা করে। আমেরিকার সুপ্রীম কোর্ট ১৯৭৩ সালে গর্ভপাত এবং ২০১৫ সালে সমকামিতা বৈধতার পক্ষে রায় দেয় ব্যক্তি স্বাধীনতার অজুহাত দেখিয়ে। যা ধর্মের সাথে সাংঘর্ষিক। এটা কি ব্যক্তি স্বাধীনতা না স্বেচ্ছাচারিতা? স্বেচ্ছাচারিতা তো সর্বদা অন্যের ব্যক্তি স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ করে এবং তা কোন মূল্যবোধের তোয়াক্কা করে না। তাই দু’টি কখনো এক নয়। এক্ষণে কথিত ব্যক্তি স্বাধীনতাই যদি সর্বোচ্চ বিষয় হয়, তাহ’লে তো স্বেচ্ছাচারীরা পার পেয়ে যাবে। বাস্তবে হচ্ছেও তাই। তাহ’লে সত্য-মিথ্যার মানদন্ড কি? আইন-আদালত কিসের জন্য? সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা কি কারণে? বনের উলঙ্গ পশু আর সমাজের পোষাকপরা মানুষের মধ্যে ফারাক কিসের? ২০১০ সালে বাংলাদেশের উচ্চ আদালত থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহের প্রতি নির্দেশনা জারি করা হয়েছিল যেন কোন মেয়েকে হিজাব পরতে বাধ্য করা না হয়। দেশে এতকিছু অনাচার হচ্ছে আদালতের সেদিকে নযর নেই। অথচ হিজাব ও নিক্বাব যা মেয়েদের রক্ষাকবচ, সেদিকেই শ্যেনদৃষ্টি। কারণ তাদের মধ্যেও রয়েছে ইউরোপীয় আদালতের মত ইসলামের প্রতি বিরাগ ও বস্ত্তবাদের প্রতি অনুরাগ। তাহ’লে যারা ইসলামী বিধানকে সহ্য করতে পারেন না, তারা মুসলিম নাগরিকদের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবেন কিভাবে? জানা উচিত যে, ইসলামী বিধান কেবল মুসলিমের জন্য নয়, বরং বিশ্ব মানবতার জন্য আল্লাহ প্রেরিত সর্বশেষ ও চূড়ান্ত কল্যাণ বিধান। আর এটাই হ’ল সত্য-মিথ্যার চূড়ান্ত মানদন্ড। অতএব তার অনুসরণ ও বাস্তবায়নই হবে আদালতের প্রধান দায়িত্ব। নইলে আল্লাহর সর্বোচ্চ আদালতে তাদের কৈফিয়ত দিতে হবে। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দিন- আমীন! (স.স.)।