সংস্কৃতি দর্শন

মানুষের ভিতরকার অনুশীলিত কৃষ্টির বাহ্যিক পরিশীলিত রূপকে বলা হয় ‘সংস্কৃতি’। ‘সংস্কৃতি’ একটি ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ যা মানুষের সার্বিক জীবনাচারকে শামিল করে। কৃষ্টি ও সংস্কৃতি তাই অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। সংস্কৃতিবান মানুষকে চেনা যায় তার বাহ্যিক ব্যবহারে, পোষাকে ও আচরণে এবং তার সার্বিক জীবনাচারে। প্রত্যেক মানুষেরই খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থানের চাহিদা রয়েছে। এগুলি সংস্কৃতির বিষয়ভুক্ত নয়। কিন্তু এই মৌলিক চাহিদাগুলি পূরণ করার জন্য যে নিয়ম ও ধরন আমরা অনুসরণ করি এবং যে পন্থা ও পদ্ধতি আমরা গ্রহণ করি, সেটাই সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত। একজন ব্যক্তি শূকর-বিড়াল, ইঁদুর-কুকুর, কুচে-কচ্ছপ, ব্যাঙ, তেলাপোকা পুড়িয়ে মজা করে খায় ও অতিথিকে খাওয়ায়। আরেকজন ব্যক্তি এগুলো নিষিদ্ধ মনে করে বিরত থাকে এবং তার বদলে মুরগী-পাখি, গরু-খাসি আল্লাহর নামে যবেহ করে তেল-মশলা দিয়ে রান্না করে খায়। দু’জনের রুচি ও সংস্কৃতি পৃথক। একজন ব্যক্তি নদীর ময়লা ও ঘোলা পানিকে পবিত্র মনে করে সেখানে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে একত্রে পুণ্যস্নান করে পাপমুক্ত হয়। অন্যজন এটাকে অনর্থক কাজ ভেবে দূরে থাকে। একজন লোক একটি ডুবন্ত মানব শিশুকে বা ক্ষুধায় মৃতপ্রায় মানুষকে বাঁচানোর চাইতে একটি দুর্লভ ছবি, মূর্তি বা ভাষ্কর্যকে বাঁচানো বা খেলা ও খেলোয়াড়ের পিছনে খরচ করাকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। আরেকজন তার বিপরীত। একজন লোক নারী-পুরুষের বেপর্দা চলাফেরা ও ফ্রি সেক্সকে স্বাভাবিক বিষয় মনে করে। আরেকজন তার বিপরীত। এগুলি সাংস্কৃতিক পার্থক্যের নমুনা হিসাবে গণ্য হয়ে থাকে। ফলে মানুষের নিজস্ব ধ্যান-ধারণা ও আক্বীদা-বিশ্বাস, পারিবারিক ঐতিহ্য ও সামাজিক রসম-রেওয়াজ এবং রাষ্ট্রীয় বিধি-বিধান সবকিছুই সংস্কৃতির উপাদানে পরিণত হয়। সংস্কৃতি তাই একজন মানুষের, একটি পরিবারের ও সমাজের এবং একটি রাষ্ট্রের দর্পণ স্বরূপ।

এক্ষণে প্রশ্ন হ’ল, সংস্কৃতির দর্শন কী?  জবাব : সংস্কৃতির দর্শন হ’ল মানুষের স্বভাবধর্মের সুষ্ঠু বিকাশ সাধন। যে দর্শন উক্ত স্বভাব ধর্মের যথার্থ বিকাশে বাধা দেয় বা পথভ্রষ্ট করে, তা প্রকৃত অর্থে কোন সংস্কৃতি নয়।

এরপর প্রশ্ন হ’ল মানুষের স্বভাবধর্ম কী?  জবাব : মানুষের স্বভাবধর্ম হ’ল তার সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর প্রতি নিশ্চিন্ত বিশ্বাস ও তাঁর বিধানের প্রতি আনুগত্য করা। যেমন সন্তানের স্বভাবধর্ম হ’ল পিতা-মাতার প্রতি নিশ্চিন্ত বিশ্বাস ও তাঁদের প্রতি অটুট আনুগত্য বজায় রাখা। বস্ত্তত এটাই মানুষের ফিতরৎ বা স্বভাবধর্ম। মানুষের জন্ম ও মৃত্যু, তার শৈশব-কৈশোর, যৌবন-বার্ধক্য, তার খাদ্য-পানীয়, রোগ-শোক, উন্নতি-অবনতি, শান্তি-অশান্তি সবই তার সৃষ্টিকর্তার অমোঘ বিধান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। নাসা-র প্রেরিত রকেট মহাশূন্যে গিয়ে কতদিন থাকবে, কোথায় কি কাজ করবে সবই যেমন পৃথিবীর প্রেরণ কেন্দ্র থেকে নির্ধারিত হয়, তেমনি অদৃশ্য জগত থেকে প্রেরিত রূহ দুনিয়াতে এসে মানব দেহে কতদিন অবস্থান করবে, কোথায় কি কি কাজ করবে, কতটুকু রূযী সে পাবে, সে সৌভাগ্যবান হবে না হতভাগা হবে অর্থাৎ সে জান্নাতী হবে না জাহান্নামী হবে, সবই অদৃশ্য আসমানী কেন্দ্র থেকে পূর্বেই নির্ধারিত হয়। কিন্তু মানুষ কোন যন্ত্র নয়, তাকে দেওয়া হয়েছে মূল্যবান জ্ঞান-সম্পদ। যা দিয়ে সে স্বাধীনভাবে চিন্তা-গবেষণা করে। তার সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিরহস্য অনুধাবন করে ও আল্লাহর অতুলনীয় সৃষ্টিরাজি থেকে কল্যাণ আহরণ করে। আল্লাহ দেখেন তাঁর প্রেরিত অহি-র বিধান অনুযায়ী কাজ করে বান্দা পৃথিবীকে আবাদ করছে, নাকি নিজের খেয়াল-খুশীর শয়তানী বিধান মেনে কাজ করতে গিয়ে পৃথিবীতে ফাসাদ সৃষ্টি করছে। মূলতঃ এটাই হ’ল পৃথিবীতে বান্দার জন্য মূল পরীক্ষা। এই পরীক্ষা দিতে দিতে হঠাৎ এক সময় তার মৃত্যুঘণ্টা বেজে ওঠে। ফলে মুহূর্তের মধ্যেই তার রূহ দুনিয়ার পরীক্ষাগৃহ ছেড়ে সেখানে চলে যায়, যেখান থেকে সে প্রথম দুনিয়াতে এসেছিল মায়ের গর্ভে চার মাসের ছোট্ট দেহে। দুনিয়ার কোন শক্তিই তাকে আর ধরে রাখতে পারে না, যখন সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর ডাক আসে। কেননা সে তাঁর হুকুম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।

এর মধ্যে মানবীয় দর্শনের তিনটি দিক ফুটে ওঠে। (১) মানুষের একজন সৃষ্টিকর্তা আছেন (২) মানুষের কল্যাণের জন্য দুনিয়াতে আল্লাহর বিধান প্রেরিত হয় এবং (৩) মৃত্যুর পরে মানুষকে ফিরে যেতে হয় তার পূর্বের ঠিকানায়। প্রথমটিকে বলা হয় ‘তাওহীদ’। অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তা মাত্র একজন। যিনি পালনকর্তা, রূযীদাতা ও বিধানদাতা। দ্বিতীয়টিকে বলা হয় ‘রিসালাত’। অর্থাৎ আল্লাহ তাঁর নির্বাচিত নবী ও রাসূলগণের মাধ্যমে মানুষকে সঠিক পথ প্রদর্শনের জন্য বিধান সমূহ প্রেরণ করে থাকেন। তৃতীয়টিকে বলা হয় ‘আখেরাত’। যেখানে বান্দার সারা জীবনের কাজ-কর্মের হিসাব নেওয়া হয় ও সেমতে তার জন্য জান্নাত অথবা জাহান্নাম নির্ধারিত হয়। যে ব্যক্তির সার্বিক জীবন উপরোক্ত মানবীয় দর্শন দ্বারা পরিচালিত হবে, তার জীবন হবে সুনিয়ন্ত্রিত এবং তিনি হবেন সত্যিকারের সংস্কৃতিবান মানুষ। পক্ষান্তরে যার জীবন উপরোক্ত দর্শনের বাইরে পরিচালিত হবে, তার জীবন হবে অনিয়ন্ত্রিত এবং তিনি হবেন পথচ্যুত।

প্রথমোক্ত দর্শনের আলোকে যে সংস্কৃতি গড়ে ওঠে, তাকে বলা হয় ইসলামী সংস্কৃতি। যা বিশ্বমানবতাকে এক আল্লাহর সৃষ্টি ও এক আদমের সন্তান বলে গণ্য করে। ধর্ম-বর্ণ-ভাষা ও অঞ্চলের বৈষম্য তাকে মানবতার প্রতি উদার কর্তব্যবোধ থেকে বিরত রাখতে পারে না। এর বিনিময়ে সে কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি ও আখেরাতে মুক্তি কামনা করে। দুনিয়াকে সে আখেরাতের শস্যক্ষেত্র মনে করে।

অতঃপর শেষোক্ত দর্শনের আলোকে গড়ে ওঠা সংস্কৃতিকে বলা হয় সেক্যুলার বা বস্ত্তবাদী সংস্কৃতি। যা আসলে কোন সংস্কৃতিই নয় বরং বিকৃতি। এখানে বস্ত্তই হয় প্রধান। যেকোন মূল্যে বস্ত্ত অর্জন ও ভোগ করাই তার মূল লক্ষ্য হয়। মানুষ ও মানবতা তার নিকটে গৌণ হয়। বস্ত্ত লুট ও ভোগের জন্য সে মানুষ ও মানবতাকে ধ্বংস করতে আদৌ পিছপা হয় না। বিগত শতাব্দীর দু’দু’টি বিশ্বযুদ্ধ এবং বর্তমান শতাব্দীর ইরাক, আফগানিস্তান ও অন্যান্য দেশে চালানো ধ্বংসযজ্ঞ এবং বিশ্বের অধিকাংশ অঞ্চলে অশুভ শক্তিগুলির একচেটিয়া কর্পোরেট পুঁজির শোষণ ও নির্যাতন উপরোক্ত বস্ত্তবাদী দর্শনেরই বাস্তব ফলশ্রুতি মাত্র। ভূগর্ভের তৈল ও অন্যান্য সম্পদ লুট করার জন্য তারা মাটির নীচে-উপরে বোমা মেরে অথবা কৃত্রিম সংকট সমূহ সৃষ্টি করে নির্দয়ভাবে মানুষ হত্যা করে। অথচ মুখে সর্বদা মানবাধিকারের কথা বলে। বাহ্যিকভাবে কোন ধর্মানুসারী ব্যক্তিও স্বার্থান্ধ হয়ে বস্ত্তবাদী হ’তে পারে। যুগে যুগে তাবৎ মুশরিক-ফাসিক-মুনাফিকরা এই কাতারে পড়ে। যারা ধর্মকে স্রেফ কিছু আনুষ্ঠানিকতা মনে করে। এরা প্রকৃত অর্থে মানবীয় সংস্কৃতির ধারক ও অনুসারী নয়। তাই সার্বিক জীবনে আল্লাহর বিধানের সনিষ্ট অনুসারী ব্যক্তিই প্রকৃত অর্থে সংস্কৃতিবান। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন! আমীন!! (স.স)