পরীক্ষাতেই পুরস্কার

فَلَمَّا فَصَلَ طَالُوتُ بِالْجُنُودِ قَالَ إِنَّ اللهَ مُبْتَلِيكُمْ بِنَهَرٍ فَمَنْ شَرِبَ مِنْهُ فَلَيْسَ مِنِّي وَمَنْ لَمْ يَطْعَمْهُ فَإِنَّهُ مِنِّي إِلاَّ مَنِ اغْتَرَفَ غُرْفَةً بِيَدِهِ فَشَرِبُوا مِنْهُ إِلاَّ قَلِيلاً مِنْهُمْ فَلَمَّا جَاوَزَهُ هُوَ وَالَّذِينَ آمَنُوا مَعَهُ قَالُوا لاَ طَاقَةَ لَنَا الْيَوْمَ بِجَالُوتَ وَجُنُودِهِ قَالَ الَّذِينَ يَظُنُّونَ أَنَّهُمْ مُلَاقُو اللهِ كَمْ مِنْ فِئَةٍ قَلِيلَةٍ غَلَبَتْ فِئَةً كَثِيرَةً بِإِذْنِ اللهِ وَاللهُ مَعَ الصَّابِرِينَ- وَلَمَّا بَرَزُوا لِجَالُوتَ وَجُنُودِهِ قَالُوا رَبَّنَا أَفْرِغْ عَلَيْنَا صَبْرًا وَثَبِّتْ أَقْدَامَنَا وَانْصُرْنَا عَلَى الْقَوْمِ الْكَافِرِينَ-

অনুবাদ : ‘অতঃপর যখন তালূত তার সৈন্যদল নিয়ে বের হ’ল, তখন বলল, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে একটি নদী দ্বারা পরীক্ষা করবেন। অতঃপর যে ব্যক্তি সেখান থেকে পান করবে, সে আমার দলভুক্ত নয়। আর যে ব্যক্তি পানির স্বাদ নিবে না, সেই-ই আমার দলভুক্ত থাকবে। তবে যে মাত্র এক অঞ্জলী পানি পান করবে, সে ব্যতীত। অতঃপর অল্প সংখ্যক ছাড়া তারা সবাই সেখান থেকে (পেট ভরে) পানি পান করল। অতঃপর যখন সে (তালূত) ও তার সঙ্গী ঈমানদারগণ নদী অতিক্রম করে গেল, তখন তারা বলল, জালূত ও তার সেনাবাহিনীর মোকাবিলা করার মত শক্তি আজ আমাদের নেই। পক্ষান্তরে তাদের মধ্যে যারা দৃঢ়বিশ্বাস পোষণ করত যে, তারা আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করবে, তারা বলল, আল্লাহর হুকুমে কত ক্ষুদ্র দল কত বৃহৎ দলকে পরাজিত করেছে। আর আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথেই থাকেন’। ‘অতঃপর যখন তারা জালূত ও তার সেনাবাহিনীর মুখোমুখি হ’ল, তখন তারা প্রার্থনা করল, হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের উপর বিশেষ ছবর নাযিল করুন, আমাদের পদসমূহ দৃঢ় রাখুন এবং অবিশ্বাসী সম্প্রদায়ের উপর আমাদেরকে সাহায্য করুন!’ (বাক্বারাহ ২/২৪৯-৫০)

আয়াতের ব্যাখ্যা :

আলোচ্য আয়াতে মুমিন জীবনে ঈমানের পরীক্ষা দেওয়ার কথা একটি ঘটনার মাধ্যমে বর্ণিত হয়েছে। ঘটনাটি বনু ইস্রাঈল বংশের একটি গোত্রের। যাদের উপরে তাদের দুশমনরা বিজয়ী হয়েছিল ও যাদের জীবনে নেমে এসেছিল চরম দুঃখ ও দুর্গতি। তখন তারা আল্লাহর নিকটে একজন শাসক প্রার্থনা করল। যার পিছনে থেকে তারা জিহাদ করবে ও দুশমনের উপরে বিজয়ী হবে। অতঃপর যখন তাদের জন্য বাদশাহ পাঠানো হ’ল ও তাদেরকে জিহাদের নির্দেশ দেওয়া হ’ল, তখন তাদের অধিকাংশ পিছুটান দিল এবং স্বল্প সংখ্যক লোক দৃঢ়ভাবে টিকে থাকল। আল্লাহ তাদেরকে বিজয়ী করলেন (কুরতুবী)

ঘটনা :

প্রায় আড়াই হাযার বছর পূর্বে বর্তমান জর্ডান ও ফিলিস্তীনের মধ্যবর্তী নদীতে সত্য মুমিন ও কপট মুমিনের মধ্যে এই পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এই সময়কার নবী ছিলেন ‘শামভীল’ (شَمْوِيلُ) বা শ্যামূয়েল। মতান্তরে শাম‘ঊন বা সাম‘ঊন (سَمْعُونُ)। যিনি হারূণ (আঃ)-এর বংশধর ছিলেন (কুরতুবী)। ওয়াহাব বিন মুনাবিবহ প্রমুখ বিদ্বান বলেন, মূসা (আঃ)-এর পরে বনু ইস্রাঈলগণ অনেকদিন যাবত ঈমান-আমলের উপরে দৃঢ় ছিল। তারপর তাদের মধ্যে বিভিন্ন বিদ‘আত মাথা চাড়া দেয়। এমনকি কেউ কেউ মূর্তিপূজায় লিপ্ত হয়। যদিও সর্বদা তাদের মধ্যে নবী ছিল। যাঁরা তাদেরকে তওরাতের আদেশ-নিষেধ মেনে চলার প্রতি সর্বদা আহবান জানাতেন। কিন্তু লোকদের মধ্যে অবাধ্যতা বৃদ্ধি পায় এবং তারা স্বেচ্ছাচারী হয়ে যায় ও যা ইচ্ছা তাই করতে থাকে। ফলে আল্লাহ তাদের উপরে তাদের শত্রুপক্ষকে বিজয়ী করলেন। শত্রুরা তাদের বিপুল সংখ্যক লোককে হ’ত্যা করল ও বহু সংখ্যক লোককে বন্দী করল এবং তাদের অনেক এলাকা দখল করে নিল। কারণ হ’ল এই যে, মূসা (আঃ)-এর যামানা থেকে তাদের বংশে যে ‘তাওরাত’ ও ‘তাবূত’ ছিল, তা তাদের হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল। এই ‘তাওরাত’ ও ‘তাবূত’-কে যুদ্ধের সময় সম্মুখে রাখলে তার বরকতে তারা জয়লাভ করত। কিন্তু তাদের বেদ্বীনীর কারণে উক্ত যুদ্ধে তা শত্রুসেনাদের করতলগত হয়। ফলে তাওরাতের হাফেয বলতে হাতে গণা কিছু লোককে পাওয়া যেত। এক সময় তাদের বংশ হ’তে নবুঅত ছিন্ন হয়ে গেল। যুদ্ধে তাদের নবীবংশ অর্থাৎ লাভী বিন ইয়াকূব বিন ইসহাক্ব বিন ইব্রাহীম (আঃ)-এর বংশে একজন মাত্র গর্ভবতী মহি’লা বেঁচে ছিলেন, যার স্বামী যুদ্ধে নিহ’ত হন। এমতাবস্থায় বেঁচে থাকা অবশিষ্ট লোকেরা ঐ মহিলাকে একটি ঘরে লুকিয়ে রাখল এই নিয়তে যে, আল্লাহ যেন একটি পুত্র সন্তান দান করেন, যে তাদের নবী হবে। ঐ মহিলাও সর্বদা ইবাদতে রত থাকতেন ও আল্লাহর নিকটে একজন পুত্র ও নবী কামনা করে দো‘আ করতেন। যথাসময়ে আল্লাহ তাকে একটি পুত্র সন্তান দান করলেন। তখন মহিলা খুশী হয়ে তার নাম রাখলেন ‘শামভীল’ (شَمْوِيلُ) বা ‘শাম‘ঊন’। হিব্রু ভাষায় যার অর্থ হ’ল سَمِعَ اللهُ دُعَائِيْ ‘আল্লাহ আমার দো‘আ কবুল করেছেন’। অতঃপর ছেলে সুন্দরভাবে বড় হ’তে লাগল ও নবুঅতের বয়স লাভ করল। তখন আল্লাহ তার নিকটে ‘অহি’ প্রেরণ করলেন ও সেমতে তিনি জনগণকে তাওহীদের দাওয়াত দিতে থাকলেন। নিজ বংশ বনু ইস্রাঈলকে দাওয়াত দিলে তারা নবীর নিকটে তাদের জন্য একজন শাসক দাবী করল। যিনি তাদের পক্ষে দুশমনদের বিরুদ্ধে লড়াই করবেন। তখন নবী তাদেরকে বলবেন, যদি আল্লাহ তোমাদের জন্য কোন বাদশাহ প্রেরণ করেন ও তিনি তোমাদেরকে লড়াইয়ের নির্দেশ দেন, তাহ’লে তোমরা কি লড়াইয়ে বের হবে? তোমরা কি লড়াইয়ের জন্য অপরিহার্য বিষয়গুলি অর্জনে নবীর সাথে সহযোগিতা করবে? জবাবে তারা বলল,وَمَا لَنَا أَلاَّ نُقَاتِلَ فِي سَبِيلِ اللهِ وَقَدْ أُخْرِجْنَا مِنْ دِيَارِنَا وَأَبْنَائِنَا، ‘কেন আমরা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করব না? অথচ আমরা আমাদের ঘরবাড়ি ও সন্তানাদি হ’তে বহিষ্কৃত হয়েছি’ (বাক্বারাহ ২/২৪৬)। অর্থাৎ আমাদের এলাকা দখল করা হয়েছে এবং আমাদের সন্তানাদি বন্দী করে গোলাম বানানো হয়েছে। তখন নবী শামভীল (বা শ্যামুয়েল) তাদের বললেন, إِنَّ اللهَ قَدْ بَعَثَ لَكُمْ طَالُوتَ مَلِكًا، ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তালূতকে তোমাদের জন্য শাসক নিযুক্ত করেছেন’ (বাক্বারাহ ২/২৪৭)। একথা শুনে গোত্রের নেতারা দরিদ্র ত্বালূতকে প্রত্যাখ্যান করে বলল,أَنَّى يَكُونُ لَهُ الْمُلْكُ عَلَيْنَا وَنَحْنُ أَحَقُّ بِالْمُلْكِ مِنْهُ وَلَمْ يُؤْتَ سَعَةً مِنَ الْمَالِ ‘আমাদের উপর তালূতের শাসন কিভাবে সঙ্গত হ’তে পারে? অথচ শাসন ক্ষমতা পাওয়ার ব্যাপারে আমরাই তার চাইতে অধিক হকদার। তাছাড়া তার কোন আর্থিক স্বচ্ছলতা নেই’। নবী জবাবে বললেন,إِنَّ اللهَ اصْطَفَاهُ عَلَيْكُمْ وَزَادَهُ بَسْطَةً فِي الْعِلْمِ وَالْجِسْمِ وَاللهُ يُؤْتِي مُلْكَهُ مَنْ يَّشَآءُ وَاللهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ- ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের উপর তাকে মনোনীত করেছেন এবং জ্ঞানে ও দৈহিক শক্তিতে তাকে প্রাচুর্য দান করেছেন। বস্ততঃ আল্লাহ যাকে ইচ্ছা তাকে রাজত্ব দান করেন। আর আল্লাহ (স্বীয় অনুগ্রহ) প্রশস্তকারী ও সর্বজ্ঞ’ (বাক্বারাহ ২/২৪৭)। যদিও ত্বালূত তাদেরই একজন সাধারণ সৈনিক ছিলেন। কিন্তু শাহী পরিবারের ছিলেন না (ইবনু কাছীর)। কেননা শাহী পরিবার ছিল ইয়াহূযা বিন ইয়াকূব বিন ইসহাক্ব বিন ইব্রাহীম (আঃ)-এর বংশের। আর নবুঅত ছিল লাভী বিন ইয়াকূব বিন ইসহাক্ব বিন ইব্রাহীম (আঃ)-এর বংশে। পক্ষান্তরে ত্বালূত ছিলেন বেন্ইয়ামীন বিন ইয়াকূব বিন ইসহাক্ব বিন ইব্রাহীম (আঃ)-এর বংশের। যে বংশে কোন নবী বা শাসক ছিলেন না। আর সে কারণে গোত্রনেতারা ত্বালূতের নেতৃত্ব প্রত্যাখ্যান করেছিল (কুরতুবী)

উক্ত আয়াত নাযিলের মাধ্যমে আল্লাহ তাদের বুঝিয়ে দিলেন যে, আল্লাহ তাঁর বান্দাদের পরিচালনার জন্য নেতৃত্ব ও শাসন ক্ষমতার মত গুরুত্বপূর্ণ রহমত ইচ্ছা করলে কোন পরিবারকে অবিরত ধারায় দান করতে পারেন। রহমত বিতরণের একচ্ছত্র অধিকার তাঁরই। তাঁর এ কাজে প্রশ্ন উত্থাপনের অধিকার কারু নেই। কেননা তিনিই বান্দাকে অধিকতর ভালবাসেন ও তার মঙ্গলামঙ্গলের খবর রাখেন। তিনি বিশাল অনুগ্রহের অধিকারী। এই অনুগ্রহ তিনি যাকে খুশী তার জন্য নির্দিষ্ট করতে পারেন। আর তিনিই সবচাইতে ভাল বুঝেন নেতৃত্বের সত্যিকারের হকদার কে? দ্বিতীয়তঃ আল্লাহ এ বিষয়টিও বুঝিয়ে দিলেন যে, নেতৃত্বের জন্য অপরিহার্য দু’টি গুণ হ’ল ইলমী যোগ্যতা এবং স্বাস্থ্যগত যোগ্যতা। যা ত্বালূতের মধ্যে পুরা মাত্রায় ছিল। বলা বাহুল্য এ দু’টি গুণ সর্বকালে ও সর্বযুগে নেতৃত্বের জন্য অপরিহার্য অংশ (ইবনু কাছীর)

নবীর মাধ্যমে উপরোক্ত জবাব শুনে গোত্রনেতারা ত্বালূতের নেতৃত্বের পক্ষে দলীল তলব করল। তখন নবী বললেন,إِنَّ آيَةَ مُلْكِهِ أَنْ يَّأْتِيَكُمُ التَّابُوتُ فِيهِ سَكِينَةٌ مِنْ رَبِّكُمْ وَبَقِيَّةٌ مِمَّا تَرَكَ آلُ مُوسَى وَآلُ هَارُونَ تَحْمِلُهُ الْمَلَآئِكَةُ إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآيَةً لَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ- ‘তার শাসক হবার নিদর্শন এই যে, তোমাদের নিকট সেই সিন্দুকটি সমাগত হবে, যাতে থাকবে তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ হ’তে প্রশান্তি এবং মূসা ও হারূণ পরিবারের পরিত্যক্ত বস্ত্তসমূহ। ফেরেশতাগণ ওটি বহন করে আনবে। নিশ্চয়ই এর মধ্যে তোমাদের জন্য নিদর্শন রয়েছে, যদি তোমরা বিশ্বাসী হও’ (বাক্বারাহ ২/২৪৮)

‘তাবূত’-এর আগমন :

‘তাবূত’ কিভাবে এল, এ বিষয়ে বিদ্বানগণ বিভিন্ন বর্ণনা দিয়েছেন। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, ফেরেশতাগণ আসমান ও যমীনের মধ্যবর্তী এলাকা দিয়ে তাবূত বহন করে এনে ত্বালূত-এর বাড়ীর সামনে রাখে এবং এ দৃশ্য গোত্রের সকল মানুষ প্রত্যক্ষ করে। সুদ্দী বলেন, অতঃপর তাবূত ত্বালূত-এর গৃহে রক্ষিত হয় এবং লোকেরা তখন শাম‘ঊনের নবুঅতের উপরে ঈমান আনে ও ত্বালূতের আনুগত্য কবুল করে। ছওরী তার কয়েকজন উস্তায থেকে বর্ণনা করেন যে, ফেরেশতাগণ তাবূত নিয়ে আসেন একটি বা দু’টি গরুর গাড়ীতে করে’। অন্যেরা বলেন, তাবূত ছিল ফিলিস্তীনের ‘আরীহা’ (أَرِيْحَآءُ) মতান্তরে ‘আযদূহ’ (أَزْدُوْهُ) নামক গ্রামে। মুশরিকরা তাবূতটি তাদের পূজা মন্দিরে রাখে। তাতে তাদের মূর্তি সব ভেঙ্গে পড়তে থাকে। তখন তাকে বের করে প্রত্যন্ত এক গ্রামে রেখে আসে। কিন্তু সেখানে গ্রামবাসীর মধ্যে মহামারী লেগে যায়। তখন বনী ইস্রাঈলের এক বন্দী দাসী তাদের বলল যে, তোমরা তাবূতটি বনু ইস্রাঈলদের নিকটে ফেরত দিয়ে এসো। নইলে এ মহামারী থেকে রেহাই পাবে না। তখন তারা তাবূতটিকে দু’টি গরুর গাড়ীতে উঠিয়ে দিল। ফেরেশতাগণ গরু দু’টিকে হাকিয়ে বনু ইস্রাঈলদের গ্রামের কাছে নিয়ে গেল। এভাবে তাবূত তালূতের বাড়ীতে পৌঁছল (ইবনু কাছীর; কুরতুবী)

শাওকানী বলেন, বিগত বিদ্বানগণ থেকে তাবূত-এর আগমন সম্বন্ধে সংক্ষিপ্ত ও বিস্তারিত বহু বর্ণনা এসেছে। যেগুলির দীর্ঘ বর্ণনায় কোন ফায়েদা নেই (ফাৎহুল ক্বাদীর)। আমরা মনে করি যে, পবিত্র কুরআনে যতটুকু বর্ণনা এ বিষয়ে এসেছে, ততটুকুতে ঈমান আনা উচিত। অর্থাৎ ফেরেশতাগণ আল্লাহর হুকুমে তাবূত বহন করে এনে ত্বালূত-এর বাড়ীর আঙ্গিনায় রেখে দিল। যা ছিল ত্বালূত-এর নেতৃত্বের স্পষ্ট প্রমাণ।

ত্বালূত-এর পরিচয় :

ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, ত্বালূত ছিলেন ঐ সময়ের শ্রেষ্ঠ আলেম এবং দীর্ঘ ও সুঠাম দেহ সৌষ্ঠবের অধিকারী। যা দেখে শত্রুদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার হ’ত (কুরতুবী)

‘ত্বালূত’ অনারব শব্দ। যা মু‘আররাব অর্থাৎ আরবী হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে। ত্বালূত ছিলেন যুগের সেরা আলেম। দীর্ঘ ও সুঠামদেহী সৈনিক। পেশায় ছিলেন পানি সরবরাহকারী। কেউ বলেন, চামড়া দাবাগতকারী বা চামড়া শ্রমিক। কেউ বলেন, মাটি শ্রমিক (কুরতুবী)। অবশ্য দারিদ্রে্যর কারণে তিনি সুযোগ-সুবিধামত উপরোক্ত তিনটি পেশাই অবলম্বন করে থাকতে পারেন। তবে তিনি যে সমাজের স্বচ্ছল ও ধনিক শ্রেণীভুক্ত ছিলেন না, সেকথা কুরআনেই বর্ণিত হয়েছে (বাক্বারাহ ২/২৪৭)। অনুরূপভাবে তিনি নবী বংশের ছিলেন না বা নিজে কোন নবী ছিলেন না বা শাহী বংশেরও ছিলেন না এবং তার নিকটে কোন ‘অহি’ও আসেনি (ফাৎহুল ক্বাদীর)

জালূত-এর পরিচয় :

‘জালূত’ অনারব শব্দ, যাকে মু‘আররাব করা হয়েছে। জালূত ছিলেন আমালেক্বাদের বাদশাহ। বিরাট সৈন্যবাহিনী ও শান-শওকতের অধিকারী। আমালেক্বা হ’ল ‘আদ বংশের একটি গোত্রের নাম। যারা ফিলিস্তীনের ‘আরীহা’-তে বসবাস করত (ফাৎহুল ক্বাদীর)। তিনি ছিলেন বেঁটে, জনমরোগী ও পীত বর্ণের মানুষ। তবে অত্যন্ত শক্তিশালী ছিলেন। একাই বিরাট বাহিনীকে পর্যুদস্ত করতেন’ (কুরতবী)

তাবূত-এর পরিচয় :

‘তাবূত’ فَعْلُوتُ-এর ওযনে এসেছে। মাদ্দাহ التَّوْبُ অর্থ : الرُّجُوعُ বা ফিরে আসা। এটা এজন্য যে, বনু ইস্রাঈলগণ বিপদে পড়লে এই তাবূতের কাছে ফিরে আসত (ফাৎহুল ক্বাদীর)। তাবূত ও তাওরাত সম্মুখে রেখে যুদ্ধ করলে তারা জিতে যেত। কিন্তু তাওরাতের প্রতি বনু ইস্রাঈলদের অবাধ্যতার কারণে এই তাবূত শত্রুপক্ষের দখলে চলে যায় (ইবনু কাছীর)। কুরতুবী বলেন, এটি প্রথমে আদম (আঃ)-এর নিকটে নাযিল হয়। অতঃপর মূসা (আঃ) হয়ে ইয়াকূব (আঃ)-এর নিকটে এসে উপনীত হয়। এইভাবে এটা বনু ইস্রাঈলদের উত্তরাধিকারে থেকে যায়। এর বরকতে তারা যুদ্ধের সময় সর্বদা শত্রুপক্ষের উপরে জয়লাভ করত। কিন্তু যখন তারা অবাধ্য হয়ে গেল ও অন্যায়-অপকর্ম শুরু করল, তখন শত্রু পক্ষ তাদের উপরে জয়লাভ করল ও তাবূত ছিনিয়ে নিল। সুদ্দী বলেন, এইভাবে এক সময় আমালেক্বাদের বাদশাহ জালূত-এর দখলে তাবূত চলে যায়। কুরতুবী বলেন, ‘এটাই হ’ল সবচেয়ে বড় দলীল এ ব্যাপারে যে, অবাধ্যতাই হ’ল গ্লানির একমাত্র কারণ’(هَذَا أَدَلُّ دَلِيلٍ عَلَى أَنَّ الْعِصْيَانَ سَبَبُ الْخِذْلاَنِ) নাহহাস বলেন, বর্ণিত হয়েছে যে, তাবূত থেকে এক ধরনের ক্রন্দন ধ্বনি শোনা যেত। যখন লোকেরা এটা শুনত, তখনই তারা যুদ্ধের জন্য বের হয়ে যেত। ধ্বনি বন্ধ হয়ে গেলে বা বন্ধ থাকলে তারা যুদ্ধে বের হ’ত না বা তাবূতও সামনে চলত না। ওয়াহাব বিন মুনাবিবহ বলেন, এই তাবূত বা সিন্দুকের দৈর্ঘ ছিল তিন গজ ও প্রস্থ ছিল দু’গজ। কালবী বলেন, এটি শামসাদ কাঠের তৈরী ছিল। যা দিয়ে চিরুনী তৈরী করা হ’ত (কুরতুবী)

তাবূতে রক্ষিত সামগ্রী :

এই পবিত্র তাবূত বা সিন্দুকে ‘সাকীনাহ’ এবং মূসা ও হারূণ (আঃ)-এর ব্যবহৃত পরিত্যক্ত সামগ্রী ছিল বলে কুরআনে (বাক্বারাহ ২/২৪৮) উল্লেখিত হয়েছে। শাওকানী বলেন, মূসা ও হারূণ-এর নামের পূর্বে ‘আলে’ (آلِ) অর্থাৎ ‘পরিবারবর্গ’ শব্দ উল্লেখিত হয়েছে তাঁদের দু’জনের মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য(لَفْظُ آلِ: مُقْحَمَةٌ لِتَفْخِيمِ شَأْنِهِمَا) অবশ্য অনেকে ইয়াকূব (আঃ)-এর বংশের সকল নবী ও বংশধরগণের পরিত্যক্ত সামগ্রী বলে ব্যাখ্যা দিয়েছেন’ (ফাৎহুল ক্বাদীর)। তবে সেটা যে যুক্তি ও বাস্তবতার বিরোধী তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই সামগ্রী সমূহ কি ছিল? এ বিষয়ে বিদ্বানদের বিভিন্ন উক্তি বর্ণিত হয়েছে। যেমন, তাওরাত, মূসার লাঠি বা লাঠির ভগ্নাংশ, কিছু পরিমাণ ‘মান্না’, এক জোড়া জুতা, মূসা ও হারূণ (আঃ)-এর ব্যবহৃত কাপড়-চোপড় ইত্যাদি। সাঈদ বিন মানছূর প্রমুখ-এর বর্ণনায় এসেছে, উপরোক্ত বস্ত্তসমূহ ছাড়াও ‘বিপদ মুক্তির দো‘আ’(كَلِمَةُ الْفَرْجِ) লিখিত (কোন বস্ত্ত) ছিল। দো‘আটি নিম্নরূপ :

لَآ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ الْحَلِيمُ الْكَرِيْمُ وَسُبْحَانَ اللهِ رَبُّ السَّمَوَاتِ السَّبْعِ وَرَبِّ الْعَرْشِ الْعَظِيمِ وَالْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ-

‘ধৈর্যশীল দয়ালু আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। পবিত্রতা ঘোষণা করছি সপ্ত আসমান ও মহান আরশের প্রভুর এবং যাবতীয় প্রশংসা বিশ্ব চরাচরের প্রতিপালকের জন্য’ (ফাৎহুল ক্বাদীর; ইবনু কাছীর; কুরতুবী)

অতঃপর ‘সাকীনাহ’ (اَلسَّكِينَةُ) ‘সুকূন’ ধাতু থেকে নেওয়া হয়েছে। যার অর্থ : শান্তি ও স্থিতি। এখানে এর দ্বারা একথা বুঝানো হয়েছে যে, ত্বালূত-এর নেতৃত্ব সম্পর্কে তোমাদের মধ্যে যে বিসম্বাদের সৃষ্টি হয়েছে, সে বিসম্বাদ দূরীকরণের জন্য এবং শান্তি ও স্থিতিশীলতা পুনঃস্থাপনের জন্য তাবূত-এর আগমন তোমাদের জন্য মানসিক প্রশান্তির কারণ হবে। সম্ভবতঃ এ কারণেই ইবনু আববাস (রাঃ)-এর ব্যাখ্যা করেছেন ‘রহমত’ হিসাবে (ইবনু কাছীর)

এতদ্ব্যতীত ‘সাকীনাহ’-এর ব্যাখ্যায় বিভিন্ন যঈফ সূত্রে বিভিন্ন অলৌকিক বর্ণনা এসেছে। যেমন, (১) ইবনুল মুনযির ও ইবনু আবী হাতেম হযরত ইবনু আববাস (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, ‘সাকীনাহ’ বিড়ালের ন্যায় একটি জন্তুর নাম, যার জ্যোতির্ময় দু’টি চক্ষু রয়েছে। যখন দু’পক্ষে যুদ্ধ শুরু হ’ত, তখন ঐ জন্তুটি তার দু’খানা হাত বের করে দিত ও চক্ষু দিয়ে তীর্যক আলো ছড়িয়ে তাকিয়ে থাকত। এতে শত্রুপক্ষ ভয়ে পালিয়ে যেত। (২) ত্বাবারাণী হযরত আলী (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, ‘সাকীনাহ’ এমন একটি ঘুর্ণিবায়ুর নাম, যার দু’টি মাথা রয়েছে। (৩) আব্দুর রাযযাক, ইবনু জারীর, ইবনুল মুনযির, হাকেম, ইবনু আবী হাতেম প্রমুখ হযরত আলী (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন, ‘সাকীনাহ’ এমন একটি তীব্র বায়ুর নাম, যার মানুষের ন্যায় মুখমন্ডল রয়েছে। (৪) ইবনু জারীর, ইবনু আবী হাতেম, বায়হাক্বী ‘দালায়েল’-এর মধ্যে মুজাহিদ-এর সূত্রে বর্ণনা করেন যে, ‘সাকীনাহ’ আল্লাহর পক্ষ হ’তে বায়ু আকারে আগমন করে। যার বিড়ালের ন্যায় চেহারা রয়েছে এবং দু’টি ডানা ও একটি লেজ রয়েছে। (৫) সাঈদ বিন মানছূর, ইবনু জারীর প্রমুখ ইবনু আববাস (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, ‘সাকীনাহ’ হ’ল জান্নাতের স্বর্ণ নির্মিত তস্তরীর নাম। যাতে করে নবীদের অন্তঃকরণ সমূহ ধৌত করা হয়। (৬) আব্দ বিন হামীদ, ইবনু জারীর, ইবনু আবী হাতেম প্রমুখ ওয়াহাব বিন মুনাবিবহ থেকে বর্ণনা করেন যে, ‘সাকীনাহ’ হ’ল আল্লাহর পক্ষ হ’তে প্রেরিত একটি আত্মার নাম, যা কথা বলে না। কিন্তু যখন লোকেরা কোন বিষয়ে ঝগড়া করে, তখন কথা বলে এবং তারা যেটা জানতে চায়, সেটা বলে দেয়’।

উপরোক্ত বর্ণনাসমূহ উদ্ধৃত করার পর ইমাম শাওকানী বলেন, এই সমস্ত পরস্পর বিরোধী বক্তব্য সমূহ ঐসব বড় বড় মুফাসসিরগণের নিকটে সম্ভবতঃ ইহূদীদের মাধ্যমে পৌঁছে থাকবে। তারা এসবের মাধ্যমে মুসলমানদের নিয়ে খেলতে চেয়েছে এবং তাদের আক্বীদা-বিশ্বাসের মধ্যে সন্দেহের বীজ বপন করতে চেয়েছে। তারা কখনো ‘সাকীনাহ’-কে প্রাণীদেহ কল্পনা করেছে। কখনো জড় পদার্থ বানিয়েছে। কখনো জ্ঞানহীন বস্ত্ত বলেছে। এসব কিছুই ‘ইস্রাঈলিয়াত’ মাত্র। এ ধরনের তাফসীর কখনোই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) থেকে ছহীহ সূত্রে বর্ণিত হয়নি’। অতএব আমাদের উপরে ওয়াজিব হ’ল ‘সাকীনাহ’ শব্দের মূল অর্থের দিকে ফিরে যাওয়া। অর্থাৎ শান্তি ও স্থিতি, যা পূর্বে বর্ণিত হয়েছে।

অতঃপর তিনি বলেন, ছহীহ মুসলিমে হযরত বারা বিন ‘আযেব (রাঃ) হ’তে একটি হাদীছ বর্ণিত হয়েছে যে, জনৈক ব্যক্তি সূরায়ে কাহফ পাঠ করছিলেন। এসময় তাকে একটি মেঘখন্ড এসে ছায়া করে। যা একবার নিকটে আসে আবার দূরে সরে যায়। এ দেখে তার বাঁধা ঘোড়াটি ভয়ে লাফাতে থাকে। অতঃপর লোকটি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকটে সকালে এসে এ ঘটনা বর্ণনা করলে তিনি বলেন যে, এটি হ’ল ‘সাকীনাহ’ যা কুরআনের জন্য নাযিল হয়েছিল’। বুখারী ও মুসলিমে আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ)-এর বর্ণনায় এসেছে যে, লোকটি তার খেজুর শুকানোর স্থানে বসে কুরআন তেলাওয়াত করছিল।.. উক্ত বর্ণনায় একথাও এসেছে যে, ফেরেশতারা দলে দলে উক্ত কুরআন শুনতে এসেছিল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, যদি তুমি সকাল পর্যন্ত তেলাওয়াত করতে, তাহ’লে ওরা সকাল পর্যন্ত এভাবে অবস্থান করত’।

ইমাম কুরতুবী এর দ্বারা প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে, ‘সাকীনাহ’ মেঘরূপে ছাতার ন্যায় লোকটির মাথা বরাবর ছায়া করেছিল। এতে অনুমিত হয় যে, তার মধ্যে রূহ রয়েছে এবং জ্ঞান রয়েছে। নইলে সে কুরআন শুনতে আসবে কেন? (কুরতুবী)। শাওকানী বলেন, আগত মেঘটিকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ‘সাকীনাহ’ নামে অভিহিত করেছেন মাত্র, যা প্রশান্তি হিসাবে কুরআন পাঠকের মাথার উপরে এসে ছায়া করেছে (ফাৎহুল ক্বাদীর)। এর অর্থ এটা নয় যে, সে একটি প্রাণী এবং তার রূহ আছে ও জ্ঞান আছে’।

অতএব আয়াতে বর্ণিত ‘সাকীনাহ’ বলতে তার আভিধানিক অর্থ হিসাবে বিশেষ ধরনের মানসিক প্রশান্তি ও স্থিতি বুঝতে হবে, অন্য কিছু নয়।

ত্বালূত-এর যুদ্ধযাত্রা ও নদী পরীক্ষা :

তাবূত আসার পরে ত্বালূত-এর নেতৃত্ব মেনে নিয়ে তার কওম আমালেক্বা বাদশাহ জালূত-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ যাত্রা করে। সুদ্দী বলেন, তাদের সংখ্যা ছিল আশি হাযার। পথিমধ্যে তারা পিপাসার্ত হয়ে পড়ে সেনাপতি ত্বালূত-এর নিকটে পানি দাবী করে। তখন তিনি বলেন যে, আল্লাহ তোমাদেরকে একটি নদী দ্বারা পরীক্ষা করবেন। যে ব্যক্তি সেই নদী থেকে এক অঞ্জলী ব্যতীত পানি পান করবে, সে আমার দলভুক্ত থাকবে না।

নদীটি ছিল জর্ডন ও ফিলিস্তীনের মধ্যবর্তী স্থানে, যা ‘শরী‘আতের নদী’(نَهْرُ الشَّرِيعَةِ) বলে প্রসিদ্ধি লাভ করে (ইবনু কাছীর)। নদীর পানি ছিল নির্মল ও সুমিষ্ট (কুরতুবী)। যথাসময়ে তারা নদীর কিনারে পৌঁছে গেল। সুমিষ্ট পানি পেয়ে অধিকাংশ লোক বেশী পান করে অলস হয়ে পড়ল এবং বলল, আজকে আমাদের পক্ষে জালূত বাহিনীর মুকাবিলা করা সম্ভব নয়। অল্প সংখ্যক আল্লাহভীরু লোক বলল, ‘কতই না কম সংখ্যক লোক বেশী সংখ্যক লোকের উপরে জয়লাভ করে আল্লাহর হুকুমে। নিশ্চয়ই আল্লাহ দৃঢ়চিত্ত ধৈর্যশীলদের সাথে থাকেন’ (বাক্বারাহ ২/২৪৯)। একথা বলে তারা সম্মুখে অগ্রসর হ’ল ও বাকীরা সেখানেই পড়ে রইল।

উল্লেখ্য যে, আয়াতে পানি পান করাকে পান করা ও খাওয়া দু’টি ক্রিয়াপদের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। পান করার চাইতে খাওয়া শব্দের মধ্যে আস্বাদনের জোরালো ভাব প্রকাশ পায়। কেননা খাওয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন স্বাদ আস্বাদন করা যায়। অতএব যখন কোন কিছু খেতে নিষেধ করা হয়, তখন তা পান করার কোন সুযোগ আর থাকে না। কিন্তু পান করতে নিষেধ করলে খাওয়ার সুযোগ থেকে যায়। দ্বিতীয়তঃ আরেকটি বিষয় এর দ্বারা বুঝা গেল যে, পানি কেবল পানীয় নয়, বরং খাদ্যও বটে। যা জীবন ধারণের জন্য সর্বাধিক যরূরী। তৃতীয়তঃ আরেকটি বিষয় লক্ষণীয় যে, পানি পানকারী কম ঈমানদারদের জন্য পানি পান করা ক্রিয়াপদ ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু সফল ঈমানদারগণের জন্য পানি খাওয়া ক্রিয়াপদ ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ যারা এক অঞ্জলীর বাইরে পানি পান করা দূরের কথা সামান্যতম পানির স্বাদও আস্বাদন করবে না। এর মাধ্যমে দৃঢ় ঈমানদারদের মৌলিক গুণ ও বৈশিষ্ট্য বুঝানো হয়েছে যে, তারা নেকীর কাজে আমীরের হুকুমকে অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। অলসতা বা এড়িয়ে যাবার জন্য কোন অজুহাত বা চোরাপথ তালাশ করে না।

ইবনু আসাকির ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণনা করেন যে, ত্বালূত-এর বাহিনীতে সর্বমোট তিন লক্ষ তিন হাযার তিনশত তের (৩,০৩,৩১৩) জন লোক ছিল। তাদের সবাই পানি পান করেছিল ৩১৩ জন ব্যতীত এবং তারাই মাত্র নদী পার হ’তে পেরেছিল। সুদ্দী বলেন, এদের সংখ্যা মোট ৮০,০০০ ছিল। হযরত বারা বিন ‘আযেব (রাঃ) প্রমুখাৎ বুখারী, ইবনু জারীর প্রমুখ বর্ণনা করেন যে, আমরা আল্লাহর নবীর ছাহাবীগণ এই মর্মে আপোষে আলোচনা করতাম যে, বদরের যুদ্ধে মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর সাথীদের সংখ্যা নদী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ত্বালূত-এর সাথীদের সংখ্যার অনুরূপ ছিল। অর্থাৎ ৩১০-এর কিছু বেশী এবং সত্যিকারের মুমিন ব্যতীত কেউ সেদিন নদী পার হয়নি (ফাৎহুল ক্বাদীর; ইবনু কাছীর; কুরতুবী)

ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, লোকেরা তাদের স্ব স্ব ইচ্ছা অনুযায়ী নদী থেকে পানি পান করে। কাফেররা উটের ন্যায় পানি শোষণ করল। অন্যান্য গোনাহগারেরা তার চেয়ে কিছু কম। ৭৬ হাযার লোক তো ফিরেই এলো। কিছু মুমিন এক অঞ্জলী পরিমাণ পানি পান করল। কিছু মুমিন একেবারেই পানি পান করেনি। যারা পানি পান করেছিল, তারা তৃপ্ত হয়নি। বরং তারা কঠিন পিপাসায় কষ্ট পায়। যারা পানি পান করেনি, তারা অধিক সুস্থ ও কষ্ট সহিষ্ণু ছিল এক অঞ্জলী পানি পানকারীদের চাইতে’। অন্য বর্ণনায় ইবনু আববাস ও সুদ্দী বলেন, পানি পানকারীদের মধ্যে ৪,০০০ লোক নদী পার হয়েছিল। অতঃপর তারা যখন জালূতের এক লক্ষ সুসজ্জিত সেনাবাহিনী দেখল, তখন তাদের মধ্য থেকে ৩,৬৮০-এর কিছু বেশী লোক ফিরে গেল। অতঃপর দৃঢ়চিত্ত বাকী ৩১০-এর কিছু বেশী লোক, যাদের সংখ্যা বদরী যোদ্ধাদের সংখ্যার অনুরূপ ছিল, তারা টিকে থাকল এবং লড়াইয়ে জিতে গেল’।

সংখ্যাগত উপরোক্ত বিভিন্নমুখী বক্তব্য সমূহকে আমরা এভাবে সমন্বয় করতে পারি যে, ত্বালূত-এর সাথে তার গোত্র ও অঞ্চলের ছেলে-বুড়া-নারী-শিশু সব মিলিয়ে তিন লক্ষ তিন হাযার তিন শত তের (৩,০৩,৩১৩) জন লোক ছিল। তন্মধ্যে আশি হাযার (৮০,০০০) যোদ্ধা ছিল। এক অঞ্জলীর অধিক পানি পানকারীদের সংখ্যা ছিল ছিয়াত্তর হাযার (৭৬,০০০)। এক অঞ্জলী পরিমাণ পানি পানকারীদের সংখ্যা ছিল ৩,৬৮০-এর কিছু বেশী এবং মোটেই পানি পান করেননি এমন লোকদের সংখ্যা ছিল ৩১০-এর কিছু বেশী। ওয়াহাব বিন মুনাবিবহ বলেন, জিহাদ থেকে পিছিয়ে আসে ছেলে-বুড়া ও রোগীরা (কুরতুবী)। সুদ্দী বলেন, নিঃসন্দেহে তাদের মধ্যে ছিল মুমিন, মুনাফিক, কষ্টসহিষ্ণু ও অলস সব ধরনের লোক (কুরতুবী)। এক অঞ্জলী পরিমাণ পানি পানকারী এবং মোটেই পানি পান যারা করেনি, তারাই যে কেবল নদী পার হয়েছিল, সেদিকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় কুরআনে বর্ণিত আয়াতে।

যেমন আল্লাহ বলেন, فَلَمَّا فَصَلَ طَالُوتُ بِالْجُنُودِ قَالَ إِنَّ اللهَ مُبْتَلِيكُمْ بِنَهَرٍ فَمَنْ شَرِبَ مِنْهُ فَلَيْسَ مِنِّي وَمَنْ لَمْ يَطْعَمْهُ فَإِنَّهُ مِنِّي إِلاَّ مَنِ اغْتَرَفَ غُرْفَةً بِيَدِهِ فَشَرِبُوا مِنْهُ إِلاَّ قَلِيلاً مِنْهُمْ فَلَمَّا جَاوَزَهُ هُوَ وَالَّذِينَ آمَنُوا مَعَهُ قَالُوا لاَ طَاقَةَ لَنَا الْيَوْمَ بِجَالُوتَ وَجُنُودِهِ قَالَ الَّذِينَ يَظُنُّونَ أَنَّهُمْ مُلاَقُو اللهِ كَمْ مِنْ فِئَةٍ قَلِيلَةٍ غَلَبَتْ فِئَةً كَثِيرَةً بِإِذْنِ اللهِ وَاللهُ مَعَ الصَّابِرِينَ- ‘অতঃপর যখন তালূত তার সৈন্যদল নিয়ে বের হ’ল, তখন বলল, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে একটি নদী দ্বারা পরীক্ষা করবেন। অতঃপর যে ব্যক্তি সেখান থেকে পান করবে, সে আমার দলভুক্ত নয়। আর যে ব্যক্তি পানির স্বাদ নিবে না, সেই-ই আমার দলভুক্ত থাকবে। তবে যে মাত্র এক অঞ্জলী পানি পান করবে, সে ব্যতীত। অতঃপর অল্প সংখ্যক ছাড়া তারা সবাই সেখান থেকে (পেট ভরে) পানি পান করল। অতঃপর যখন সে (তালূত) ও তার সঙ্গী ঈমানদারগণ নদী অতিক্রম করে গেল, তখন তারা বলল, জালূত ও তার সেনাবাহিনীর মোকাবিলা করার মত শক্তি আজ আমাদের নেই। পক্ষান্তরে তাদের মধ্যে যারা দৃঢ়বিশ্বাস পোষণ করত যে, তারা আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করবে, তারা বলল, আল্লাহর হুকুমে কত ক্ষুদ্র দল কত বৃহৎ দলকে পরাজিত করেছে। আর আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথেই থাকেন’ (বাক্বারাহ ২/২৪৯)

উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বুখারী ও অন্যান্য বর্ণিত হাদীছ-এর বর্ণনা যোগ করা যায়। যেখানে বলা হয়েছে, وَمَا جَاوَزَ مَعَهُ إِلاَّ مُؤْمِنٌ ‘ত্বালূত-এর সঙ্গে নদী পার হয়ে আসতে পারেনি মুমিন ব্যতীত’।[1] এটা পরিষ্কার যে, ঐ বিরাট সংখ্যক লোকের মধ্যে সত্যিকারের মুমিন ছিল তারাই যারা আমীরুল জায়েশ ত্বালূত-এর নির্দেশ মোতাবেক এক অঞ্জলী ভরে পানি পান করেছিল অথবা মোটেই পানি পান করেনি। যাদের মোট সংখ্যা ৪,০০০ এবং যাদের মধ্যে ৩,৬৮৭ জন বলেছিল যে, আজকে আমাদের যুদ্ধ করার ক্ষমতা নেই। উক্ত হাদীছে একথাও বলা হয়েছে যে, ত্বালূত-এর নদী পার হওয়া সাথীদের সংখ্যা ছিল বদরী ছাহাবীদের সংখ্যার ন্যায় ৩১০-এর কিছু বেশী। অন্য বর্ণনায় ৩১৩ জন’ (কুরতুবী)। এর দ্বারা ঐসব সাথীদের বুঝানো হয়েছে, যারা এক অঞ্জলী পরিমাণ পানি পান করার অনুমতি পাওয়া সত্ত্বেও ঐ সুযোগ গ্রহণ করেনি। বরং আল্লাহর উপরে তাওয়াক্কুল করে সম্মুখে অগ্রসর হয়ে যুদ্ধ করেছিল। আল্লাহ তাদের হাতেই বিজয় দান করেছিল।

যুদ্ধের বিবরণ :

আল্লাহ বলেন,فَهَزَمُوهُمْ بِإِذْنِ اللهِ وَقَتَلَ دَاوُودُ جَالُوتَ وَآتَاهُ اللهُ الْمُلْكَ وَالْحِكْمَةَ، ‘অতঃপর তারা আল্লাহর হুকুমে জালূতের সৈন্যদলকে পরাজিত করল। আর দাঊদ জালূতকে হত্যা করল এবং আল্লাহ তাকে রাজ্যক্ষমতা ও প্রজ্ঞা দান করলেন’ (বাক্বারাহ ২/২৫১)। এতে বুঝা যায় যে. ব্যাপক যুদ্ধ হয়নি। বরং জালূতের সঙ্গে দাঊদের দ্বৈত যুদ্ধ হয়েছিল, যেমন পুরা কালে নিয়ম ছিল এবং তাতেই জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয়েছিল।

দাঊদ-এর পরিচয় :

তিনি ছিলেন দাঊদ বিন ঈশা (إِيشَى أَوْ إِيشَا)। কেউ বলেন, দাঊদ বিন যাকারিয়া বিন রাশওয়া (دَاوُدُ بْنُ زَكَرِيَّا بْنِ رَشْوَى)। তিনি ইয়াহূযা বিন ইয়াকূব বিন ইসহাক্ব বিন ইব্রাহীম (আঃ)-এর বংশধর ছিলেন। তিনি বায়তুল মুক্বাদ্দাস-এর অধিবাসী ছিলেন। তিনি প্রথমে একজন রাখাল ছিলেন। পরে নবী ও বাদশাহ হন। তাঁর সাতটি ভাই ছিল ত্বালূত-এর সেনাবাহিনীতে। তিনি ছিলেন ভাইদের মধ্যে সবার ছোট এবং ছাগল চরাতেন। যুদ্ধ যাত্রার দিন তিনি মনে মনে চিন্তা করলেন যে, আমি অবশ্যই যুদ্ধ দেখব। এই বলে যেমনি তিনি যাত্রা করলেন, অমনি পাশ থেকে একটি পাথর তাকে ডেকে বলল,يَا دَاوُدُ خُذْنِي فَبِي تَقْتُلُ جَالُوتَ ‘হে দাঊদ! আমাকে সাথে নাও এবং আমাকে দিয়েই তুমি জালূতকে হত্যা কর’ (কুরতুবী)। পরে আরও একটি, অতঃপর আরও একটি পাথর অনুরূপভাবে আহবান করে। তখন তিনি তিনটি পাথরকেই থলিতে ভরে নেন।

অতঃপর উভয় পক্ষ মুখোমুখি হ’লে জালূত সদম্ভে সম্মুখে এসে তার মোকাবিলার জন্য বিরোধী পক্ষের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিল। লোকেরা তাকে দেখে ভীত হয়ে পড়ল। তখন ত্বালূত বললেন, কে আছ জালূতকে মোকাবিলা করতে পারে? যে তার মোকাবিলা করবে ও তাকে হ’ত্যা করবে, আমি তার সাথে আমার মেয়েকে বিবাহ দিব ও আমার মালের (গণীমতের) অর্ধেক দেব। আমার শাসনকার্যেও তাকে শরীক করব’ (ইবনু কাছীর)। তখন দাঊদ এগিয়ে এলেন ও মোকাবিলা করার ইচ্ছা ব্যক্ত করলেন। কিন্তু তার বয়স কম দেখে ও সাইজে বেঁটে-খাটো দেখে ত্বালূত তাকে পসন্দ করলেন না। অতঃপর তিনি দ্বিতীয়বার ও তৃতীয়বার আহবান করলেন। কিন্তু প্রতিবারেই দাঊদ এগিয়ে এলেন। তখন ত্বালূত তাকে বললেন, তোমার মধ্যে যুদ্ধের কি অভিজ্ঞতা আছে? দাঊদ বললেন, আমার ছাগল পালের উপরে একবার নেকড়ে বাঘ হামলা করেছিল। আমি তাকে মেরেছিলাম ও তার মাথা দেহ থেকে কেটে ফেলেছিলাম। ত্বালূত বললেন, নেকড়ে একটি দুর্বল জীব। এছাড়া অন্য কিছুর অভিজ্ঞতা আছে কি? দাঊদ বললেন, একবার একটি সিংহ আমার ছাগল পালের উপরে হামলা করে। আমি তাকে শিকার করি এবং তার দুই চোয়াল ফেড়ে ফেলি। হে সেনাপতি! জালূত কি উক্ত সিংহের চাইতে শক্তিশালী হবে? অতঃপর ত্বালূত তাকে নিজের বর্ম, ঘোড়া ও অস্ত্র প্রদান করলেন।

দাঊদ ঘোড়ায় চড়ে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে পিছিয়ে এলেন ও বললেন, এই ঘোড়া ও অস্ত্রে আমার কাজ নেই। আমি আমার নিজস্ব অস্ত্র ‘প্রস্তর খন্ড’ দিয়েই লড়াই করব। বলাবাহুল্য যে, দাঊদ ঐ সময়কার একজন নিপুণ তীরন্দাজ ছিলেন। অতঃপর তিনি ঘোড়া থেকে নেমে থলি থেকে পাথর খন্ড বের করে ধনুকে বসালেন ও জালূতের দিকে তাক করে এগোতে লাগলেন। জালূত তাকে দেখে ঘৃণাভরে বললেন, হে ছোকরা! তুমি এসেছ আমাকে মোকাবিলা করতে? এই বলে তাকে হাতে ধরে উঁচু করে ছুঁড়ে ফেলে আছড়ে মারতে চাইলেন। তখন দাঊদ জালূতের নাক লক্ষ্য করে ‘বিসমিল্লাহ’ বলে পাথর ছুঁড়ে মারলেন, যা তার মাথা চূর্ণ করে দিল। অতঃপর তার মাথাটা কেটে থলিতে ভরে নিয়ে চলে এলেন। এরপর ত্বালূত-এর লোকেরা সর্বাত্মক হামলা চালিয়ে জালূত বাহিনীকে পলায়নে বাধ্য করে। এভাবে তারা চরমভাবে পরাজিত ও বিতাড়িত হয়’ (কুরতুবী)

ইবনু আবী হাতেম মুজাহিদ-এর সূত্রে বর্ণনা করেন যে, ত্বালূত দাঊদকে বলেছিলেন যে, আমি তোমাকে আমার রাজত্বের এক তৃতীয়াংশ দিব ও আমার মেয়েকে তোমার সাথে বিবাহ দিব।.. অতঃপর দাঊদبِسْمِ اللهِ إِلَهِي وَإِلَهِ آبَائِي إِبْرَاهِيمَ وَإِسْحَاقَ وَيَعْقُوبَ ‘সেই আল্লাহর নামে শুরু করছি, যিনি আমার পিতা ইব্রাহীম, ইসহাক্ব ও ইয়াকুব-এর ইলাহ’ বলে পাথর ছুঁড়েন (ফাৎহুল ক্বাদীর)। কুরতুবী বলেন, এই আয়াতের ব্যাখ্যায় লোকেরা আরও বহু কাহিনীর অবতারণা করেছে। আমি তার মধ্যে উদ্দিষ্ট বিষয়টুকুই মাত্র উল্লেখ করলাম (কুরতুবী)। ইবনু কাছীর বলেন, ইস্রাঈলী বর্ণনা সমূহে লোকেরা উল্লেখ করেছে যে, দাঊদ স্বীয় ধনুকের সাহায্যে তীর নিক্ষেপ করে জালূতকে হ’ত্যা করেন। সেনাপতি ত্বালূত দাঊদকে ওয়াদা করেছিলেন যে, জালূতকে হ’ত্যা করতে পারলে তাকে নিজ কন্যার সাথে বিবাহ দিবেন, তার ধন-সম্পদের অর্ধেক দিবেন এবং তাকে শাসন কর্তৃত্বের অংশীদার করবেন। অতঃপর তিনি সে ওয়াদা রক্ষা করেন’ (ইবনু কাছীর)

শাওকানী বলেন, মুফাসসিরগণ এই ধরনের আরও বহু কাহিনীর অবতারণা করেছেন। তবে আল্লাহ সঠিক খবর জানেন’ (ফাৎহুল ক্বাদীর)

প্রথিতযশা এইসব তাফসীরকারগণের মন্তব্য থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, এসব বাহিনী ইস্রাঈলী গল্পকারদের তৈরী এবং অধিকাংশ কল্পনাপ্রসূত। অতএব এসবের উপরে ঈমান রাখা ঠিক নয়। কুরআন ও ছহীহ হাদীছে বর্ণিত ক্বিছছা সমূহের উপরেই কেবল ঈমান রাখতে হবে। আর তা হ’লঃ ৩১৩ জন ত্বালূত বাহিনীর মধ্যে দাঊদ অন্তর্ভুক্ত ছিলেন এবং তিনিই জালূতকে হত্যা করেছিলেন। অতঃপর আল্লাহ পাক তাকে শাসন ক্ষমতা, হিকমত ও নবুঅত দান করেছিলেন।

আয়াতের শিক্ষা :

(১) হক-এর আন্দোলন যারা করেন, তারা পরীক্ষার সম্মুখীন হয়ে থাকেন।

(২) পরীক্ষা ব্যতীত তাদের পদযুগল দৃঢ় হয় না এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে পুরস্কারও নেমে আসে না।

(৩) পরীক্ষা যত কঠিন হয়, পুরস্কার তত বড় হয়।

(৪) পরীক্ষার মাধ্যমে দুর্বল ও সবল ঈমানদার বাছাই হয়ে যায় এবং বিজয়ের পুরস্কার কেবলমাত্র সেই স্বল্পসংখ্যক খাঁটি ঈমানদার লোকদেরকেই দেওয়া হয়, যারা কঠিন মূল্যের বিনিময়ে আল্লাহর হুকুমে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হ’তে সক্ষম হয়।

(৫) ঐ স্বল্প সংখ্যক লোককে আল্লাহ পাক ইচ্ছা করলে মাত্র একজনের মাধ্যমে বিজয় দান করতে পারেন। যেমন দাঊদ-এর মাধ্যমে ত্বালূত বাহিনীকে দান করেছিলেন।

(৬) হকপন্থীগণ কেবলমাত্র আল্লাহর উপরে ভরসা করেন। অন্য কোন শক্তির উপরে নয়। যেমন ঐ স্বল্প সংখ্যক অর্থাৎ ৩১৩ জন দৃঢ়চিত্ত ঈমানদার লোকগুলি যখন দুর্ধর্ষ সেনাপতি জালূত-এর লক্ষাধিক বাহিনীর সম্মুখীন হ’ল, তখন তারা জালূত-এর বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অস্ত্রসজ্জিত বাহিনীর প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে মহা শক্তিধর আল্লাহর উপরে ভরসা করে এবং প্রার্থনা করে এই বলে,رَبَّنَا أَفْرِغْ عَلَيْنَا صَبْرًا وَثَبِّتْ أَقْدَامَنَا وَانْصُرْنَا عَلَى الْقَوْمِ الْكَافِرِينَ- ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের উপর বিশেষ ছবর নাযিল করুন, আমাদের পদসমূহ দৃঢ় রাখুন এবং অবিশ্বাসী সম্প্রদায়ের উপর আমাদেরকে সাহায্য করুন!’ (বাক্বারাহ ২/২৫০)। অতঃপর অসম সাহসী ‘দাঊদ একাই জালূতকে হত্যা করেন এবং আল্লাহ দাঊদকে শাসনক্ষমতা, হিকমত ও নবুঅত দান করেন’ (বাক্বারাহ ২/২৫১)

(৭) তাক্বদীরের ভুল ব্যাখ্যাকারী অদৃষ্টবাদীর জন্য নয়, বরং আল্লাহর উপরে নির্ভরশীল প্রচেষ্টাকারীর জন্যই কেবল আল্লাহর রহমত নেমে আসে। সে প্রচেষ্টা যত ক্ষুদ্রই হৌক না কেন, হক হ’লে বিজয় তাদেরই জন্য।

উপসংহার :

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, لاَ تَزَالُ طَائِفَةٌ مِنْ أُمَّتِىْ ظَاهِرِيْنَ عَلَى الْحَقِّ لاَ يَضُرُّهُمْ مَنْ خَذَلَهُمْ حَتَّى يَأْتِىَ أَمْرُ اللهِ وَهُمْ كَذَلِكَ- ‘ক্বিয়ামত পর্যন্ত উম্মতের একটি দল হক-এর উপরে দৃঢ়চিত্তে কায়েম থাকবে। পরিত্যাগকারীদের পরিত্যাগ তাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না’।[2] পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ হ’ল হক-এর চূড়ান্ত মানদন্ড। যারা যেকোন মূল্যে তার উপরে কায়েম থাকবেন ও তার বিধান সার্বিক জীবনে প্রতিষ্ঠায় জীবনপাত করবেন, তাদেরকে অবশ্যই কেবলমাত্র আল্লাহর উপরে ভরসা করে এগিয়ে যেতে হবে। আল্লাহ হকপন্থীদেরকে হক-এর উপরে টিকে থাকার ও জীবনের সকল দিক ও বিভাগে হক প্রতিষ্ঠার দূরূহ সংগ্রামে দৃঢ়ভাবে কায়েম থাকার তাওফীক দান করুন- আমীন![3]


[1]. বুখারী হা/৩৯৫৯; ইবনু মাজাহ হা/২৮২৮; ছহীহ ইবনু হিববান হা/৪৭৯৬।

[2]. মুসলিম হা/১৯২০; বুখারী হা/৩৬৪১; মুসলিম হা/১০৩৭; মিশকাত হা/৬২৭৬।

[3]. মাসিক আত-তাহরীক (রাজশাহী), দরসে কুরআন, ৪/৯ সংখ্যা, জুন ২০০১।