কল্যাণের চাবি

عَنْ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم- إِنَّمَا الأَعْمَالُ بِالنِّيَّةِ وَإِنَّمَا لِكُلِّ امْرِئٍ مَا نَوَى فَمَنْ كَانَتْ هِجْرَتُهُ إِلَى اللهِ وَرَسُولِهِ فَهِجْرَتُهُ إِلَى اللهِ وَرَسُولِهِ وَمَنْ كَانَتْ هِجْرَتُهُ إِلَى دُنْيَا يُصِيبُهَا أَوِ امْرَأَةٍ يَتَزَوَّجُهَا فَهِجْرَتُهُ إِلَى مَا هَاجَرَ إِلَيْهِ-

১. শাব্দিক ব্যাখ্যা : كلمة الحصر- إِنَّمَا বা কৈবল্য বোধক শব্দ। অর্থ- ‘ইহা ব্যতীত নয়’ عمل- الأَعْمَالُ এর বহুবচন। অর্থাৎ আমল সমূহ। ب ‘হরফে জার’ অর্থ ‘দ্বারা বা সহিত’।

نِيَّةٌ- النِّيًاتُ এর বহুবচন। নিয়ত বা নিইয়াত দু’টিই জায়েয। অর্থ ‘সংকল্প’। শারঈ পরিভাষায় ‘নিয়াত’ অর্থ আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে অন্তরকে কোন কাজের দিকে রুজু করাالنِّيَّةُ لُغَةً : الْقَصْدُ، وَشَرْعًا : تَوَجُّهُ الْقَلْبِ نَحْوَ الْفِعْلِ ابْتِغَاءً لِوَجْهِ اللهِ- ‘সকল মানুষের জন্য’ مَانَوَى ‘যা সে সকল্প করে’। فَمَنْ ‘অতঃপর যে ব্যক্তি’ كَانَتْ هِجْرَتُهُ ‘যার হিজরত হবে’।

‘হিজরত’ অর্থ পরিত্যাগ করা। শারঈ পরিভাষায় কেবলমাত্র দ্বীনের স্বার্থে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে কুফরী দেশ হ’তে ইসলামী দেশে স্থায়ীভাবে আগমনকে ‘হিজরত’ বলা হয়। يُصِيْبُهَا ‘সে তাই পাবে’। امْرَأَةٍ ‘মহিলা’ يَتَزَوَّجُهَا ‘সে তাকে বিয়ে করবে’। إلى مَا هَاجَرَ إلَيْهِ ‘সেই দিকে যে দিকে সে হিজরত করে’।

২. অনুবাদ : হযরত ওমর বিন খাত্ত্বাব (রাযিয়াল্লাহু ‘আনহু) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহে ওয়া সাল্লাম) এরশাদ করেন, নিশ্চয়ই সমস্ত আমল নিয়তের উপরে নির্ভরশীল এবং প্রত্যেকে অতটুকু পাবে, যতটুকুর জন্য সে নিয়ত করবে। অতঃপর যে ব্যক্তি হিজরত করেছে আল্লাহ ও রাসূলের দিকে, তার হিজরত আল্লাহ ও রাসূলের দিকেই হয়েছে। কিন্তু যে ব্যক্তি হিজরত করেছে দুনিয়ায় পাওয়ার জন্য বা কোন নারীকে বিবাহ করার জন্য, সে ব্যক্তির হিজরত সেজন্যেই হয়েছে’।[1]

৩. বিষয় বস্ত্ত : হাদীছ অধ্যয়ন ও তদনুযায়ী আমলের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করার চূড়ান্ত লক্ষ্য নির্ধারণের জন্য নিয়তকে খালেছ করাই অত্র হাদীছের মূল বিষয়বস্ত্ত। এই মহতী গ্রন্থ সংকলনের পিছনে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করাই একমাত্র লক্ষ্য একথা সম্মানিত ‘মিশকাত’ সংকলক নিজের জন্য যেমন বুঝাতে চেয়েছেন, তেমনি সুধী পাঠকবৃন্দকেও সেদিকে ইঙ্গিত করেছেন। সালাফে ছালেহীন বিদ্বানগণ তাঁদের সকল দ্বীনী কাজের শুরুতে এই হাদীছকে আগে নিয়ে আসতে পসন্দ করতেন। মুহাদ্দিছকুল শিরোমণি ইমাম আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ বিন ইসমাঈল বুখারী (রহঃ) এবং অন্যান্য মুহাদ্দিছ বিদ্বানগণ তাঁদের স্ব স্ব কিতাবের শুরুতে অত্র হাদীছকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। তাঁদের অনুকরণে সম্মানিত সংকলক নিয়তের হাদীছকে মিশকাতের প্রথমে এনেছেন। আমরা অনুবাদক ও পাঠকমহল সকলে হাদীছের এই বিশ্ববিখ্যাত সংকলন গ্রন্থ অধ্যয়নের শুরুতে স্ব স্ব নিয়তকে আল্লাহর জন্য খালেছ করে নিই এবং তাঁর নিকটে প্রার্থনা করি তিনি যেন আমাদেরকে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে আমাদের জীবন, পরিবার ও সমাজ গঠনের তাওফীক দান করেন- আমীন!

৪. গুরুত্ব : ‘এই হাদীছটি এমন গুরুত্বপূর্ণ হাদীছ সমূহের অন্যতম যার উপরে দ্বীন আবর্তিত হয়’। আব্দুর রহমান বিন মাহদী, আলী বিনুল মাদীনী, আহমাদ বিন হাম্বল, শাফেঈ, আবুদাঊদ, তিরমিযী প্রমুখ মুহাদ্দেছীন বলেন যে, এই হাদীছটি দ্বীনের এক তৃতীয়াংশ। কারণ বান্দার সকল কাজ সম্পন্ন হয় তার সংকল্প, বক্তব্য ও কর্ম তৎপরতার মাধ্যমে। উক্ত তিনটি বিষয়ের মধ্যে সংকল্পটিই হ’ল প্রথম ও প্রধান।

হাফেয ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) বলেন, মুওয়াত্ত্বা মালেক ব্যতীত এমন কোন বিশ্বস্ত হাদীছ গ্রন্থ নেই, যেখানে অত্র হাদীছটি বর্ণিত হয়নি। ইমাম বুখারী (রহঃ) এই হাদীছটি তাঁর কিতাবের প্রথমে এনেছেন ও অন্য আরও কয়েকটি স্থানে এনেছেন। ইমাম মুসলিম (রহঃ) তাঁর কিতাবের ‘ইমারত’ অধ্যায়ের শেষে অত্র হাদীছটি নিয়ে এসেছেন। হাদীছটি একজন মাত্র রাবী কর্তৃক বর্ণিত ‘খবরে ওয়াহেদ’ পর্যায়ের হ’লেও পরবর্তীতে ব্যাপক প্রসিদ্ধির কারণে ‘মুতাওয়াতির’ (متواتر معنوى) এর স্তরে উন্নীত হয়েছে।

৫. ‘খবরে ওয়াহেদ’ দলীল হওয়ার প্রমাণ : একজন বিশ্বস্ত রাবীর বর্ণিত ছহীহ হাদীছ বা ‘খবরে ওয়াহেদ’ ইসলামী আইনের অন্যতম দলীল হিসাবে গৃহীত হবে, এ বিষয়ে অত্র হাদীছটি একটি শক্তিশালী প্রমাণ। ইসলামী শরী‘আতের অন্যতম প্রধান গুরুত্বপূর্ণ এই হাদীছটির একমাত্র রাবী হ’লেন ইসলাম জগতের ২য় খলীফা হযরত ওমর ফারূক (রাঃ)। তাঁর নিকট থেকে বর্ণনা করেছেন একমাত্র ব্যক্তি আলক্বামা বিন আবু ওয়াকক্বাছ। তাঁর নিকট থেকে বর্ণনা করেছেন একমাত্র ব্যক্তি মুহাম্মাদ বিন ইবরাহীম তায়মী। তাঁর নিকট থেকে বর্ণনা করেছেন একমাত্র ব্যক্তি ইয়াহইয়া বিন সাঈদ আনছারী। অতঃপর হাদীছটি ব্যাপক প্রসিদ্ধি লাভ করে এবং ২০০ শতের অধিক বিদ্বান এই হাদীছটির বর্ণনাকারী হওয়ার মর্যাদা লাভ করেন।

৬. রাবীর পরিচয় : হাদীছের একমাত্র রাবী হ’লেন আবু হাফছ উমার বিনুল খাত্ত্বাব বিন নুফাইল বিন আব্দুল উযযা আল-আদাভী আল-কুরায়শী আল-মাদানী। যাঁর বংশ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর প্রপিতামহ কা‘আব বিন লূঈ-র সাথে মিলেছে। ‘আবু হাফছ’ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর দেওয়া কুনিয়াত বা উপনাম, যার অর্থ সিংহ। ‘ফারূক’ নামটিও আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এর দেওয়া লক্বব বা উপাধি যার অর্থ ‘হক ও বাতিলের মধ্যে পার্থক্যকারী’। রাসূল (ছাঃ)-এর দো‘আর বরকতে ৬ষ্ঠ নববী বর্ষে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁকে দিয়েই ইসলাম গ্রহণকারীর সংখ্যা ৪০ পূর্ণ হয়। তিনিই প্রথম ইসলাম গ্রহণের পর পরই কা‘বা ঘরে গিয়ে প্রকাশ্যভাবে ছালাত আদায় করেন[2] এবং তাঁর মাধ্যমেই ইসলামের প্রচার প্রকাশ্যভাবে আরম্ভ হয়। জীবদ্দশায় জান্নাতের সুসংবাদ প্রাপ্ত দশজন শ্রেষ্ঠ ছাহাবী তথা ‘আশারায়ে মুবাশশারাহ’র তিনি ছিলেন অন্যতম সেরা ব্যক্তিত্ব। যাঁর সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেছেন, ‘যদি কেউ আমার পরে নবী হ’তেন, তবে ওমরই হ’তেন’।[3] আবুবকর ছিদ্দীক (রাঃ)-এর মৃত্যুর পরে তিনি খলীফা হন এবং তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি নিজেকে ‘খলীফাতুন নবী’ বা নবীর খলীফা না বলে ‘আমীরুল মুমিনীন’ অর্থাৎ মুমিনদের আমীর উপাধি গ্রহণ করেন। বদরের যুদ্ধ সহ সকল গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধে তিনি আল্লাহর রাসূলের (ছাঃ) সাথী ও পরামর্শদাতা ছিলেন। ইরান, ইরাক, মিসর ও সিরিয়া সহ বড় বড় বিজয় তাঁর খেলাফতকালে সাধিত হয়। ইসলামের নৈতিক ও বৈষয়িক উন্নতি তাঁর আমলে তুঙ্গে ওঠে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হ’তে তাঁর মাধ্যমে বর্ণিত হাদীছের সংখ্যা ৫৩৯। তার মধ্যে বুখারী ও মুসলিম মিলিতভাবে সংকলন করেছেন ৮১টি, এককভাবে বুখারী করেছেন ৩৪টি ও মুসলিম করেছেন ২১টি। তাঁর আংটিতে লেখা ছিলكَفَى بِالْمَوْتِ وَاعِظًا ‘মৃত্যুই উত্তম উপদেষ্টা’ (মিরক্বাত হা/৫৩৫১-এর আলোচনা)। ইসলামের বিধান মানার ব্যাপারে তিনি ছিলেন অত্যন্ত কঠোর। আবুবকরের পরে তিনিই ছিলেন রাসূল (ছাঃ)-এর সর্বাধিক প্রিয় ছাহাবী ও পরামর্শদাতা। তাঁর হক পরামর্শ ও ন্যায়পরায়নতার প্রশংসায় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, আল্লাহ ওমরের যবান ও হৃদয়কে হক-এর অনুগত করে দিয়েছেন।[4] তিনি আরও বলেন, ওমর যে রাস্তায় চলেন, শয়তান তা ছেড়ে অন্য রাস্তায় চলে’।[5] তিনি অন্যত্র বলেন, ‘আমি দেখি জিন ও ইনসানের শয়তানগুলো ওমরকে দেখলে পালায়’।[6] ১০ বছর খেলাফতে সমাসীন থাকার পরে ২৩ হিজরীর ২৫শে যিলহজ্জ বুধবার মদীনার মসজিদে নববীতে ফজরের ছালাতে ইমামতি করা অবস্থায় ছাহাবী মুগীরাহ বিন শো‘বার বিক্ষুদ্ধ মজুসী গোলাম আবু লুলু ফিরোয তাঁকে অস্ত্রাঘাতে আহত করে ও তিনদিন পরে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। (ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাহে রাজেঊন)। তাঁর অনুরোধ ও মা আয়েশার অনুমোদন ক্রমে ২৪ হিজরীর ১লা মুহাররম রবিবারে রাসূল (ছাঃ)-এর হুজরার মধ্যে আবু বকর (রাঃ)-এর পাশেই তিনি কবরস্থ হন। ছোহায়েব (রাঃ) তাঁর জানাযায় ইমামতি করেন। দাফনকালে হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ (রাঃ) বলেছিলেন, ذهب اليوم بتسعة أعشار العلم ‘ইলমের ১০ ভাগের ৯ ভাগ আজকে বিদায় হ’ল’ (মির‘আত হা/১-এর আলোচনা)

৭. হাদীছের ব্যাখ্যা : إنَّمَا الأعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ ইমাম নববী (রহঃ) এর ব্যাখ্যা করেছেন যে ‘শারঈ আমলসমূহ নিয়তের উপরে নির্ভরশীল। নাপাকী দূর করা বা অনুরূপ কোন কাজে নিয়ত শর্ত নয়’। وَإِنَّمَا لِكُلِّ امْرِءٍ مَانَوَى ‘নিশ্চয়ই মানুষ অতটুকুই পাবে, যতটুকুর জন্য সে নিয়ত করবে’। ইমাম খাত্ত্বাবী বলেন, একথার দ্বারা কোন আমলকে নিয়ত দ্বারা খাছ করা অর্থ বুঝানো হয়েছে। যেমন যদি কেউ ক্বাযা ছালাত আদায় করতে চায়, তবে তাকে যোহর, আছর বা অন্য কোন ছালাতের নির্দিষ্টভাবে নিয়ত করতে হবে। ‘আম’ ভাবে ক্বাযা ছালাতের নিয়ত করলে চলবে না। ইমাম নববীও অনুরূপ অর্থ করেছেন। হাদীছের শুরুতে সকল আমলকে নিয়তের উপরে নির্ভরশীল বলা হয়েছে। কিন্তুوَإِنَّمَا لِكُلِّ امْرِءٍ مَانَوَى বলে তাকে খাছ করা হয়েছে। অর্থাৎ বান্দার যাবতীয় নেক আমলের ছওয়াব নির্ভর করছে তার নেক নিয়ত বা সংকল্পের দৃঢ়তা ও স্বচ্ছতার উপরে। নেকীর কাজের নিয়ত করলে নেকী পাওয়া যায়, যদিও তা বাস্তবায়ন করতে সক্ষম না হয়, পক্ষান্তরে গোনাহের কাজের নিয়ত করলেও আল্লাহ তার হিসাব নিবেন। যদি সে তার বাস্তবায়িত না করে তবে আল্লাহ তার উপরে ক্বিয়ামতের দিন শাস্তি মওকূফ করবেন (কুরতুবী)

فَمَنْ كَانَتْ هِجْرَتُه إِلى اللهِ وَرَسُوْلِه... এখান থেকে শেষ পর্যন্ত পূর্ববর্তী অংশের ব্যাখ্যা এসেছে। বলা হচ্ছে ‘যার হিজরত আল্লাহ ও রাসূলের দিকে হবে, তার হিজরত সেজন্যেই হবে’ অর্থাৎ যার হিজরত কেবলমাত্র দ্বীনের স্বার্থে ও আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য কুফরী দেশ হ’তে ইসলামী দেশে হবে, তার হিজরত আল্লাহর নিকটে কবুল হবে ও সে আখেরাতে পূর্ণ ছওয়াবের অধিকারী হবে। কিন্তু যার হিজরত দুনিয়ার জন্য বা কোন মহিলার জন্য হবে, তার হিজরত সেজন্যেই হবে’। অর্থাৎ সে কোন রূপ ছওয়াব পাবে না। এখানে ‘দুনিয়া’ এবং ‘মহিলা’ স্রেফ উদাহরণ হিসাবে আনা হয়েছে। অমনিভাবে কোন মহিলা যদি কোন পুরুষের উদ্দেশ্যে হিজরত করে তারও ফলাফল একই রূপ হবে। উপরোক্ত দু’টি বিষয়ের প্রতি মানুষের আকর্ষণ সর্বাধিক। সেকারণ উদাহরণ হিসাবে এখানে এ দু’টি বিষয়কে ব্যবহার করা হয়েছে। ‘ক্বায়লাহ’ নাম্নী জনৈকা মহিলা যিনি ‘মুহাজিরে উম্মে ‘ক্বায়েস’ নামে প্রসিদ্ধ, তাকে বিবাহ করার উদ্দেশ্যে জনৈক ব্যক্তি মক্কা হ’তে মদীনায় হিজরত করেছিলেন এবং সেকারণেই অত্র হাদীছের অবতারণা ঘটেছে বলে যে কথা প্রচলিত আছে, তার কোন ছহীহ ভিত্তি নেই (মির‘আত)

‘মুত্তাফাক্ব আলাইহ’ مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ : একই ছাহাবী কর্তৃক বর্ণিত হাদীছ যা ইমাম বুখারী ও মুসলিম উভয়ে সংকলন করেছেন, তাকে ‘মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ’ বলা হয়। হাদীছের স্তরসমূহের মধ্যে ‘মুত্তাফাক্ব আলাইহ’ হাদীছ হ’ল বিশুদ্ধতম। তার পরের স্থান হ’ল এককভাবে বুখারী ও এককভাবে মুসলিম-এর।

৮. মাসআলা : সকল শুভ কাজের শুরুতে অন্তরে ‘নিয়ত’ করতে হবে, এ বিষয়ে উপরে বর্ণিত হাদীছের আলোকে সকল বিদ্বান একমত। কেননা নিয়ত বা সংকল্পের স্থান হ’ল হৃদয় জগতে। কিন্তু পরবর্তীকালে মাননীয় ‘হেদায়া’ লেখক আল্লামা বুরহানুদ্দীন আলী বিন আবুবকর আল-ফারগানী আল-মারগীনানী (৫১১-৫৯৩ হি.) ছালাতের শুরুতে ‘মুখে আরবী ভাষায় নিয়ত পাঠ করা উত্তম’ বলেন। উক্ত ফৎওয়ার অনুসরণে বাংলাদেশসহ উপমহাদেশে বিভিন্ন প্রকার ছালাত ও ছিয়ামের জন্য বিভিন্ন প্রকার আরবী নিয়ত চালু হয়েছে। ‘মুখে নিয়ত পাঠ না করলে ছালাত সিদ্ধ হবে না’ বলে অনেকে ফৎওয়া দিয়ে থাকেন। এর ফল দাঁড়িয়েছে এই যে, অনেকে নিয়ত মুখস্ত করতে না পেরে ছালাত আদায় করেন না। আবার যারা ছালাত আদায় করেন, তাদের অনেকে ভুল উচ্চারণে ও ভুল নিয়ত পাঠে ছালাত বরবাদ করেন। অথচ নিয়ত পাঠের কোন প্রমাণ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ), ছাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈনে এযাম এমনকি চার ইমামের কারু থেকে বর্ণিত নেই। এটি সম্পূর্ণ কপোলকল্পিত ও ধারণা ভিত্তিক। যেমন স্বয়ং ‘হেদায়া’ লেখক নিয়তের আলোচনায় স্পষ্টভাবেই বলেছেন, وَالنِّيَّةُ هِيَ الْإِرَادَةُ، وَالشَّرْطُ أَنْ يَعْلَمَ بِقَلْبِهِ أَيَّ صَلاَةٍ يُصَلِّي. أَمَّا الذِّكْرُ بِاللِّسَانِ فَلاَ مُعْتَبَرَ بِهِ، وَيَحْسُنُ ذَلِكَ لاِجْتِمَاعِ عَزِيمَتِهِ- ‘নিয়ত অর্থ এরাদা বা সংকল্প করা। এর শর্ত হ’ল অন্তরে এ বিষয়ে জানা যে, কোন ছালাত সে আদায় করছে। মুখে উচ্চারণ করার কোন গুরুত্ব নেই। অবশ্য সংকল্পকে কেন্দ্রীভূত করার জন্য উহা উত্তম’। শেষের কথাটুকুতেই মুখে আরবী নিয়ত পাঠের রেওয়াজ চালু হয়েছে। যদিও লেখক নিজে এর তেমন কোন গুরুত্ব দেননি। ইমাম ইবনুল হুমাম (রহঃ) বলেন, হাদীছ শাস্ত্রবিদগণের অনেকে বলেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হ’তে ছহীহ বা যঈফ সনদে এরূপ কোন হাদীছ পাওয়া যায় না যে, তিনি ছালাত শুরু করার সময় মুখে এরূপ বলেছেন যে, ‘আমি অমুক ছালাত শুরু করছি’। এ ধরণের কোন বক্তব্য ছাহাবা ও তাবেঈন কারু নিকট থেকে পাওয়া যায় না। বরং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হ’তে একথাই প্রমাণিত যে, তিনি যখন ছালাতে দাড়াতেন, ‘তখন আল্লাহু আকবর’ বলতেন। অতএব মুখে নিয়ত পাঠ করা বিদ‘আত। (মিরক্বাত ১/৪০ পৃ.)। 

৮. উপসংহার :

নিয়তের গুরুত্বের উপরে বর্ণিত অত্র হাদীছটি মুসলিম উম্মাহকে তার জীবনের মূল উদ্দেশ্য ‘আমর বিল মা‘রূফ’ ও ‘নাহি আনিল মুনকার’-এর কথা সর্বদা স্মরণ করিয়ে দেয়। ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়ের প্রতিরোধের দৃঢ় সংকল্প নিয়ে সে যেন তার জীবন পথে পদচারণা করে। মুসলিম জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্যই হ’ল আল্লাহর সন্তুষ্টি ও জান্নাত লাভ করা। সেই লক্ষ্য হাছিলের প্রধান শক্তি হ’ল দৃঢ় সংকল্প। স্থির লক্ষ্য ও দৃঢ় সংকল্প ব্যতীত জীবনে কিছুই অর্জন করা সম্ভব নয়। সমাজের প্রকৃত কল্যাণ সৎ নিয়তের উপরেই নির্ভরশীল। তাই নিয়তের এই হাদীছটিকে যথার্থভাবেই ‘কল্যাণের চাবি’ বলা যেতে পারে।

আত-তাহরীক-এর যাত্রাশুরুতে অত্র হাদীছের অবতারণার মাধ্যমে আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের চূড়ান্ত লক্ষ্যে আমাদের দৃঢ় সংকল্প ব্যক্ত করছি। আল্লাহ আমাদের নেক-নিয়ত পূর্ণ করুন- আমীন!


[1]. বুখারী হা/১; মুসলিম হা/১৯০৭; মিশকাত হা/১।

[2]. তিরমিযী হা/৩৬৮৩; আহমাদ হা/৫৬৯৬; মিশকাত হা/৬০৩৬; ছহীহাহ হা/৩২২৫।

[3]. তিরমিযী হা/৩৬৮৬; মিশকাত হা/৬০৩৮; ছহীহাহ হা/৩২৭।

[4]. তিরমিযী হা/৩৬৮২; মিশকাত হা/৬০৩৩।

[5]. বুখারী হা/৩২৯৪; মুসলিম হা/২৩৯৬; মিশকাত হা/৬০২৭।

[6]. তিরমিযী হা/৩৬৯১; মিশকাত হা/৬০৪০।