দ্বীন হ’ল নছীহত

عَنْ تَمِيمٍ الدَّارِىِّ أَنَّ النَّبِىَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ : الدِّينُ النَّصِيحَةُ، قُلْنَا لِمَنْ قَالَ : لِلَّهِ وَلِكِتَابِهِ وَلِرَسُولِهِ وَلأَئِمَّةِ الْمُسْلِمِينَ وَعَامَّتِهِمْ-

১. অনুবাদ : হযরত তামীম আদ-দারী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন যে, ‘দ্বীন হ’ল নছীহত’। আমরা বললাম কাদের জন্য হে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)? তিনি বললেন, আল্লাহর জন্য, তাঁর কিতাবের জন্য, তাঁর রাসূলের জন্য, মুসলিম নেতৃবৃন্দের জন্য ও সকল মুসলমানের জন্য’।[1]

২. রাবী তামীম দারী (রাঃ) হ’তে উপরোক্ত একটি মাত্র হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। তিনি সেই বিখ্যাত ছাহাবী, যাঁকে ওমর ফারূক (রাঃ) উবাই বিন কা‘ব (রাঃ)-এর সাথে অন্যতম ইমাম হিসাবে মদীনার মসজিদে নববীতে সর্বপ্রথম জামা‘আত সহকারে বিতরসহ এগারো রাক‘আত তারাবীহ পড়ার নির্দেশ দান করেছিলেন, যা সাহারীর পূর্ব পর্যন্ত দীর্ঘ হ’ত।[2]

৩. الدِّينُ النَّصِيحَةُ ‘দ্বীন হ’ল নছীহত’। অর্থাৎ দ্বীনের মূল কথাই হ’ল নছীহত বা উপদেশ। যেমন হাদীছে বলা হয়েছে الحج عرفة ‘হজ্জ হ’ল আরাফা’ অর্থাৎ হজ্জের মূল বিষয় হ’ল আরাফাতের ময়দানে ৯ই যিলহাজ্জ তারিখে জমায়েত হওয়া।[3]

৪. النَّصِيْحَةُ فِى اللُّغَةِ الْاِخْلاَصُ নছীহত-এর আভিধানিক অর্থ হ’ল ইখলাছ বা পরিস্কার করা। যেমন تصحت العسل اذا صفيته ‘আমি মধু পরিস্কার করেছি’। পারিভাষিক অর্থে ‘নছীহত’ হ’ল إرادة جملة الخير ‘যাবতীয় কল্যাণ কামনা’। অন্য অর্থে قول فيه دعاء الي صلاح ونهى عن فساد ঐ সকল কথা যার মধ্যে কল্যাণের প্রতি আহবান ও ফাসাদের প্রতি নিষেধাজ্ঞা রয়েছে’ (আল-মু‘জাম)। মোটকথা ‘নছীহত’ শব্দ দ্বারা পরিচ্ছন্ন করা ও কল্যাণ মূলক উপদেশ বুঝানো হয়। এক্ষণে হাদীছে বর্ণিত বিভিন্ন পর্যায়ের নছীহত-এর তাৎপর্য বিষয়ে আমরা সংক্ষেপে আলোকপাত করার চেষ্টা পাব।

৫. (১)النَّصِيحَةُ لِلَّهِ ‘আল্লাহর জন্য নছীহত’ এর তাৎপর্য সম্পর্কে ইমাম খাত্ত্বাবী প্রমুখ বিদ্বানগণ বলেন যে, এর অর্থ আল্লাহর জন্য হৃদয়ে খালেছ ঈমান পোষণ করা ও শিরক হ’তে পরিচ্ছন্ন থাকা। এমনিভাবে যাবতীয় অন্যায়-অশ্লীলতা হ’তে পবিত্র থাকা। আল্লাহর জন্য ভালবাসা ও আল্লাহর জন্য বিদ্বেষ করা, আল্লাহর নেয়ামতসমূহ স্বীকার করা ও তাঁর জন্য কৃতজ্ঞতা পোষণ করা, আল্লাহ বিরোধীদের সাথে জিহাদ করা, সকল কাজ খুলূছিয়াতের সাথে সম্পন্ন করা, মানুষকে সদগুণাবলীর দিকে আহবান করা ও সকলের প্রতি সদয় ব্যবহার করা ইত্যাদি।

৫. (২) النَّصِيحَةُ لِكِتَابِهِ ‘আল্লাহর কেতাবের জন্য নছীহত’-এর তাৎপর্য হ’ল এ বিষয়ে হৃদয়ে পরিচ্ছন্ন ঈমান পোষণ করা যে, আল্লাহর কালাম কোন মানুষের কালামের সদৃশ নয়। অনুরূপ কালাম কোন সৃষ্টির পক্ষে সম্ভব নয়। অতঃপর আল্লাহর কিতাবকে যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন করতে হবে ও শ্রদ্ধাবনত চিত্তে তেলাওয়াত করতে হবে। এর ‘মুহকাম’ বা স্পষ্ট আয়াত সমূহের অর্থ বুঝতে হবে। তার আদেশ-নিষেধের উপরে আমল করতে হবে ও ‘মুতাশাবিহ’ বা অস্পষ্ট অর্থবোধক আয়াত সমূহের উপরে ঈমান রাখতে হবে যে, এগুলির প্রকৃত তাৎপর্য কেবলমাত্র আল্লাহ জানেন। অমুসলিম বিদ্বানদের অহংকার চূর্ণ করার জন্যই এগুলি নাযিল হয়েছে। কিতাবে বর্ণিত বিজ্ঞানময় আয়াত সমূহে গবেষণা করতে হবে। তা থেকে আলো নিয়ে সমাজ পরিশুদ্ধ করার সাধ্যমত চেষ্টা চালাতে হবে।

৫. (৩) النَّصيْحَةُ لِرَسُوْلِهِ ‘রাসূলের জন্য নছীহত’-এর তাৎপর্য হ’ল রাসূল যে আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ এবং তিনি আল্লাহর পক্ষ হ’তে যা কিছু নিয়ে আগমন করেছেন, সবটুকুই অভ্রান্ত সত্য- এ বিষয়ে হৃদয়ে খালেছ ঈমান পোষণ করা, রাসূলকে যারা ভালবাসে তাদেরকে ভালবাসা, তাঁকে যারা শত্রু ভাবে তাদেরকে শত্রু ভাবা, রাসূলের সুন্নাতকে অাঁকড়ে ধরা ও মোর্দা সুন্নাত যেন্দা করা। রাসূলের হাদীছসমূহের প্রচার ও প্রসার ঘটানো। হাদীছের উপরে গবেষণা করা ও সেখান থেকে আলো গ্রহণ করা। হাদীছ পাঠ ও পঠনের সময় উত্তম আদব বজায় রাখা। হাদীছের অনুসারীদেরকে সম্মান করা, হাদীছ অনুযায়ী নিজের সার্বিক জীবন গড়ে তোলা। হাদীছ বিরোধীদেরকে ও সুন্নাতের শত্রু বিদ‘আতীদেরকে ঘৃণা করা। রাসূল পরিবারকে ও রাসূলের সাথী ছাহাবায়ে কেরামকে ভালোবাসা ও তাদের পক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করা।

৫. (৪) النَّصيْحَةُ لِاُئمَّةِ الْمُسْلِمِيْنَ ‘মুসলিম নেতাদের জন্য নছীহত’-এর তাৎপর্য হ’ল যাবতীয় ন্যায় কাজে তাদের সহযোগিতা করা, তাদের প্রতি পূর্ণ আনুগত্য বজায় রাখা, দরদের সঙ্গে তাদেরকে হক পথে চলার উপদেশ দেওয়া, তাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ না করা কিংবা বিদ্রোহে উস্কানি না দেওয়া। জনগণকে তাদের প্রতি আনুগত্যে উদ্বুদ্ধ করা। তাদের সঙ্গে মিলে জিহাদে যোগদান করা এবং সর্বদা তাদের মঙ্গলের ও হেদায়াতের জন্য আন্তরিকভাবে দো‘আ করা।

৫. (৫) النَّصيْحَةُ لِعَامَّةِ الْمُسْلِمِيْنَ ‘সাধারণ মুসলমানদের জন্য নছীহত’-এর তাৎপর্য হ’ল তাদের ইহকাল ও পরকালের মঙ্গলের জন্য পথ প্রদর্শন করা। তাদের কল্যাণে সর্বদা অন্তরকে খোলাছা রাখা। মহববতের সঙ্গে সর্বদা ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়ের নিষেধ করা। বড়দের সম্মান ও ছোটদের স্নেহ করা, তাদের জন্য ঐ বস্ত্তকে ভালোবাসা যা নিজের জন্য ভালোবাসা যায়। তাদের জন্য ঐ বস্ত্তকে অপসন্দ করা যা নিজের জন্য অপসন্দ করা হয়। কথা ও কাজের মাধ্যমে তাদের জান, মাল ও ইযযতের হেফাযতের ব্যবস্থা করা। তাদের ঈমান ও আখলাক তথা নৈতিক মূল্যবোধকে উন্নত রাখার জন্য সর্বাবস্থায় সর্বোত্তম প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা।

‘নছীহত’ করা ফরযে কেফায়াহ। কিছুলোক করলে অন্যদের পক্ষ থেকে তা যথেষ্ট হয়। কিন্তু কেউ না করলে সকলে দায়ী হয়। কখনো কখনো উহা ‘ফরযে আয়েন’ হয়ে যায়, যখন অন্যায় বিজয়ী হয় ও ন্যায়নীতি সর্বত্র পরাভূত হয়। একজন পথভ্রষ্ট ব্যক্তিকে পথে আনার জন্য নছীহত বা উপদেশ হ’ল সর্বোত্তম পন্থা। নবীগণ এ পথেই জীবনপাত করেছেন। এই নছীহতকেই অন্যকথায় ‘দাওয়াত’ বলা হয়েছে।

৬. ব্যাখ্যা : অত্র হাদীছটি মৌলিক হেদায়াত সম্বলিত অন্যতম প্রসিদ্ধ হাদীছ। ইসলামের শাশ্বত নীতিমালা এর মধ্যে ফুটে উঠেছে। বিশেষ করে যারা ইসলামকে জঙ্গী আদর্শ ভাবতে অভ্যস্ত, অত্র হাদীছটি তাদের চোখ খুলে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট বলে মনে করি। হাদীছে ব্যবহৃত ‘নছীহত’ শব্দটি দুনিয়া ও আখেরাতে মঙ্গল কামনার উদ্দেশ্যে প্রযোজ্য আরবী ভাষায় সবচাইতে সারগর্ভ ও তাৎপর্য মন্ডিত শব্দ। উক্ত মর্মে এর চেয়ে সুন্দর কোন শব্দ আরবী ভাষায় নেই। ইসলাম তরবারি দ্বারা প্রতিষ্ঠা লাভ করেনি। বরং তার নিজস্ব আদর্শিক স্বাতন্ত্র্য ও মাহাত্ম্যই তাকে দুনিয়ার মানুষের হৃদয়ে স্থান দান করেছে। দাওয়াত ও নছীহ’তের মাধ্যমে ইসলাম ক্ষুধিত মানবতার অন্তর স্পর্শ করেছে। মানুষকে দুনিয়া থেকে আখেরাত মুখী করার মাধ্যমে তার নৈতিক মূল্যবোধকে সমুন্নত করেছে। তাকে সত্যিকারের মানুষে পরিণত করেছে। ইসলামের নবী (ছাঃ) দারোগা হয়ে আসেননি। বরং তিনি এসেছিলেন মানবতার ‘শিক্ষক’ হিসাবে ও ‘দাঈ ইলাল্লাহ’ হিসাবে, ‘রাহমাতুল্লিল আলামীন’ হিসাবে। অতএব তাঁর পথের অনুসারীদের জন্য অত্র হাদীছটি অন্ধকার রজনীতে ধ্রুবতারা হিসাবে পথ নির্দেশ দান করবে। সমাজবিরোধী দুষ্কৃতিকারীদেরকে দমন করে সমাজদেহকে সুস্থ রাখার জন্য ইসলামে জিহাদের নির্দেশ রয়েছে কেবলমাত্র সমাজের কল্যাণের স্বার্থেই। তাই ইসলামী ন্যায়বিচার ও জিহাদকে ভয় পায় কেবল তারাই, যারা অন্যায়-অপকর্মে অভ্যস্ত এবং মুখোশধারী সমাজনেতা। নছীহ’তে যখন কাজ হয় না, তখন আইনানুগ সরকারী কর্তৃপক্ষের মাধ্যমেই কেবল ইসলামী ন্যায় বিচার বাস্তবায়িত হয়। নতুবা দাওয়াত ও নছীহত পর্যন্তই মুমিনের দায়িত্ব সীমায়িত। এর বাইরে ধৈর্য ধারণ করা ব্যতীত ও আল্লাহর রহমত ও গায়েবী মদদ কামনা ব্যতীত তার আর কিছুই করার নেই।


[1]. মুসলিম হা/৫৫; মিশকাত হা/৪৯৬৬।

[2]. মুওয়াত্ত্বা হা/৩৭৯; মিশকাত হা/১৩০২ ‘ছালাত’ অধ্যায়।

[3]. তিরমিযী হা/৮৮৯; আবুদাঊদ হা/১৯৪৯; ইবনু মাজাহ হা/৩০১৫; মিশকাত হা/২৭১৪; ইরওয়া হা/১০৬৪।