নিরাপদ সমাজ গড়ে তোল

عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ - صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ- الْمُسْلِمُ مَنْ سَلِمَ الْمُسْلِمُونَ مِنْ لِسَانِهِ وَيَدِهِ وَالْمُؤْمِنُ مَنْ أَمِنَهُ النَّاسُ عَلَى دِمَائِهِمْ وَأَمْوَالِهِمْ- وزاد البيهقي في شعب الإيمان برواية فضالة- وَالْمُجَاهِدُ مَنْ جَاهَدَ نَفْسَهُ فِي طَاعَةِ اللهِ، وَالْمُهَاجِرُ مَنْ هَجَرَ الْخَطَايَا وَالذَّنُوبَ-

১. অনুবাদ : হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, প্রকৃত মুসলিম সেই, যার যবান ও হাত থেকে অন্য মুসলমান নিরাপদ থাকে এবং প্রকৃত মুমিন সেই, যার থেকে লোকেরা তাদের রক্ত ও মাল সম্পদকে নিরাপদ মনে করে’। বায়হাক্বী ‘শু‘আবুল ঈমান’-এর মধ্যে ফাযালা (রাঃ)-এর বর্ণনা অনুযায়ী বৃদ্ধি করেন যে, ‘প্রকৃত মুজাহিদ সেই, যে ব্যক্তি নিজের প্রবৃত্তিকে আল্লাহর আনুগত্যে ধরে রাখার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায় এবং প্রকৃত মুহাজির সেই, যে ছোট-বড় গোনাহ সমূহ হ’তে বিরত থাকে।[1] 

২. সনদ : তিরমিযী অত্র হাদীছটির সনদ ‘হাসান ছহীহ’ বলেছেন। তিরমিযী ও নাসাঈ হাদীছটিকে স্ব স্ব কিতাবে ‘ঈমান’ অধ্যায়ে এনেছেন। হাদীছটি আহমাদ, হাকেম ও ইবনু হিববানও সংকলন করেছেন। অতঃপর ফাযালা (রাঃ) বর্ণিত বায়হাক্বীর হাদীছটি হাকেম ছহীহ মুসলিমের শর্তানুযায়ী স্বীয় মুস্তাদরাকে সংকলন করেছেন। অনুরূপভাবে ইবনু হিববান তাঁর ছহীহ-এর মধ্যে, আহমাদ স্বীয় মুসনাদে এবং ত্বাবারাণী কাবীরে সংকলিত হয়েছে (মির‘আত)

৩. সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা : অত্র হাদীছটি সম্পর্কে ছাহেবে মিরক্বাত আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী হানাফী (মৃ. ১০১৪ হি.) বলেন,وَهُوَ حَدِيثٌ جَلِيلٌ اشْتَمَلَ عَلَى أُصُولٍ كَثِيرَةٍ فِي الدِّينِ ‘এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হাদীছ, যা দ্বীনের বহু মূলনীতিকে শামিল করে’। অত্র হাদীছে সত্যিকারের ‘মুসলিম’ ‘মুমিন’ ‘মুজাহিদ’ ও ‘মুহাজির’ সম্পর্কে মৌলিক ব্যাখ্যা দান করা হয়েছে। সংক্ষিপ্ত কথার মধ্যে যা হাযার কথাকে শামিল করে। سِلْمٌ ধাতু হ’তে إِسْلاَمٌ-এর উৎপত্তি। যার অর্থ শান্তি। জগত সংসারে শান্তি স্থাপনের জন্যই ইসলামের আগমন ঘটেছে। ইসলামের শান্তির বারতা যারা গ্রহণ করে ও তদনুযায়ী আমল করে, তারাই মুসলিম। যাদের মূল উদ্দেশ্য সমাজে শান্তি ও শৃংখলা কায়েম করা। কিন্তু ইসলাম গ্রহণের পরেও যদি কেউ সমাজে শান্তির বদলে অশান্তি কায়েম করে, শৃংখলার বদলে বিশৃংখলা সৃষ্টি করে, তবে সে প্রকৃত অর্থে আর ‘মুসলিম’ থাকে না। ঐ ব্যক্তি আল্লাহর উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সহায়ক থাকে না। বরং ইসলামের দাবীদার হয়ে অশান্তির নায়ক হওয়ার কারণে সে আল্লাহর অধিক ক্রোধের শিকার হয়।

মানুষের উপকার ও ক্ষতি করার প্রধান মাধ্যম হ’ল দু’টি : যবান ও হাত। যবান বলতে এখানে কথা ও কলম বুঝতে হবে। এ দু’টিই মনের ভাব প্রকাশের প্রধান মাধ্যম। যবানের কথা অস্থায়ী। কিন্তু কলম স্থায়ী। তাই কলমের গুরুত্ব আরও বেশী। অবশ্য যবানের প্রতিক্রিয়াটা হয় নগদ। কিন্তু কলমের প্রতিক্রিয়া হয় দেরীতে। সেদিক দিয়ে বিবেচনা করলে যবান সরাসরি ফলদায়ক। মুখের কথা শুনে মানুষ কাঁদে ও হাসে। আল্লাহর নবী (ছাঃ) এজন্য বলেছেন, إِنَّ مِنَ الْبَيَانِ لَسِحْرًا ‘নিশ্চয়ই কিছু কথার মধ্যে জাদু আছে’।[2] আরব দূরদর্শী চিন্তাবিদের জ্ঞানগর্ভ লেখনী পড়ে একটি দেশে বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে, এরূপ নযীরও পৃথিবীতে রয়েছে। তাই যবান ও কলমের মাধ্যমে যেমন উপকার করা যায়, তেমনি ক্ষতিও করা যায়। মুসলমান তার যবান ও কলমকে সমাজের কল্যাণে ব্যয় করে। সমাজের ভ্রান্ত বিশ্বাস ও কুসংস্কার দূরীকরণে প্রচেষ্টা চালায়। সমাজ সংস্কারে সার্বিক প্রচেষ্টায় নিয়োজিত করে। আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) এজন্য বলেন,جَاهِدُوا الْمُشْرِكِينَ بِأَمْوَالِكُمْ وَأَنْفُسِكُمْ وَأَلْسِنَتِكُمْ- ‘তোমরা জিহাদ কর মুশরিকদের বিরুদ্ধে তোমাদের মাল দ্বারা, জান দ্বারা ও যবান দ্বারা’।[3]

মুসলমানের যবান ও কলমের হিসাব আল্লাহর নিকটে দিতে হয়। যেমন আল্লাহ বলেন, كِرَامًا كَاتِبِينَ- يَعْلَمُونَ مَا تَفْعَلُونَ- ‘সম্মানিত লেখকবৃন্দ’। ‘তারা জানেন তোমরা যা কর’ (ইনফিত্বার ৮২/১১-১২)। অন্যত্র বলা হয়েছে, وَإِنْ تُبْدُوا مَا فِي أَنْفُسِكُمْ أَوْ تُخْفُوهُ يُحَاسِبْكُمْ بِهِ اللهُ ‘আর তোমাদের অন্তরে যা রয়েছে, তা তোমরা প্রকাশ কর বা গোপন কর, তোমাদের কাছ থেকে আললাহ তার হিসাব নিবেন’ (বাক্বারাহ ২/২৮৪)। সেকারণ মুসলমান বাজে কথা বলতে পারে না, বাজে কথা লিখতে পারে না। ব্যক্তি বা সমাজের কল্যাণ নেই, এমন কথা ও লেখা মুসলমানের দ্বারা সম্ভব নয়।

অমনিভাবে হাত-এর গুরুত্ব ইসলামে অত্যন্ত অধিক। হাত দ্বারা লিখতে হয় ও কাজ করতে হয়। মুমিনের অধিকাংশ আমল হাত দ্বারাই সম্পন্ন হয়। বরং মনের কল্পনা হাত দ্বারাই বাস্তবায়িত হয়। হাত-এর সঙ্গে পা ও দেহের অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যুক্ত থাকলেও হাত-ই মুখ্য ভূমিকা পালন করে বিধায় এখানে হাত-এর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া হাত বলতে নিজের হাত না-ও হ’তে পারে বরং অন্যের হাত দিয়েও কাজ করানো যেতে পারে। সে কাজ ভাল হ’তে পারে বা মন্দ হ’তে পারে।

মোটকথা এখানে হাত-এর দ্বারা কোন কাজের বাস্তবায়ন বুঝানো হয়েছে। নিজের হাতে পাপ বা পূণ্য করলে যে ফল হবে অন্যের হাত দিয়ে করিয়ে নিলেও সেই একই ফল লাভ হবে। অতএব নিজে করান বা অন্যের দ্বারা করান, কাজের ফলাফল উভয় ক্ষেত্রে সমান। বর্তমানের সরকারী ও বিরোধী দলীয় রাজনৈতিক সমাজ ব্যবস্থায় নেতা ও কর্মীরা অত্র হাদীছটির উপরে আমল করলে সমাজের বর্তমান অশান্তি বহুলাংশে লাঘব হ’ত। ধর্মীয় দলগুলির নেতা-কর্মীদের অবস্থা বরং আরও করুণ। স্ব স্ব দলীয় মুখপত্রে অথবা বই-পুস্তিকায় ও পত্র-পত্রিকায় একে অপরের বিরুদ্ধে তাঁরা এমন সব কথাবার্তা লেখেন, যা ইসলামের কোন বিধানের আওতায় পড়ে না। অথচ কুরআন-হাদীছের অপব্যাখ্যা করেই তারা প্রতিপক্ষকে পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে আক্রমণ করে থাকেন, যা স্থায়ী গীবতের শামিল, যার পরকালীন ফলাফল অতীব ক্ষতিকর। রাজনৈতিক ধর্মীয় নেতাগণ কেউই আল্লাহর গ্রেফতারী হ’তে মুক্তি পাবেন না। অতএব স্ব স্ব যবান ও কলমকে সঠিকভাবে ব্যবহার করার দিকে সকলের যত্নবান হওয়া উচিত।

নেতাদের এইসব খেস্তি-খিউড় সমাজের সাধারণ মানুষের মধ্যেও প্রভাব বিস্তার করছে। ফলে আজকাল সামান্য কথা কাটাকাটিতেই খুন-খারাবীর মত জঘন্য ঘটনা ঘটছে। অথচ রাসূল (ছাঃ) বলেন,مَنْ حَمَلَ عَلَيْنَا السِّلاَحَ فَلَيْسَ مِنَّا ‘যে আমাদের দিকে অস্ত্র উত্তোলন করল, সে আমাদের দলভুক্ত নয়’।[4] অথচ অস্ত্রবাজি এখন খেলনায় পরিনত হয়েছে। বড়-ছোট সম্মান ও স্নেহবোধ আমাদের কথা ও কাজে দেখা যায় না। ফলে শিক্ষক ছাত্র একত্রে বসে সিগারেট পান করে। পরস্পরকে ‘ভাই’ ডেকে সাম্য প্রতিষ্ঠা করে। এটা সাম্য নয় বরং এর মধ্যে লুকিয়ে আছে সমাজের ধ্বংসের বীজ। ফলে আজ ছেলের হাতে পিতা খুন হচ্ছেন, ছাত্রের হাতে শিক্ষক লাঞ্ছিত হচ্ছেন, কর্মচারীর হাতে কর্মকর্তা প্রহৃত হচ্ছেন। অফিস-আদালতে চরম বিশৃংখলা ও সন্ত্রাস মাথাচাড়া দিয়েছে। পারস্পরিক সম্মান ও মর্যাদাবোধ সুস্থ সমাজের গ্যারাণ্টি। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, أَنْزِلُوا النَّاسَ مَنَازِلَهُمْ ‘তোমরা মানুষকে তার মর্যাদা অনুযায়ী সম্মান দাও’।[5] মুসলমানদের কথা ও কাজে নিশ্চিতভাবেই এর প্রমাণ থাকতে হবে। নইলে সমাজ রসাতলে যাবে।

২য়- মুমিন : ‘আমন’ ধাতু হ’তে ‘ঈমান’ শব্দের উৎপত্তি। যার অর্থ নিরাপত্তা। অতএব ‘মুমিন’ তিনিই হবেন যার নিকটে অন্য মানুষ নিরাপত্তা বোধ করবে। মানুষের জান, মাল ও ইযযত-এর নিরাপত্তা মুমিনের নিকটে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসাবে গণ্য হবে। নিজের অতি বড় শত্রুও যদি মুমিনের নিকটে আশ্রয় গ্রহণ করে তবুও মুমিন তার জান-মাল ও ইযযতের সামান্যতম ক্ষতি করতে পারে না। পিতৃহস্তাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে যে পুত্র, সেই হন্তা ভুলক্রমে সেই পুত্রের বাড়ীতে মেহমান হিসাবে আশ্রয় নিয়েছে। অথচ চিনতে পেরেও এবং হাতের মুঠোর মধ্যে পেয়েও তাকে সসম্মানে সমাদর ও আপ্যায়ন করে বিদায় করেছে এমন নযীর বিগত দিনে রয়েছে। অমনিভাবে অন্ধকার রজনীতে গভীর রাতে মরুভূমিতে পথহারা সুন্দরী তন্বী মহিলাকে একাকী পেয়েও মুমিন যুবক তাকে ‘মা’ সম্বোধন করে সসম্মানে উটের লাগাম টেনে গন্তব্যস্থলে পৌঁছে দিয়েছে এমন নযীর ইতিহাসে আমরা দেখেছি। চলতি ট্রেনে পার্শ্বের ইংরেজ যাত্রী লক্ষাধিক টাকার ব্যাগ ফেলে চলে গেছে, অথচ বাংলাদেশী জনৈক আলেম সেই ব্যাগটি ঠিকানা অনুযায়ী পৌঁছে দিয়েছেন, একটু ধন্যবাদেরও অপেক্ষা করেননি। দিল্লীর প্রচন্ড ইংরেজ বিদ্বেষী অসহযোগ আন্দোলনের সময় ভীত সন্ত্রস্ত এক ইংরেজ মহিলা জনৈক মুসলিম পন্ডিত খ্যাতনামা আলেমের ঘরে দীর্ঘ দু’মাস লুকিয়ে থাকলেন। অতঃপর তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাকে তার আত্মীয়দের নিকটে পৌঁছে দিলেন এমন বিরল ঘটনাও আমরা ইতিহাসে প্রত্যক্ষ করেছি। সত্যিকারের মুমিনের নিকটে এগুলি খুবই স্বাভাবিক ঘটনা।

সাধারণ মানুষের চাইতে প্রতিবেশীর হক আরও বেশী। প্রতিবেশীর নিরাপত্তার প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখা মুমিনের জন্য অপরিহার্য কর্তব্য হিসাবে ইসলামে বিশেষভাবে নির্দেশিত হয়েছে। এমনকি প্রতিবেশীর হক আদায়ের ব্যাপারে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এর উপরে এত বেশী বেশী তাকিদ সৃষ্টি করা হচ্ছিল যে, তিনি তাদের জন্য পরস্পরের সম্পত্তির ‘ওয়ারিছ’ হওয়ার ব্যাপারে আদেশ নাযিল হবে বলে আশংকা করছিলেন।[6] এটা এজন্য যে, প্রতিবেশীরাই হ’ল মানুষের সর্বাধিক নিকটতম ও পরস্পরের সুখ-দুঃখের সাথী। তাদের মধ্যে সদ্ভাব থাকলে বহু সমস্যা তারা নিজেরাই সমাধান করতে পারে। পরস্পরের সহযোগিতায় তাদের জীবন সুখময় হয়ে ওঠে। কিন্তু তার উল্টা হ’লে তাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। জীবন অশান্তিময় হয়। আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বলেন, وَاللهِ لاَ يُؤْمِنُ، وَاللهِ لاَ يُؤْمِنُ، وَاللهِ لاَ يُؤْمِنُ. قِيلَ: وَمَنْ يَا رَسُولَ اللهِ قَالَ: الَّذِى لاَ يَأْمَنُ جَارُهُ بَوَايِقَهُ ‘আল্লাহর কসম! ঐ ব্যক্তি মুমিন নয় (৩ বার), যার প্রতিবেশী তার অনিষ্টকারিতা হ’তে নিরাপদ নয়’।[7] অতএব মুমিনের প্রতিবেশী অবশ্যই মুমিনের নিকট থেকে তার জান-মাল ও ইযযতের নিরাপত্তা লাভ করবে এটাই ঈমানের দাবী।

কিন্তু পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র বাংলাদেশের মুসলমানগণ কি ঈমানের উক্ত দাবী পুরণ করতে পেরেছে? প্রতিদিনের সংবাদপত্রে সমাজের প্রতিবিস্ব প্রতিফলিত হয়। বাস্তবে যা দেখছি ও শুনছি তাতে এখন বাঘ-ভাল্লুকের চাইতে মানুষ মানুষকে বেশী ভয় করে। মুমিনের নিরাপদ নয়। প্রতিনিয়ত মুমিন-এর জান-মাল ও ইযযত লুণ্ঠিত হচ্ছে মুসলমান নামধারী আর এক নরপশুর হাতে। হিংসুক প্রতিবেশীর ভয়ে বাড়ীর মালিক অন্যকে বাড়ী ভাড়া দিয়ে কিংবা বাড়ী ছেড়ে অন্যত্র পালিয়ে বেড়াচ্ছে নিতান্ত অসহায়ভাবে। পাশের জমির মালিকের দোর্দন্ড প্রতাপে নিজের হক সম্পত্তির অধিকার নীরবে ছেড়ে দিয়ে চলে আসতে হচ্ছে মযলূম প্রতিবেশীকে। পশুত্বের চরম সীমায় নেমে গিয়ে মুমিন ও মুসলিম নামধারী এদেশের সংখ্যাগরিষ্ট মানুষ নিজেদেরকে যেমন পৃথিবীর সামনে নীচু করেছে। ঈমান ও ইসলামের উচ্চ মর্যাদাকে তেমনি ভুলুণ্ঠিত করেছে। এরা এদের দুনিয়াকে যেমন অশান্তিময় করে তুলেছে, আখেরাতেও তেমনি জাহান্নাম খরীদ করেছে। অথচ একবারও ভাবে না যে, এই রং-তামাশার পৃথিবী ছেড়ে তাকে চলে যেতে হবে কবরের গহীন অন্ধকারে। সেখানে গিয়েও অপেক্ষা করছে কঠিনতম আযাব। আর দুনিয়াতেও সে রেখে যাচ্ছে তার ছেলে-মেয়েদের ও আত্মীয়-পরিজনদের জন্য অপমানজনক বদনামের এক দুঃসহ জ্বালা। টাকা-পয়সার চাইতে ইযযত-সম্মান কি বড় নয়? মানুষ তার ইযযতের বিনিময়ে অর্থ-সম্পদ এমনকি জীবন পর্যন্ত হাসিমুখে উৎসর্গ করে থাকে। আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বলেন, تَعِسَ عَبْدُ الدِّينَارِ وَالدِّرْهَمِ ‘দীনার ও দিরহামের গোলামেরা ধ্বংস হৌক’।[8] আজ মুমিনদের ভাগ্যে সেই ধ্বংসের পালা শুরু হয়েছে। অতএব দুনিয়ামুখী স্বার্থপরতা পরিহার করে আখেরাতমুখী প্রবণতা সৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত সমাজের মুক্তি নেই।

৩য় মুজাহিদ : ‘জুহ্দ’ ধাতু হ’তে ‘জিহাদ’ শব্দের উৎপত্তি। যার অর্থ সর্বাত্মক প্রচেষ্টা। সেখান থেকে এসেছে ‘মুজাহিদ’ অর্থাৎ চূড়ান্ত প্রচেষ্টাকারী। জিহাদের দু’টি দিক রয়েছে। একটি অন্তর্মুখী। যার দ্বারা আধ্যাত্মিক প্রচেষ্টা বা সাধনা বুঝানো হয়। অন্যটি বহির্মুখী। যার দ্বারা জান-মাল নিয়ে দ্বীনের সার্বিক বাস্তবায়নে চূড়ান্ত প্রচেষ্টা বুঝায়। ইসলামী পরিভাষায় ‘জিহাদ’ উপরোক্ত দু’টি বিষয়কেই শামিল করে।

অত্র হাদীছে একটি মৌলিক ব্যাখ্যা দিয়ে বলা হয়েছেمَنْ جَاهَدَ نَفْسَهُ فِى طَاعَةِ اللهِ ‘যে ব্যক্তি তার নফসকে আল্লাহর আনুগত্যে ধরে রাখার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায়’। কারণ মানুষের স্বভাবগত প্রবণতা হ’ল অন্যায়মুখী। যেমন বলা হয়ে থাকে الْإِنْسَان حَرِيص على مَا منع ‘নিষেধকৃত বিষয়ের দিকেই মানুষ অধিক প্রলুব্ধ হয়’। এই প্রবণতাকে আল্লাহর আনুগত্যে ধরে রাখার জন্য সর্বদা আধ্যাত্মিক সাধনা প্রয়োজন। আর সে লক্ষ্যেই দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত ফরয করা হয়েছে। এছাড়াও রয়েছে নফল ছালাত, ছিয়াম ইত্যাদি। বরং বলা চলে যে, ইসলামের দৈহিক ও আর্থিক সকল ইবাদতের মূল উদ্দেশ্যই হ’ল ‘তাযকিয়ায়ে নফস’ বা আত্মশুদ্ধি। অনেকে শরী‘আতের দেওয়া নিয়ম-পদ্ধতির বাইরে গিয়ে নিজেদের কপোলকল্পিত আধ্যাত্মিক সাধনার রকমারি ‘তরীকা’ আবিষ্কার করেছেন। যা ‘মা‘রেফাত’ বিদ্যা নামে সমাজে চালু হয়েছে। এটি ইসলামের নামে আবিষ্কৃত বিদ‘আত বৈ কিছুই নয়। রাসূল (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরাম ছালাত-ছিয়াম ইত্যাদি ইবাদতের মাধ্যমেই আধ্যাত্মিক সাধনা করেছেন। তাঁরাই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মুমিন ও শ্রেষ্ঠ মানুষ। তাঁদের অনুসরণ করার মধ্যেই আমাদের মুক্তি। যদি কেউ তাঁদের রেখে যাওয়া তরীকায় আধ্যাত্মিক সাধনা করে তৃপ্ত হ’তে না পারেন, তাহ’লে বুঝতে হবে শয়তান তার ঘাড়ে সওয়ার হয়েছে ও তাকে দ্বীনের সহজ-সরল রাস্তা থেকে বিভ্রান্ত করার জন্য ধর্মের নামে ধোকা দিচ্ছে। অতএব অতি ধার্মিকতা থেকে দূরে থাকা ভাল। ইহুদী নাছারাগণ এই বাড়াবাড়ির কারণেই অভিশপ্ত ও বিভ্রান্ত হয়েছে। আমাদেরকেও সাবধান করা হয়েছে এই বলে যে, لاَ تَغْلُوا فِي دِينِكُمْ ‘তোমরা তোমাদের দ্বীনের মধ্যে বাড়াবাড়ি করো না’ (নিসা ৪/১৭১)

ছাহেবে মিরক্বাত অত্র হাদীছে বর্ণিত ‘জিহাদ’ কে ‘জিহাদে আকবর’ বা বড় জিহাদ বলেছেন। এর কারণ আল্লাহ ও আল্লাহর দ্বীনের প্রতি আনুগত্যের জোশ যদি ভিতর থেকে উৎসারিত না হয়, তাহ’লে বাইরে শক্তি ও সাহস দুর্বল হয়ে যায়। যুদ্ধের ময়দানে দ্বীনের জন্য মুমিন তখনই হাসিমুখে জান দিবে, যখন হৃদয়ে জান্নাত পাওয়ার আবেগ ও আগ্রহ সৃষ্টি হবে। আর সেই আবেগ সৃষ্টির জন্য প্রয়োজন ছালাত-ছিয়ামের গভীর আধ্যাত্মিক সাধনায় আত্মনিয়োগ করা ও এর মাধ্যমে নিজের ঈমান ও আত্মশক্তিকে বলীয়ান করা। আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বলেন,لا يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى يَكُونَ هَوَاهُ تَبَعًا لِمَا جِئْتُ بِهِ ‘তোমাদের কেউ মুমিন হ’তে পারবে না যতক্ষণ না তার প্রবৃত্তি আমার আনীত শরী‘আতের অনুগত হবে’।[9]

৪. ‘মুহাজির’ : ‘হিজরাতুন’ ধাতু হ’তে ‘মুহাজির’ শব্দের উৎপত্তি। ‘হিজরত’ অর্থ পরিত্যাগ করা। এক দেশ থেকে অন্য দেশে ইসলামের কারণে হিজরতকারী অর্থে ‘মুহাজির’ শব্দ ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ‘মুহাজির’ এবং সাধারণ উদ্বাস্ত্ত কখনই এক নয়। স্বাধীনভাবে ইসলামী জীবন যাপনের উদ্দেশ্যে ও একমাত্র ইসলামের স্বার্থেই যারা এক এলাকা হ’তে অন্য এলাকায় হিজরত করেন, ইসলামে কেবল তারাই ‘মুহাজির’ হিসাবে অভিহিত হয়ে থাকেন। এটা মুহাজির-এর বাহ্যিক পরিভাষা। অত্র হাদীছে মুহাজির-এর আভ্যন্তরীন ও মৌলিক অর্থ ব্যাখ্যা করা হয়েছে এই বলে যে, প্রকৃত মুহাজির সেই, যে যাবতীয় গোনাহ-খাতা হ’তে মুক্ত থাকে। কেবল কবীরা গোনাহ হ’তে মুক্ত হওয়াই যথেষ্ট নয় বরং ছগীরা গোনাহ হ’তেও বেঁচে থাকার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করা প্রকৃত মুমিন ও প্রকৃত মুহাজিরের অবশ্য কর্তব্য। জেনে রাখা ভাল যে, ছগীরা গোনাহ বারবার করলে তা কবীরা গোনাহে পরিণত হয়। অতএব আসুন আমরা মৃত্যুর আগেই সাবধান হই।

পরিশেষে বলব, নিরাপদ জীবনের জন্য নিরাপদ সমাজ প্রয়োজন। আর নিরাপদ সমাজের জন্য উপরোক্ত গুণাবলী অর্জন অপরিহার্য। ব্যক্তিগতভাবে যেমন আমাদেরকে উপরোক্ত গুণাবলী অর্জনের চেষ্টা নিতে হবে, অমনিভাবে প্রশাসনিকভাবে উপরোক্ত গুণাবলী বাস্তবায়নের জন্য কঠোরভাবে পদক্ষেপ নিতে হবে। নইলে শুধুমাত্র নীতি কথায় নরপশুগুলোকে পথে আনা যাবে না। ইসলামের দূরদর্শী আইনগুলি বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব মুসলমানদের নির্বাচিত সরকারের। কিন্তু তাঁরা কি তা করবেন? নাকি নবী (ছাঃ)-এর ভাষায় ‘গাশ্শুন’ বা খেয়ানতকারী হয়ে জান্নাত থেকে বঞ্চিত[10] হিসাবে বঙ্গভবন হ’তে কবর অভিমুখে বিদায় নেবেন?


[1]. তিরমিযী হা/২৬২৭; নাসাঈ হা/৪৯৯৫; আহমাদ হা/৮৯১৮; ছহীহ ইবনু হিববান হা/১৮০; বায়হাক্বী, শো‘আব হা/১১১২৩; হাকেম হা/২৪; মিশকাত হা/৩৩-৩৪ ‘ঈমান’ অধ্যায়।

[2]. বুখারী হা/৫৭৬৭; মিশকাত হা/৪৭৮৩।

[3]. নাসাঈ হা/৩০৯৬; আবুদাঊদ হা/২৫০৪; দারেমী হা/২৪৩১; হাকেম হা/২৪২৭; মিশকাত হা/৩৮২১।

[4]. বুখারী হা/৭০৭০; মুসলিম হা/১০১; মিশকাত হা/৩৫২০।

[5]. আবুদাঊদ হা/৪৮৪২; মিশকাত হা/৪৯৮৯; যঈফাহ হা/১৮৯৪।

[6]. বুখারী হা/৬০১৪; মুসলিম হা/২৬২৫; মিশকাত হা/৪৯৬৪।

[7]. বুখারী হা/৬০১৬; মিশকাত হা/৪৯৬২।

[8]. বুখারী হা/২৮৮৬; মিশকাত হা/৫১৬১।

[9]. শারহুস সুন্নাহ হা/১০৪; মিশকাত হা/১৬৭; আলবানী, যিলালুল জান্নাহ হা/১৫ সনদ ‘যঈফ’।

[10]. বুখারী হা/৭১৫১; মিশকাত হা/৩৬৮৬।