বড় পরীক্ষায় বড় পুরস্কার

عَنْ أَنَسٍ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ- إِنَّ عِظَمَ الْجَزَاءِ مَعَ عِظَمِ الْبَلاَءِ وَإِنَّ اللهَ إِذَا أَحَبَّ قَوْمًا ابْتَلاَهُمْ فَمَنْ رَضِىَ فَلَهُ الرِّضَا وَمَنْ سَخِطَ فَلَهُ السَّخَطُ-

অনুবাদ : হযরত আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, নিশ্চয়ই বড় পুরস্কার বড় পরীক্ষার ফলে হয়ে থাকে। আল্লাহপাক যখন কোন কওমকে ভালবাসেন, তখন তাদেরকে পরীক্ষায় ফেলেন। যে ব্যক্তি সেই পরীক্ষায় সন্তুষ্ট থাকে, তার জন্য থাকে আল্লাহর সন্তুষ্টি। আর যে ব্যক্তি অসন্তুষ্ট হয়, তার জন্য থাকে আল্লাহর অসন্তুষ্টি’।[1]

সনদ : ইমাম তিরমিযী অত্র হাদীছটিকে বর্তমান সনদ অনুযায়ী ‘হাসান গরীব’ বলেছেন। রিয়াযুছ ছালেহীন-এর টীকাকার শু‘আয়েব আরনাঊত্ব বলেন, এই হাদীছটি তাবারাণী ও হাকেম বর্ণনা করেছেন আব্দুল্লাহ বিন মুগাফফাল (রাঃ) হ’তে, ত্বাবারাণী আম্মার বিন ইয়াসার হ’তে এবং ইবনু আদী আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে। এই সকল সমর্থনের কারণে হাদীছটি ‘ছহীহ’।[2]

ব্যাখ্যা : পৃথিবীতে বড় কিছু অর্জন করতে গেলে বড় কিছু বর্জন করতে হয়। বড় কোন পুরস্কার পেতে গেলে বড় ধরণের পরীক্ষা দিতে হয়। ১ম শ্রেণীর বই পড়ে কেউ এম.এ ডিগ্রী লাভ করতে পারে না। মুমিনের সবচেয়ে বড় পুরস্কার হ’ল জান্নাত লাভ, যা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ব্যতীত সম্ভব নয়। জান্নাতের মহা পুরস্কার লাভ করতে গেলে দুনিয়াতে বড় বড় পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হ’তে হয়। বড় বড় মুছীবতে গ্রেফতার হ’তে হয় ও আল্লাহর উপরে ভরসা রেখে গভীর ধৈর্যের সাথে তাতে উত্তীর্ণ হ’তে হয়। রাসূল (ছাঃ) বলেন,الدُّنْيَا سِجْنُ الْمُؤْمِنِ وَجَنَّةُ الْكَافِرِ- ‘মুমিনের জন্য তাই দুনিয়া কারাগার সদৃশ ও কাফিরের জন্য জান্নাত সদৃশ।[3] বিভিন্নমুখী বিপদাপদ মুকাবিলা করতে করতে মুমিন এক সময় যখন মৃত্যুবরণ করবে, তখন তার আর কোন গোনাহ থাকবে না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,

مَا يَزَالُ الْبَلاَءُ بِالْمُؤْمِنِ وَالْمُؤْمِنَةِ فِى نَفْسِهِ وَوَلَدِهِ وَمَالِهِ حَتَّى يَلْقَى اللهَ وَمَا عَلَيْهِ خَطِيئَةٌ- ‘মুমিন নর-নারীর নিজ জীবন, সন্তানাদি ও মাল-সম্পদে সর্বদা বালা-মুছীবত লেগে থাকবে। অতঃপর সে আল্লাহর সাথে মিলিত হবে এমন অবস্থায় যে, তার উপরে কোন গোনাহ থাকবে না।[4]

পক্ষান্তরে দুষ্ট লোকদেরকে তাদের সীমাসংঘনে ছেড়ে দেওয়া হবেاللهُ يَسْتَهْزِئُ بِهِمْ وَيَمُدُّهُمْ فِي طُغْيَانِهِمْ يَعْمَهُونَ- ‘বরং আল্লাহ তাদের উপহাসের বদলা নেন এবং তাদেরকে তাদের অবাধ্যতার মধ্যে ছেড়ে দেন বিভ্রান্ত অবস্থায়’ (বাক্বারাহ ২/১৫)। অতঃপর ক্বিয়ামতের ময়দানে কঠিনভাবে পাকড়াও করা হবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,وَإِذَا أَرَادَ اللهُ بِعَبْدِهِ الشَّرَّ أَمْسَكَ عَنْهُ بِذَنْبِهِ حَتَّى يُوَفَّى بِهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ- ‘যখন আল্লাহ তার কোন বান্দার অমঙ্গল চান তখন তার গোনাহর বদলা নিজের কাছে আটকে রাখেন, যাতে ক্বিয়ামতের দিন পুরাপুরিভাবে তাকে বদলা দিতে পারেন’।[5]

এ দুনিয়াতে সর্বাধিক বিপদ গ্রস্থ কারা এমন একটি প্রশ্নের জওয়াবে রাসূলে করীম (ছাঃ) এরশাদ করেন,عَنْ مُصْعَبِ بْنِ سَعْدٍ عَنْ أَبِيهِ قَالَ قُلْتُ يَا رَسُولَ اللهِ أَىُّ النَّاسِ أَشَدُّ بَلاَءً قَالَ : الأَنْبِيَاءُ ثُمَّ الأَمْثَلُ فَالأَمْثَلُ فَيُبْتَلَى الرَّجُلُ عَلَى حَسَبِ دِينِهِ فَإِنْ كَانَ دِينُهُ صُلْبًا اشْتَدَّ بَلاَؤُهُ وَإِنْ كَانَ فِى دِينِهِ رِقَّةٌ ابْتُلِىَ عَلَى حَسَبِ دِينِهِ فَمَا يَبْرَحُ الْبَلاَءُ بِالْعَبْدِ حَتَّى يَتْرُكَهُ يَمْشِى عَلَى الأَرْضِ مَا عَلَيْهِ خَطِيئَةٌ ‘এ দুনিয়ায় সবচেয়ে কঠিন বিপদগ্রস্থ হ’লেন নবীগণ। তারপর ক্রমানুযায়ী সর্বোচ্চ নেককারগণ। মুমিন পরীক্ষিত হবে তার দ্বীন অনুযায়ী। যদি সে দ্বীনের বিষয়ে কঠিন হয়, তবে তার পরীক্ষা সেই অনুযায়ী কঠিন হবে। আর যদি সে দ্বীনের ব্যাপারে ঢিলা হয়, তার পরীক্ষা অনুরূপ হালকা হবে। মুমিনের উপরে এইভাবে পরীক্ষা চলতে থাকবে। এমন এক সময় আসবে যে, সে যমীনের উপরে চলাফেরা করবে এমন অবস্থায় যে, তার কোন গোনাহ থাকবে না’।[6]

কেননা তার বালা-মুছীবত তার গোনাহের কাফফারা হয়ে থাকে, যদি সে ঐ মুছীবতে সন্তুষ্ট থাকে। যেমন- রাসূল (ছাঃ) বলেন,مَا يُصِيبُ الْمُسْلِمَ مِنْ نَصَبٍ وَلاَ وَصَبٍ وَلاَ هَمٍّ وَلاَ حُزْنٍ وَلاَ أَذًى وَلاَ غَمٍّ حَتَّى الشَّوْكَةِ يُشَاكُهَا، إِلاَّ كَفَّرَ اللهُ بِهَا مِنْ خَطَايَاهُ- ‘মুমিন কোন ক্লান্তি, রোগ, দুশ্চিন্তা, দুঃখ, কষ্ট বা উদ্বিগ্নতা ভোগ করে না, এমন কি তার কোন কাঁটাও বিধে না, যেগুলির বিনিময়ে কাফফারা হিসাবে আল্লাহ তার গোনাহ মাফ করেন না’।[7]

মিল্লাতে ইসলামিয়ার পিতা ও তাওহীদবাদীদের বিশ্বনেতা হযরত ইবরাহীম (আঃ) চরম বিপদ-আপদ ও পরীক্ষার মধ্য দিয়ে জীবন কাটিয়েছেন। স্ত্রী ও পুত্র ব্যতীত জীবদ্দশায় তার কোন সাথী জোটেনি। তথাপি তিনি ছিলেন, একাই একটি উম্মত ও অনাগত ভবিষ্যতের সকল তাওহীদবাদীর একচ্ছত্র নেতা। এ নেতৃত্ব স্বয়ং আল্লাহ কর্তৃক ঘোষিত। এই নেতৃত্ব দেওয়ার পূর্বে আল্লাহ তাঁকে পরীক্ষার পরে পরীক্ষা করেছেন। এক্ষণে আমরা সেগুলি সংক্ষেপে আলোচনা করব।-

ইবরাহীমী পরীক্ষা সমূহ :

আল্লাহ বলেন,وَإِذِ ابْتَلَى إِبْرَاهِيمَ رَبُّهُ بِكَلِمَاتٍ فَأَتَمَّهُنَّ قَالَ إِنِّي جَاعِلُكَ لِلنَّاسِ إِمَامًا- ‘আর যখন ইবরাহীমকে তার প্রতিপালক কতগুলি বিষয়ে পরীক্ষা করলেন, অতঃপর সে তা পূর্ণ করল, তখন তার প্রতিপালক বললেন, আমি তোমাকে মানবজাতির নেতা করব’ (বাক্বারাহ ২/১২৪)। ইবরাহীমের এই নেতৃত্ব ছিল তাওহীদ ভিত্তিক জীবন যাপনের নেতৃত্ব। আল্লাহর আদেশ ও নিষেধ সমূহ মেনে চলার ক্ষেত্রে এক অতুলনীয় নেতৃত্ব। আর এই নেতৃত্বের সনদ তিনি লাভ করেন স্বয়ং আল্লাহর পক্ষ হ’তে। নইলে মানুষ তো তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। স্বীয় জীবদ্দশায় সমর্থকের সংখ্যা বিচারে তিনি ছিলেন ব্যর্থ। কিন্তু সত্যিকারের বিচারক মহান আল্লাহর সূক্ষ বিচারে তিনি ছিলেন মানবজাতির সত্যিকারের নেতা। এজন্য অন্যত্র আল্লাহ বলেন,إِنَّ إِبْرَاهِيمَ كَانَ أُمَّةً قَانِتًا لِلَّهِ حَنِيفًا وَلَمْ يَكُ مِنَ الْمُشْرِكِينَ- ‘নিশ্চয়ই ইবরাহীম ছিল একাই একটি উম্মত। যে ছিল আল্লাহর প্রতি বিনীত ও একনিষ্ঠ এবং সে কখনোই মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিল না’ (নাহল ১৬/১২০)। অর্থাৎ ইবরাহীমের সাথী কেউ না থাকলেও তিনি একাই ছিলেন একটি উম্মত। কেননা তাঁর জীবদ্দশায় না হ’লেও তাঁর পরবর্তী দীর্ঘ প্রলম্বিত যুগের অসংখ্য-অগণিত তাওহীদবাদী উম্মত সমূহের তিনি ছিলেন একচ্ছত্র নেতা।

হযরত ইবরাহীম (আঃ) যে সমস্ত পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছিলেন, পবিত্র কুরআন-এর বর্ণনা সমূহের আলোকে সাজালে তা নিম্নরূপ দাঁড়ায়।-

১. বড় হয়ে তিনি সর্বপ্রথম নিজ পিতা আযর-কে মূর্তিপূজা হ’তে বিরত থাকার দাওয়াত দেন, কেননা আযর ছিলেন তৎকালীন ইরাকের মূর্তিপূজারী সমাজের প্রধান ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব। পিতাকে উপদেশ দিয়ে পুত্র ইবরাহীম বলেন,يَا أَبَتِ لِمَ تَعْبُدُ مَا لاَ يَسْمَعُ وَلاَ يُبْصِرُ وَلاَ يُغْنِي عَنْكَ شَيْئًا- ‘হে পিতা! কেন তুমি ঐ বস্ত্তর পূজা কর যে শোনে না, দেখে না বা তোমার কোন কাজে আসে না’? (মারিয়াম ১৯/৪২)। অন্য আয়াতে এসেছে, ইবরাহীম বলেন,أَتَعْبُدُونَ مَا تَنْحِتُونَ- وَاللهُ خَلَقَكُمْ وَمَا تَعْمَلُونَ- ‘তোমরা তোমাদের হাতে গড়া মূর্তির পূজা করছ?’ ‘অথচ আল্লাহ তোমাদেরকে এবং যা কিছু তোমরা কর সবকিছুকে সৃষ্টি করেছেন’ (ছাফফাত ৩৭/৯৫-৯৬)। অন্য আয়াতে এসেছে তিনি তাঁর কওমকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন,هَلْ يَسْمَعُونَكُمْ إِذْ تَدْعُونَ- أَوْ يَنْفَعُونَكُمْ أَوْ يَضُرُّونَ- ‘তোমরা যখন ডাক তখন কি তারা শুনতে পায়’? ‘অথবা তারা কি তোমাদের উপকার বা ক্ষতি করতে পারে?’ (শু‘আরা ২৬/৭২-৭৩)

জওয়াবে তাঁর কওম বলেছিল, قَالُوا بَلْ وَجَدْنَا آبَاءَنَا كَذَلِكَ يَفْعَلُونَ ‘তারা বলল, না। তবে আমরা আমাদের বাপ-দাদাদের পেয়েছি তারা এরূপই করত’ (শু‘আরা ২৬/৭৪)। ইবরাহীমের পিতা আরও কঠোরভাবে বললেন, أَرَاغِبٌ أَنْتَ عَنْ آلِهَتِي يَا إِبْرَاهِيمُ لَئِنْ لَمْ تَنْتَهِ لَأَرْجُمَنَّكَ وَاهْجُرْنِي مَلِيًّا- ‘হে ইবরাহীম! তুমি কি আমার উপাস্যদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছ? যদি তুমি (তাদের গালি দেওয়া থেকে) বিরত না হও, তাহলে অবশ্যই আমি পাথরের আঘাতে তোমার মাথা ফাটিয়ে দেব। তুমি চিরদিনের মত আমার কাছ থেকে দূর হয়ে যাও!’ (মারিয়াম ১৯/৪৬)। পিতার রূঢ় মন্তব্যে হতাশ হয়ে ইবরাহীম তাকে লক্ষ্য করে বললেন, قَالَ سَلاَمٌ عَلَيْكَ سَأَسْتَغْفِرُ لَكَ رَبِّي إِنَّهُ كَانَ بِي حَفِيًّا- ‘ইবরাহীম বলল, তোমার প্রতি সালাম। সত্বর আমি তোমার জন্য আমার প্রতিপালকের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করব। নিশ্চয়ই তিনি আমার প্রতি অধিকতর দয়াশীল’ (মারিয়াম ১৯/৪৭)

অতঃপর নিজ কওমকে লক্ষ্য করে স্বীয় মা‘বূদ আল্লাহর পরিচয় দিয়ে দাওয়াতের ভঙ্গিতে বললেন,أَفَرَأَيْتُمْ مَا كُنْتُمْ تَعْبُدُونَ- أَنْتُمْ وَآبَاؤُكُمُ الْأَقْدَمُونَ- فَإِنَّهُمْ عَدُوٌّ لِي إِلاَّ رَبَّ الْعَالَمِينَ- الَّذِي خَلَقَنِي فَهُوَ يَهْدِينِ- وَالَّذِي هُوَ يُطْعِمُنِي وَيَسْقِينِ- وَإِذَا مَرِضْتُ فَهُوَ يَشْفِينِ- وَالَّذِي يُمِيتُنِي ثُمَّ يُحْيِينِ- وَالَّذِي أَطْمَعُ أَنْ يَغْفِرَ لِي خَطِيئَتِي يَوْمَ الدِّينِ- ‘তোমরা কি তাদের সম্পর্কে ভেবে দেখেছ যাদের পূজা তোমরা করে আসছ?’ ‘তোমরা এবং তোমাদের পূর্ববর্তী বাপড়-দাদারা?’ ‘তারা সবাই আমার শত্রুু, কেবল বিশ্বচরাচরের পালনকর্তা ব্যতীত’। ‘যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তিনিই আমাকে পথপ্রদর্শন করেছেন’। ‘যিনি আমাকে খাওয়ান ও পান করান’। ‘যখন আমি পীড়িত হই, তখন তিনিই আমাকে আরোগ্য দান করেন’। ‘আর তিনি আমাকে মৃত্যু দান করবেন। অতঃপর পুনরায় জীবিত করবেন’। ‘আমি আকাংখা করে যে, তিনি শেষ বিচারের দিন আমার পাপসমূহ ক্ষমা করবেন’ (শু‘আরা ২৬/৭৫-৮২)

উল্লেখ্য যে, ইবরাহীম (আঃ) তাঁর পিতার জন্য আল্লাহর নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলেন পিতার জীবদ্দশা পর্যন্ত। কিন্তু যখন তিনি মুশরিক অবস্থায় মৃত্যুবরণ করলেন, তারপর থেকে ইবরাহীম আর কখনও পিতার জন্য দো‘আ করতেন না। যেমন আল্লাহ বলেন,وَمَا كَانَ اسْتِغْفَارُ إِبْرَاهِيمَ لِأَبِيهِ إِلاَّ عَنْ مَوْعِدَةٍ وَعَدَهَا إِيَّاهُ فَلَمَّا تَبَيَّنَ لَهُ أَنَّهُ عَدُوٌّ لِلَّهِ تَبَرَّأَ مِنْهُ إِنَّ إِبْرَاهِيمَ لَأَوَّاهٌ حَلِيمٌ- ‘আর নিজ পিতার জন্য ইবরাহীমের ক্ষমা প্রার্থনা ছিল কেবল সেই ওয়াদার কারণে যা সে তার পিতার সাথে করেছিল। অতঃপর যখন তার নিকট পরিষ্কার হয়ে গেল সে আল্লাহর শত্রু, তখন সে তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করল। নিশ্চয়ই ইবরাহীম ছিল বড়ই কোমল হৃদয় ও সহনশীল’ (তওবা ৯/১১৪)

২য় পরীক্ষা : নিজ কওমের সাথে তর্কযুদ্ধ : মানুষকে দ্বীনের পথে দাওয়াত দেওয়ার অন্যতম কৌশল হ’ল বিতর্ক অনুষ্ঠান। আল্লাহ প্রেরিত সত্যকে সত্য হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য জনগণকে সুন্দর যুক্তি ও উপদেশের মাধ্যমে বুঝানো ও তাদের জ্ঞানের জড়তাকে খুলে দেওয়া যেকোন জ্ঞানীর কর্তব্য। এই তর্কের উদ্দেশ্য কেবল অহি-র সত্যকে জনগণের বুঝের নাগালের মধ্যে নিয়ে আসার চেষ্টা করা। তর্কের মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে হারিয়ে দেওয়া নয় বরং দরদের সঙ্গে তাকে বুঝিয়ে দ্বীনে হক-এর পথে নিয়ে আসাই মূল উদ্দেশ্য হবে। ইবরাহীম (আঃ) স্বীয় কওমকে অনুরূপ দরদ ও যুক্তিবত্তার সাথে তর্কচ্ছলে দাওয়াত দিয়েছিলেন। ইবরাহীম (আঃ)-এর যুগে তৎকালীন কালেডিয়া বা বর্তমান ইরাকে বরং বলা যায় তৎকালীন বিশ্বের মুশরিক সমাজ প্রধানতঃ দু’ভাগে বিভক্ত ছিল। মূর্তিপূজারী ও তারকাপূজারী।[8]

ইবরাহীম (আঃ) উভয় দলের বিরুদ্ধে কথায় ও কাজে লড়াই করেছিলেন। প্রথমে মূর্তিপূজার বিরুদ্ধে তিনি নিজ ঘর থেকেই বাপের বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুরু করেন। পরে নিজ হাতে মূর্তি ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেন। আল্লাহ বলেন,وَإِذْ قَالَ إِبْرَاهِيمُ لِأَبِيهِ آزَرَ أَتَتَّخِذُ أَصْنَامًا آلِهَةً إِنِّي أَرَاكَ وَقَوْمَكَ فِي ضَلاَلٍ مُبِينٍ- ‘স্মরণ কর, যখন ইবরাহীম তার পিতা আযরকে বলেছিল, আপনি কি (আল্লাহকে ছেড়ে) মূর্তিগুলিকে উপাস্য গণ্য করেন? আমি তো দেখছি আপনি ও আপনার সম্প্রদায় স্পষ্ট ভ্রান্তির মধ্যে আছেন’ (আল-আন‘আম ৬/৭৪)। মৌখিক দাওয়াতে যখন তারা ফিরলো না, তখন তিনি মূর্তিগুলো ভেঙ্গে দিয়ে তাদের বিবেককে শানিত করতে চাইলেন। এক সুযোগে তিনি সব পুতুলগুলোকে ভেঙ্গে ফেলে বড় ঠাকুরটাকে রেখে দিলেন। যাতে লোকেরা তার কাছে গিয়ে ফরিয়াদ করতে পারে। তারপর যখন দেখবে যে, বড় ঠাকুর কিছুই বলতে পারে না। তখন তাদের হয়তবা বিবেক ফিরে আসবে। আল্লাহ বলেন, فَجَعَلَهُمْ جُذَاذًا إِلاَّ كَبِيرًا لَهُمْ لَعَلَّهُمْ إِلَيْهِ يَرْجِعُونَ- ‘অতঃপর সে মূর্তিগুলি গুঁড়িয়ে দিল বড়টিকে ছাড়া। যাতে তারা তার কাছে ফিরে যায়’ (আম্বিয়া ২১/৫৮)

লোকেরা যখন ইবরাহীমকে জিজ্ঞেস করল তখন তিনি বললেন,بَلْ فَعَلَهُ كَبِيرُهُمْ هَذَا فَاسْأَلُوهُمْ إِنْ كَانُوا يَنْطِقُونَ- ‘তাদের এই বড়টাই তো এ কাজ করেছে। অতএব তোমরা ভাঙ্গা মূর্তিগুলিকে জিজ্ঞেস কর যদি তারা কথা বলতে পারে’ (আম্বিয়া ২১/৬৩)। ইবরাহীমের এই ইঙ্গিতপূর্ণ কথায় লোকেরা লজ্জিত হ’ল ও নিজেদের ভুল স্বীকার করল। আল্লাহ বলেন,فَرَجَعُوا إِلَى أَنْفُسِهِمْ فَقَالُوا إِنَّكُمْ أَنْتُمُ الظَّالِمُونَ- ثُمَّ نُكِسُوا عَلَى رُءُوسِهِمْ لَقَدْ عَلِمْتَ مَا هَؤُلاَءِ يَنْطِقُونَ- ‘এতে লজ্জিত হয়ে তারা নিজেরা বলতে লাগল, আসলে তোমরাই তো অত্যচারী’। ‘অতঃপর অবনত মস্তকে তারা বলল, তুমি তো জান যে ওরা কথা বলতে পারে না’ (আম্বিয়া ২১/৬৪-৬৫)। যুক্তিতে হার মানলেও বাপদাদার আমল থেকে চলে আসা রেওয়াজ-এর মহববত এবং যুবক ইবরাহীমের কাছে হেরে যাওয়ার বিষয়টি তাদেরকে অহংকারী করে তোলে এবং হেদায়াত থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।

৩য় পরীক্ষা : অতঃপর তিনি দ্বিতীয় দল তারকা পূজারীদের বিরুদ্ধে তর্কযুদ্ধে অবতীর্ণ হ’লেন। এই তর্কানুষ্ঠানের বর্ণনা আল্লাহর ভাষায়-

فَلَمَّا جَنَّ عَلَيْهِ اللَّيْلُ رَأَى كَوْكَبًا قَالَ هَذَا رَبِّي فَلَمَّا أَفَلَ قَالَ لاَ أُحِبُّ الْآفِلِينَ- فَلَمَّا رَأَى الْقَمَرَ بَازِغًا قَالَ هَذَا رَبِّي فَلَمَّا أَفَلَ قَالَ لَئِنْ لَمْ يَهْدِنِي رَبِّي لَأَكُونَنَّ مِنَ الْقَوْمِ الضَّالِّينَ- فَلَمَّا رَأَى الشَّمْسَ بَازِغَةً قَالَ هَذَا رَبِّي هَذَا أَكْبَرُ فَلَمَّا أَفَلَتْ قَالَ يَا قَوْمِ إِنِّي بَرِيءٌ مِمَّا تُشْرِكُونَ- إِنِّي وَجَّهْتُ وَجْهِيَ لِلَّذِي فَطَرَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ حَنِيفًا وَمَا أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِينَ-

‘অনন্তর যখন তার উপর রাত্রির অন্ধকার সমাচ্ছন্ন হ’ল, তখন সে তারকা দেখে বলল, এটিই আমার প্রতিপালক। অতঃপর যখন তা অস্তমিত হ’ল, তখন সে বলল, আমি অস্তগামীদের ভালবাসি না’। ‘অতঃপর যখন সে উদীয়মান ডগমগে চন্দ্রকে দেখল, তখন বলল, এটিই আমার প্রতিপালক। কিন্তু যখন সেটি অস্তমিত হ’ল, তখন সে বলল, যদি আমার প্রভু আমাকে পথপ্রদর্শন না করেন, তাহলে আমি পথভ্রষ্ট সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব’। ‘অতঃপর যখন সে প্রভাতগগনের উদ্ভাসিত সূর্যকে দেখল, তখন বলল এটাই আমার রব ও এটাই সবচেয়ে বড়। কিন্তু পরে যখন তা ডুবে গেল, তখন সে বলল, হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা যেসব বিষয়কে (আল্লাহর সাথে) শরীক করো, আমি সেসব থেকে মুক্ত’। ‘আমি আমার চেহারাকে একনিষ্ঠভাবে ঐ সত্তার দিকে ফিরিয়ে দিচ্ছি, যিনি নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল সৃষ্টি করেছেন এবং আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই’ (আন‘আম ৬/৭৬-৭৯)

বর্ণনার ভঙ্গিতে মনে হয় যেন ইবরাহীম এ সময়ই প্রথম সূর্য-চন্দ্র-নক্ষত্র দেখলেন।


[1]. তিরমিযী হা/২৩৯৬, সনদ হাসান (বৈরূত : দারুল কুতুবিল ইলমিয়াহ, তাহকীক : কামাল ইউসুফ আল-হউত ১৪০৮/১৯৮৭) ৪/৫১৯ পৃ.; মিশকাত হা/১৫৬৬।

[2]. হাশিয়া ‘রিয়াযুছ ছালেহীন’ (বৈরূত : মুওয়াস সাসাতুর রিসালাহ ১৭শ সংস্করণ ১৪০৯/১৯৮৯) হা/৪৩, পৃ. ৬১।

[3]. মুসলিম হা/২৯৫৬; মিশকাত হা/৫১৫৮ ‘রিক্বাক্ব’ অধ্যায়।

[4]. তিরমিযী হা/২৩৯৯; হাকেম হা/৭৮৭৯; ছহীহ ইবনু হিববান হা/২৯২৪; ছহীহাহ হা/২২৮০।

[5]. তিরমিযী হা/২৩৯৬; মিশকাত হা/১৫৬৫।

[6]. তিরমিযী হা/২৩৯৮; ইবনু মাজাহ হা/৪০২৩; ছহীহ ইবনু হিববান হা/২৯০১; মিশকাত হা/১৫৬২; ছহীহাহ হা/১৪৩।

[7]. বুখারী হা/৫৬৪১; মিশকাত হা/১৫৩৭।

[8]. শহরস্তানী, আল-মিলাল ওয়াল নিহাল (বৈরূত : তাবি) ১/২৩১।