জামা‘আত গঠন লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও মূলনীতি

عَنِ الْحَارِسِ الْأَشْعَرِيِّ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ - صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ- آمُرُكُمْ بِخَمْسٍ: بِالْجَمَاعَةِ وَالسَّمْعِ، وَالطَّاعَةِ، وَالْهِجْرَةِ، وَالْجِهَادِ فِي سَبِيلِ اللهِ، وَإِنَّهُ مَنْ خَرَجَ مِنَ الْجَمَاعَةِ قِيدَ شِبْرٍ فَقَدْ خَلَعَ رِبْقَةَ الْإِسْلَامِ مِنْ عُنُقِهِ إِلَّا أَنْ يُّرَاجِعَ وَمَنْ دَعَا بِدَعْوَى الْجَاهِلِيَّةِ فَهُوَ مِنْ جُثَى جَهَنَّمَ وَإِنْ صَامَ وَصَلَّى وَزَعَمَ أَنَّهُ مُسْلِمٌ، رَوَاهُ أَحْمَدُ وَالتِّرْمِذِيُّ-

অনুবাদ : হারিছ আল-আশ‘আরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, আমি তোমাদেরকে পাঁচটি বিষয়ের নির্দেশ দিচ্ছি। (১) জামা‘আতবদ্ধ জীবন যাপন করা (২) আমীরের নির্দেশ শ্রবণ করা (৩) তাঁর আনুগত্য করা (৪) (প্রয়োজনে) হিজরত করা ও (৫) আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা। যে ব্যক্তি জামা‘আত হ’তে এক বিঘত পরিমান বের হয়ে গেল, তার গর্দান হ’তে ইসলামের গন্ডী ছিন্ন হয়ে গেল, যতক্ষণ না সে ফিরে আসে। যে ব্যক্তি মানুষকে জাহেলিয়াতের দিকে আহবান করল, সে ব্যক্তি জাহান্নামীদের দলভুক্ত হ’ল। যদিও সে ছিয়াম পালন করে, ছালাত আদায় করে ও ধারণা করে যে, সে একজন মুসলিম’।[1] 

উপরোক্ত হাদীছে মুসলিম উম্মাহকে সর্বদা জামা‘আতবদ্ধ হয়ে সুশৃংখলভাবে জীবন যাপনের নির্দেশ দান করা হয়েছে। ‘নির্দিষ্ট নেতৃত্বের অধীনে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে সংঘবদ্ধ একদল মানুষকে একটি জামা‘আত বা সংগঠন বলে(الجماعة ما اجةمع من الناس على هدف ةحة إمارة) ‘ইসলামের প্রচার-প্রসার ও শক্তিবৃদ্ধির লক্ষ্যে উক্ত জামা‘আত গঠিত হ’লে তাকে ইসলামী জামা‘আত’ বলা হয়। পক্ষান্তরে ইসলাম বিরোধী আদর্শের প্রচার-প্রসার ও শক্তিবৃদ্ধি যদি লক্ষ্য হয় এবং তা যদি মুসলমানদের দ্বারাও গঠিত হয়, তবে তাকে জাহেলিয়াতের সংগঠন বলা হয়। এইসব সংগঠনে যোগদানকারী ব্যক্তি মুসলমান হ’লেও তাকে অত্র হাদীছে ‘জাহান্নামীদের দলভুক্ত’ বলে গণ্য করা হয়েছে। 

লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য :

জামা‘আত গঠনের মূল লক্ষ্য হ’ল ‘দ্বীনে হক-এর প্রচার-প্রসার ও শক্তি বৃদ্ধির জন্য সংঘবদ্ধভাবে প্রচেষ্টা চালানো ও তার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা’। এই প্রচেষ্টা চালানোর জন্য পবিত্র কুরআনে অসংখ্য স্থানে নির্দেশ এসেছে যেমন আল্লাহ বলেন,وَلْتَكُنْ مِنْكُمْ أُمَّةٌ يَدْعُونَ إِلَى الْخَيْرِ وَيَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ- ‘আর তোমাদের মধ্যে একটা দল থাকা চাই, যারা মানুষকে কল্যাণের দিকে আহবান করবে ও অন্যায় থেকে নিষেধ করবে। বস্ত্ততঃ তারাই হ’ল সফলকাম’ (আলে ইমরান ৩/১০৪)। এই দলের শ্রেষ্ঠ হ’লেন ছাহাবায়ে কেরাম। অতঃপর তাবেঈনে এযাম। অতঃপর মুহাদ্দেছীন ও তাঁদের অনুসারী পরবর্তী হাদীছপন্থী বিদ্বানমন্ডলী ও আম জনসাধারণ। হাদীছ বিরোধী কোন ব্যক্তি কখনোই এই দলভুক্ত নয়।

এক্ষণে এই দল বিশ্বব্যাপী একটাই হ’তে পারে আক্বীদা ও আমলগত ঐক্যের কারণে। কিন্তু বাস্তব অর্থে সমাজ সংষ্কারক এই দলের অস্তিত্ব প্রত্যেক জনপদেই নির্দিষ্ট নেতৃত্বের মাধ্যমে থাকতে হবে। যাকে কুরআনে ‘উলুল আমর’ (নিসা ৪/৫৯) বলা হয়েছে। সর্বত্র এই দলের অস্তিত্ব না থাকলে বাতিল জয়লাভ করবে। সমাজ ধ্বংস ও বিপর্যস্ত হবে। নিজেও এক সময় বাতিলের স্রোতে হারিয়ে যাবে।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,إِنَّ النَّاسَ إِذَا رَأَوُا الْمُنْكَرَ لاَ يُغَيِّرُونَهُ أَوْشَكَ أَنْ يَعُمَّهُمُ اللهُ بِعِقَابِهِ- ‘যখন লোকেরা কোন অন্যায় কর্ম হ’তে দেখে অথচ তার প্রতিরোধ করে না, সত্বর আল্লাহ তাদের সকলের উপরে তার গযবকে ব্যাপক করে দিবেন’।[2]

প্রয়োজনীয়তা :

নিজের ও সমাজের ইহকালীন মঙ্গল ও পরকালীন মুক্তির প্রয়োজনেই জামা‘আত গঠন ও তার উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন একান্ত যরূরী। মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। ব্যক্তিকে নিয়ে যেমন সমাজ, সমাজকে নিয়ে তেমনি ব্যক্তি। নোংরা ও বিষাক্ত পানিতে যেমন সুন্দর ও স্বচ্ছ একটি মাছ বেঁচে থাকতে পারে না, তেমনি নোংরা ও বিষাক্ত সমাজে একটি সুন্দর ও ফুটফুটে শিশু ভাল হয়ে বেঁচে থাকতে পারে না।

মানুষ তার নিজের প্রয়োজনেই সমাজ গঠন করেছে ও সমাজের নেতৃবৃন্দের মাধ্যমে শাসিত হয়েছে। হযরত আবুবকর ছিদ্দীক (রাঃ) একদা লোকদের ডেকে বলেন,يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّكُمْ تَقْرَءُونَ هَذِهِ الآيَةَ (يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا عَلَيْكُمْ أَنْفُسَكُمْ لاَ يَضُرُّكُمْ مَنْ ضَلَّ إِذَا اهْتَدَيْتُمْ) وَإِنَّا سَمِعْنَا رَسُولَ اللهِ- صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ- يَقُولُ : إِنَّ النَّاسَ إِذَا رَأَوُا الْمُنْكَرَ لاَ يُغَيِّرُونَهُ أَوْشَكَ أَنْ يَعُمَّهُمُ اللهُ بِعِقَابِهِ- ‘হে মুমিনগণ! তোমরা সাধ্যমত তোমাদের কাজ করে যাও। পথভ্রষ্টরা তোমাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না, যখন তোমরা সৎপথে থাকবে’ (মায়েদাহ ৫/১০৫)। আমি রাসূল (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি যে, যখন লোকেরা কোন অন্যায়কর্ম হ’তে দেখে অথচ তা প্রতিরোধ করেনা, সত্বর আল্লাহ তাদের উপরে তাঁর গযবকে ব্যাপক করে দিবেন’।[3]

বলা বাহুল্য, ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা ব্যতীত সামাজিক প্রতিরোধ সম্ভব নয়। নবী-রাসূলগণ এলাহী শক্তি বলে একাই যথেষ্ট ছিলেন। তা সত্বেও সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে তাঁরা মানুষকে দ্বীনের পথে আহবান জানিয়েছেন। তাদেরকে সংঘবদ্ধ করেছেন। বদর-ওহোদ-খন্দকের পরীক্ষা দিয়ে বাতিল শক্তির প্রত্যক্ষ মুকাবিলা করেছেন। তবেই দ্বীন বিজয়ী হয়েছে। পৃথিবীর মানুষ ইসলামের ন্যায়নিষ্ঠ শাসন উপহার পেয়েছে। আজও যেসব দেশে ইসলামের কিছুটা হ’লেও শাসন ব্যবস্থা টিকে আছে, পৃথিবীর যেকোন গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক দেশের চাইতে সামাজিক ন্যায়বিচার ও শান্তি-শৃংখলা সেখানে অনেক বেশী আছে। এটা স্রেফ ইসলামেরই বরকত।

মূলনীতি :

জামা‘আত গঠনের মূলনীতি হ’ল ‘আমর বিল মারূফ’ ও ‘নাহি আনিল মুনকার’ বা ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়ের নিষেধ। ন্যায়-অন্যায়ের মানদন্ড হ’ল আল্লাহর ‘অহি’।

ব্যক্তি বা ব্যক্তি সমষ্টির সিদ্ধান্ত অহি-র বিধানের অনুকূলে হ’লে তা মানা চলবে। নইলে প্রত্যাখ্যাত হবে। কেননা আল্লাহর অবাধ্যতায় বান্দার প্রতি কোন আনুগত্য নেই। সংগঠনের নেতা ও কর্মীর মধ্যে সম্পর্কের মূলনীতি হবে الْحُبُّ فِى اللهِ وَالْبُغْضُ فِى اللهِ- ‘আল্লাহর জন্য ভালোবাসা ও আল্লাহর জন্য অবন্ধুতা’।[4] অত্র মূলনীতির অনুসরণে আল্লাহ প্রেরিত অহি-র বিধানকে ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে প্রতিষ্ঠা করার জন্য জামা‘আতবদ্ধভাবে প্রচেষ্টা চালানো প্রত্যেক মুমিনের ঈমানী দায়িত্ব।

জামা‘আত-এর প্রকারভেদ :

জামা‘আত দু’প্রকারের। জামা‘আতে ‘আম্মাহ ও জামা‘আতে খাছছাহ। প্রথমটি হ’ল ব্যাপক ভিত্তিক সংগঠন বা আধুনিক পরিভাষায় রাষ্ট্রীয় সংগঠন। এই জামা‘আতের আমীর বা রাষ্ট্র প্রধান ইসলামী বিধান মতে দেশ শাসন করবেন। প্রজাপালন করবেন ও শারঈ হুদূদ কায়েম করবেন। এই ইমারতকে ‘ইমারতে মুলকী’ বা রাষ্ট্রীয় ইমারত বলা হয়। এই আমীরের বিরূদ্ধাচরণ করে পৃথক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা হত্যাযোগ্য অপরাধ। যেমন বলা হয়েছে,إِذَا بُويِعَ لِخَلِيفَتَيْنِ فَاقْتُلُوا الآخَرَ مِنْهُمَا- ‘যখন দুই খলীফার জন্য বায়‘আত গ্রহণ করা হবে, তখন শেষের জনকে কতল করে ফেল’।[5]

অন্যত্র বলা হয়েছে,مَنْ أَتَاكُمْ وَأَمْرُكُمْ جَمِيعٌ عَلَى رَجُلٍ وَاحِدٍ يُرِيدُ أَنْ يَشُقَّ عَصَاكُمْ أَوْ يُفَرِّقَ جَمَاعَتَكُمْ فَاقْتُلُوهُ- ‘যখন তোমাদের শাসনভার একজনের উপরে ন্যস্ত থাকবে, এমতাবস্থায় যদি কেউ তোমাদের ঐক্যে ফাটল ধরাতে চায় বা তোমাদের জামা‘আতকে বিভক্ত করতে চায়, তাহ’লে তাকে কতল করে দাও’।[6] এই ‘আমীর’ যদি বিশ্বাসঘাতক ও খেয়ানতকারী হয়, তবে ক্বিয়ামতের দিন তার জন্য ‘দীর্ঘ ঝান্ডা’ উড়ানো হবে ও তার জন্য জান্নাত হারাম করা হবে।[7]

২য় : জামা‘আতে খাছ্ছাহ বা বিশেষ সংগঠন :

দ্বীনের দাওয়াত ও তাবলীগ এবং সমাজে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়ের প্রতিরোধে ঈমানদারদের বিশেষ বিশেষ জামা‘আত কায়েম করা যরূরী। কোন স্থানে তিন জন মুমিন থাকলেও এক জনকে ‘আমীর’ নিয়োগ করে এই ধরনের কল্যাণমুখী জামা‘আত গঠন করা যাবে। এই জামা‘আত যত বড় হবে, দাওয়াত ও সমাজ সংষ্কারের পরিধি তত বৃদ্ধি পাবে। সমাজে আল্লাহর রহমত নেমে আসবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, يَدُ اللهِ عَلَى الْجَمَاعَةِ ‘জামা‘আতের উপর আল্লাহর হাত থাকে’।[8]

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,لاَ يَحِلُّ لِثَلاَثَةِ نَفَرٍ يَكُونُونَ بِأَرْضِ فَلاَةٍ إِلاَّ أَمَّرُوا عَلَيْهِمْ أَحَدَهُمْ ‘একজনকে ‘আমীর’ নিযুক্ত না করা পর্যন্ত কোন তিনজন লোকের জন্যও কোন নির্জন ভূমিতে অবস্থান করা হালাল নয়’।[9]

বিশেষ জামা‘আত সর্বাবস্থায় যরূরী :

ইসলামী শাসনের বর্তমানে বা অবর্তমানে সর্বাবস্থায় জামা‘আতে খাছছাহ কায়েম করা এবং সংঘবদ্ধভাবে দাওয়াত ও সমাজ সংষ্কারের দায়িত্ব পালন করা যরূরী। বরং বলা যেতে পারে যে, নিরন্তর সাংগঠনিক তৎপরতার মাধ্যমেই সমাজে এখনও দ্বীন টিকে আছে। নইলে রাষ্ট্রের পক্ষে খুছূছী দাওয়াত দেওয়া সম্ভব নয়। ক্ষেত্র বিশেষে কিছু ব্যবস্থা থাকলেও তার তেমন কোন প্রভাব জনগণের মধ্যে পড়ে না। এরপরেও বর্তমান বিশ্বের অধিকাংশ মুসলিম রাষ্ট্র অনৈসলামী বিধান মতে শাসিত হচ্ছে এবং কোটি কোটি মুসলমান অমুসলিম দেশ সমূহে বসবাস করছেন। এমতঃ প্রেক্ষাপটে খাছ খাছ জামা‘আত বা ইসলামী সংগঠনগুলির ব্যাপক প্রচেষ্টা ব্যতীত ইসলামী অনুশাসন টিকে থাকা প্রায় অসম্ভব। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,مَا مِنْ نَبِىٍّ بَعَثَهُ اللهُ فِى أُمَّةٍ قَبْلِى إِلاَّ كَانَ لَهُ مِنْ أُمَّتِهِ حَوَارِيُّونَ وَأَصْحَابٌ يَأْخُذُونَ بِسُنَّتِهِ وَيَقْتَدُونَ بِأَمْرِهِ ثُمَّ إِنَّهَا تَخْلُفُ مِنْ بَعْدِهِمْ خُلُوفٌ يَقُولُونَ مَا لاَ يَفْعَلُونَ وَيَفْعَلُونَ مَا لاَ يُؤْمَرُونَ فَمَنْ جَاهَدَهُمْ بِيَدِهِ فَهُوَ مُؤْمِنٌ وَمَنْ جَاهَدَهُمْ بِلِسَانِهِ فَهُوَ مُؤْمِنٌ وَمَنْ جَاهَدَهُمْ بِقَلْبِهِ فَهُوَ مُؤْمِنٌ وَلَيْسَ وَرَاءَ ذَلِكَ مِنَ الإِيمَانِ حَبَّةُ خَرْدَلٍ- ‘আমার পূর্বে আল্লাহ এমন কোন নবী পাঠাননি, যাদের একদল সাহায্যকারী ছিল না। তারা নবীর সুন্নাতের অনুসরণ করত ও তাঁর নির্দেশ মেনে চলত। অতঃপর তাদের পরবর্তী প্রজন্মে এমন সব লোক আসলো, যারা এমন কথা বলত, যা তারা করত না এবং এমন সব কাজ করত, যার নির্দেশ তাদের দেওয়া হয়নি। অতঃপর যারা তাদের সঙ্গে হাত দ্বারা জিহাদ করবে, তারা মুমিন। যারা যবান দ্বারা জিহাদ করবে, তারা মুমিন। যারা অন্তর দিয়ে জিহাদ করবে, তারাও মুমিন। এর বাইরে ঈমানের সরিষা দানাও নেই’।[10] নবীদের এই সাহায্যকারী দলই ছিলেন, স্ব স্ব যুগের খাছ খাছ কল্যাণমুখী জামা‘আত। কিন্তু পরবর্তী যুগে এই দল সমূহের অস্তিত্ব না থাকায় ঐসব উম্মত ধ্বংসের কিনারায় পৌঁছে যায়। ফলে পুনরায় নবী আসার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। কিন্তু আখেরী নবী (ছাঃ)-এর আগমনের পরে আর নবী আসবেন না। এখন এ গুরু দায়িত্ব বহণ করতে হবে উম্মতের উলামা, শাসকবৃন্দ এবং খাছ খাছ ইসলামী জামা‘আত সমূহকে। ক্বিয়ামত পর্যন্ত এই হকপন্থী দলের অস্তিত্ব বজায় থাকবে বলে হাদীছে ঘোষণা করা হয়েছে।[11] ইমাম আহমাদ বিন হাম্বলকে জিজ্ঞেস করা হ’ল ঐ দল কারা? তিনি জবাবে বললেন,إِنْ لَمْ يَكُونُوا أَهْلَ الْحَدِيثِ فَلاَ أَدْرِي مَنْ هُمْ- ‘যদি তারা আহলেহাদীছ না হয়, তবে আমি জানিনা তারা কারা? ইমাম নববী বলেন, এই দল পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে একই সময়ে থাকতে পারে’।[12]

অতএব শুধু রাষ্ট্র নয় বরং প্রত্যেক মুমিনের উপরে ফরয দায়িত্ব হ’ল সামাজিক কুসংষ্কার দূর করার জন্য এবং ইসলামের স্বচ্ছতা ও স্বকীয়তা রক্ষার জন্য কাফির, মুশরিক বিদ‘আতী ও মুনাফিকদের দিন-রাতের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে জামা‘আতবদ্ধ প্রচেষ্টা চালানো (আনফাল ৮/৬০)। বলা চলে যে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ও অঞ্চলে এই বিশেষ জামা‘আতগুলিই ইসলামের ঝান্ডাকে উডডীন রেখেছে। এই বিশেষ জামা‘আতের আমীর নিঃসন্দেহে রাষ্ট্রীয় আমীর নন। অতএব তিনি যেনাকারীর শাস্তি, খুনীর ক্বেছাছ, চোরের হাত কাটা, মদ্যপের বেত্রাঘাত ইত্যাদি শারঈ হুদূদ কায়েম করবেন না। কিন্তু অবশ্যই শারঈ অনুশাসন কায়েম করবেন এবং স্বীয় মামূরকে সর্বদা দ্বীনের পথে ধরে রাখতে প্রচেষ্টা চালাবেন। আর এজন্যে মামূরকে আমীরের হাতে শারঈ আনুগত্যের বায়‘আত গ্রহণ করতে হবে এবং মামূরকে আমীরের শারঈ নির্দেশ সাধ্যপক্ষে মেনে চলতে সর্বদা বাধ্য থাকতে হবে। শারঈ কারণ ব্যতীত বায়‘আতের অবমাননা করলে ও আনুগত্য ছিন্ন করলে কঠিন গুনাহের ভাগীদার হ’তে হবে (ফাৎহ ৪৮/১০)। এই ইমারতকে ‘ইমারতে শারঈ’ বলা হয়। ইমারতে শারঈ-র পথ বেয়েই ‘ইমারতে মুলকী’ কায়েম হওয়া সম্ভব। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মাক্কী জীবনে ‘ইমারতে শারঈ’-র মালিক ছিলেন এবং হজ্জের মৌসুমে ১ম ও ২য় আক্বাবায় মদীনার লোকদের নিকট থেকে আনুগত্যের বায়‘আত গ্রহণ করেন। কিন্তু মাদানী জীবনে ইসলামী শাসন কায়েম হওয়ার ফলে ‘ইমারতে মুলকী’র অধিকারী হন ও শারঈ হুদূদ কায়েম করেন।

এই সকল বিশেষ জামা‘আত বৃহত্তর রাষ্ট্রীয় সংগঠনের সহায়ক হিসাবে গণ্য হবে। কখনোই রাষ্ট্রবিরোধী বা রাষ্ট্রীয় আনুগত্যের বিরোধী হবে না। আল্লাহ বলেন, تَعَاوَنُوا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَى ‘তোমরা সৎকর্ম ও আল্লাহভীতির কাজে পরস্পরকে সহযোগিতা কর’ (মায়েদাহ ৫/২)। আল্লাহ পাকের এই অমোঘ নির্দেশ পালনে তারা পরস্পরে সহানুভূতিশীল মনোভাব পোষণ করবে। বরং দাওয়াত ও জিহাদের ময়দানে এবং নেকী উপার্জনে পরস্পরে প্রতিযোগিতা করবে।

আপন দু’ভাইয়ের দেহ পৃথক হ’লেও পরস্পরের সাহায্যে যেমন শক্তিশালী রক্ষাব্যুহ রচনায় সক্ষম হয়। তেমনিভাবে বিভিন্ন ইসলামী সংগঠন পরস্পরের সহযোগিতায় শক্তিশালী ইসলামী সমাজ বিনির্মানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখনই কোথাও কোন দাওয়াতী কাফেলা প্রেরণ করতেন কিংবা সৈন্যদল প্রেরণ করতেন, তাদের জন্য পৃথক পৃথক ‘আমীর’ নিয়োগ করতেন। মক্কার মুহাজির ও মদীনার আনছারগণ সকলে মুসলমান হ’লেও তাদের পৃথক বৈশিষ্ট্যগত নাম পবিত্র কুরআনেও স্বীকৃতি পেয়েছে (তওবাহ ৯/১১৭; হাশর ৫৯/৮, ৯)। পৃথক দল হ’লেও তারা ইসলামের স্বার্থে ছিলেন একাত্মা। পরস্পরে দীর্ঘ সংঘাত বিক্ষুব্ধ আউস ও খাযরাজ গোত্রদ্বয় মুসলমান হওয়ার পরেও তাদের পৃথক গোত্রীয় পরিচয় মুছে দেওয়া হয়নি। আউস নেতা সা‘দ বিন মু‘আয (রাঃ) ও খাযরাজ নেতা সা‘দ বিন উবাদাহ (রাঃ) উভয়ে ছিলেন জালীলুল ক্বদর ছাহাবী। মুনাফিক নেতা আব্দুল্লাহ বিন উবাই ছিল খাযরাজ গোত্রের। মা আয়েশা (রাঃ) সম্পর্কে সে অপবাদ রটায়। তাতে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) দারুনভাবে মর্মাহত হয়ে একদিন তার বিরুদ্ধে জনগণের সাহায্য চাইলে আউস নেতা হযরত সা‘দ বিন মু‘আয (রাঃ) বলে ওঠেন যে, ‘সে আমার গোত্রের হ’লে তাকে কতল করতাম’। এতে খাযরাজ গোত্রের নেতা হযরত সা‘দ বিন উবাদাহ (রাঃ) ক্ষুব্ধ হন। ফলে উভয় গোত্রের মধ্যে লড়াই বেধে যাওয়ার উপক্রম হয়। অথচ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তখন মসজিদের মিম্বরে দন্ডায়মান। পরে তিনি উভয় দলকে শান্ত করেন (বুখারী হা/৪১৪১)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের দলকে নিষিদ্ধ করলেন না বা দলনেতাকে বরখাস্ত করলেন না। বরং উভয়কে পৃথক পৃথক ভাবে নেকীর কাজে উদ্বুদ্ধ করেন। তাদের উভয় দলই ইসলামের স্বার্থে জীবন উৎসর্গ করে। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন আউস গোত্রের মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহ (রাঃ)-কে মদীনার ইহূদী নেতা কা‘ব বিন আশরাফকে হত্যা করার দায়িত্ব দেন ও তিনি তাঁর সাথীদের নিয়ে সে দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেন (বুখারী পৃঃ ৫৭৬), তখন খাযরাজ গোত্রের লোকেরা অনুরূপ বড় কোন নেকীর কাজের দায়িত্ব চাইল।[13] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদেরকে খায়বরের ইহূদী নেতা সাল্লাম বিন আবিল হুক্বাইক্বা-কে হত্যা করার দায়িত্ব দেন। 

ফলে আব্দুল্লাহ বিন আতীক (রাঃ)[14]-এর নেতৃত্বে তাদের একটি দল গিয়ে কার্য সম্পাদন করেন।[15] এইভাবে ইসলামের স্বার্থে যেকোন নেকীর কাজে ইসলামী সংগঠনগুলি ছওয়াবের নিয়তে প্রতিযোগিতা করবে। তাতে ইসলামের উপকার হবে ও মুসলিম উম্মাহর শক্তি বৃদ্ধি হবে। মুনাফিক ও কুফরী শক্তি অবদমিত হবে। জানা-অজানা শত্রুরা ভীত হবে (আনফাল ৮/৬০)

দলাদলি নিষিদ্ধ :

আল্লাহর উদ্দেশ্যে দ্বীনের দাওয়াত ও জিহাদ ব্যতীত দুনিয়াবী কোন উদ্দেশ্যে দলাদলি ও আপোষে হিংসা-হানাহানি ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,وَلاَ تَجَسَّسُوا، وَلاَ تَحَاسَدُوا، وَلاَ تَدَابَرُوا، وَلاَ تَبَاغَضُوا، وَكُونُوا عِبَادَ اللهِ إِخْوَانًا- ‘তোমরা পরস্পরে ছিদ্রান্বেষণ করোনা, হিংসা করো না, বিদ্বেষ করোনা, চক্রান্ত করোনা। তোমরা আল্লাহর বান্দা হিসাবে সকলে ভাই ভাই হয়ে যাও’।[16]

মোটকথা ধর্মীয় দল হোক বা রাজনৈতিক দল হোক পারস্পরিক হিংসা-হানাহানি সর্বাবস্থায় নিষিদ্ধ। আয়াতে বর্ণিত وَلاَ تَفَرَّقُوا ‘তোমরা দলে দলে বিভক্ত হয়োনা’ (আলে ইমরান ৩/১০৩)। একথার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য এটাই।*

অতএব প্রত্যেক মুমিনকে সর্বাবস্থায় আল্লাহর রজ্জু কুরআন তথা আল্লাহ প্রেরিত অহি-র বিধানকে কঠিনভাবে ও সমবেতভাবে আকড়ে ধরতে হবে ও সর্বদা জামা‘আতবদ্ধ জীবন যাপন করতে হবে। হিংসা ও বিদ্বেষ সর্বস্ব দলাদলি করা চলবে না। তাতে আমরা ধ্বংস হয়ে যাব। ইসলাম ক্ষতিগ্রস্থ হবে। আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর সত্য দ্বীনের স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ও পরস্পরের সহযোগী হওয়ার তাওফীক দিন- আমীন!


[1]. আহমাদ হা/১৭২০৯; তিরমিযী হা/২৮৬৩; মিশকাত হা/৩৬৯৪, সনদ ছহীহ।

[2]. ইবনু মাজাহ হা/৪০০৫; তিরমিযী হা/২১৬৮; মিশকাত হা/৫১৪২ ‘শিষ্টাচার সমূহ’ অধ্যায়।

[3]. ইবনু মাজাহ হা/৪০০৫; তিরমিযী হা/২১৬৮; মিশকাত হা/৫১৪২ ‘শিষ্টাচার সমূহ’ অধ্যায়।

[4]. আবুদাঊদ হা/৪৫৯৯; বায়হাক্বী শো‘আব হা/৯৫১৩; আহমাদ হা/২১৩৪১; মিশকাত হা/৩২, ৫০১৪, ৫০২১; ছহীহাহ হা/৯৯৮।

[5]. মুসলিম হা/১৮৫৩; মিশকাত হা/৩৬৭৬ ‘ইমারত’ অধ্যায়।

[6]. মুসলিম হা/১৮৫২; মিশকাত হা/৩৬৭৮।

[7]. মুসলিম হা/১৭৩৮; মিশকাত হা/৩৭২৭; বুখারী হা/৭১৫১; মুসলিম হা/১৪২; মিশকাত হা/৩৬৮৬।

[8]. নাসাঈ হা/৪০২০; তিরমিযী হা/২১৬৬; মিশকাত হা/১৭৩।

[9]. আহমাদ হা/৬৬৪৭; মাজমাউয যাওয়ায়েদ হা/৬৩৬২; ছহীহাহ হা/১৩২২-এর আলোচনা।

[10]. মুসলিম হা/৫০; মিশকাত হা/১৫৭।

[11]. বুখারী হা/৩৬৪১; মুসলিম হা/১০৩৭; মিশকাত হা/৬২৭৬; মুসলিম হা/১৯২০; আবুদাঊদ হা/৪২৫২; মিশকাত হা/৫৪০৬; তিরমিযী হা/২১৯২; মিশকাত হা/৬২৮৩।

[12]. মুসলিম হা/১৯২০-এর আলোচনা।

[13]. বায়হাক্বী, দালায়েলুন নবুঅত (বৈরুতঃ ১৯৮৫) ৪/৩৩-৩৪ পৃঃ।

[14]. আল-ইছাবাহ ক্রমিক নং ৪৮০৭; বায়হাক্বী ‘উতাইক’ বলেছেন। -দালায়েল ৪/৩৩-৩৪।

[15]. বুখারী পৃঃ ৫৭৭।

[16]. বুখারী হা/৬০৬৪; মুসলিম হা/২৫৬৩; মিশকাত হা/৫০২৮।