আল্লাহর জন্য ভালবাসা

عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ- إِنَّ اللهَ يَقُولُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَيْنَ الْمُتَحَابُّونَ بِجَلاَلِى الْيَوْمَ أُظِلُّهُمْ فِى ظِلِّى يَوْمَ لاَ ظِلَّ إِلاَّ ظِلِّى-

অনুবাদ : হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ পাক ক্বিয়ামতের দিন সকলকে ডেকে বলবেন, আমার সম্মানে পরস্পরকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণকারী ব্যক্তিগণ কোথায়? আজ আমি তাদেরকে ছায়া দেব আমার ছায়াতলে। যেদিন কোন ছায়া নেই আমার ছায়া ব্যতীত’।[1]

সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা : অত্র হাদীছে আল্লাহর বান্দাদের পরস্পরে মহববতের সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রতি তাকীদ করা হয়েছে। শয়তান প্রতি মুহূর্তে দুই মুমিনের মধ্যকার ভালোবাসার সম্পর্ক বিনষ্ট করতে চায়। যেকোন অজুহাতে তাদের মধ্যে ফাটল ধরাতে চায়। দু’জন মুমিনের পারস্পরিক সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, الْمُؤْمِنُ لِلْمُؤْمِنِ كَالْبُنْيَانِ، يَشُدُّ بَعْضُهُ بَعْضًا. ثُمَّ شَبَّكَ بَيْنَ أَصَابِعِهِ- ‘একজন মুমিন ও আরেকজন মুমিনের সম্পর্ক একটি দেওয়ালের ন্যায়। যেখানে একটি অপরটিকে শক্তিশালী করে। এ কথা বলে রাসূল (ছাঃ) দুই হাতের আংগুলগুলি পরস্পরে মুষ্টিবদ্ধ করলেন’।[2]

মুসলিম সমাজ মূলতঃ পারস্পরিক মহববতপূর্ণ একটি শান্তিময় সমাজ। এই মহববত স্থায়ী হওয়ার ভিত্তি হ’ল আল্লাহর রেযামন্দী। একজন মুমিন আরেকজন মুমিনকে ভালবাসে আল্লাহর ভালবাসা পাওয়ার জন্য। আর আল্লাহর ভালবাসা পাওয়ার অর্থ হ’ল জান্নাত লাভ করা। পক্ষান্তরে যদি ভালবাসা দুনিয়াবী স্বার্থের ভিত্তিতে হয়, তবে ঐ স্বার্থ যতক্ষণ বর্তমান থাকে, মহববত ততক্ষণ টিকে থাকে। তারপর যেকোন এক ঠুনকো অজুহাতে ঐ ভালবাসার কাঁচের আবরণটি ভেঙ্গে খান খান হয়ে যায়। না এতে কোন মানসিক প্রশান্তি লাভ হয়, না পরকালে কোন নেকী হয়। দুনিয়াবী কোন লাভ হ’লেও হ’তে পারে। তবে তা নিঃসন্দেহে ক্ষণস্থায়ী। কোন বুদ্ধিমান লোক নিশ্চয়ই ক্ষণস্থায়ী লাভের জন্য চিরস্থায়ী জান্নাত হারাতে চাইবে না। উম্মাতে মুহাম্মাদীর পারস্পরিক সম্পর্কের পরিচয় দিয়ে আল্লাহ বলেন,مُحَمَّدٌ رَسُولُ اللهِ وَالَّذِينَ مَعَهُ أَشِدَّاءُ عَلَى الْكُفَّارِ رُحَمَاءُ بَيْنَهُمْ تَرَاهُمْ رُكَّعًا سُجَّدًا يَبْتَغُونَ فَضْلاً مِنَ اللهِ وَرِضْوَانًا سِيمَاهُمْ فِي وُجُوهِهِمْ مِنْ أَثَرِ السُّجُودِ- ‘মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ ও তাঁর সাথীবৃন্দ কাফিরদের বিরুদ্ধে কঠোর ও নিজেদের মধ্যে পরস্পরে দয়ালু। তুমি তাদেরকে রুকুকারী ও সিজদাকারী দেখতে পাবে। তারা আল্লাহর দয়া ও সন্তুষ্টি কামনা করে। তাদের কপালে সিজদার চিহ্ন দেখা যাবে’ (ফাৎহ ৪৮/২৯)। অন্য আয়াতে মদীনার আনছারদের ত্যাগ ও বন্ধুত্বের বর্ণনা দিতে গিয়ে আল্লাহ বলেন, ‘তারা নিজেদের উপরে তাদের (মুহাজির ভাইদেরকে) অগ্রাধিকার দিয়েছিল। যদিও তাদের নিজেদের মধ্যে ছিল অভাব। যারা হৃদয়ের সংকীর্ণতা হ’তে মুক্ত তারাই সফলকাম’ (হাশর ৫৯/৯)

মুমিনের পারস্পরিক সহানুভূতি কেমন হবে এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,تَرَى الْمُؤْمِنِينَ فِى تَرَاحُمِهِمْ وَتَوَادِّهِمْ وَتَعَاطُفِهِمْ كَمَثَلِ الْجَسَدِ إِذَا اشْتَكَى عُضْوًا تَدَاعَى لَهُ سَائِرُ جَسَدِهِ بِالسَّهَرِ وَالْحُمَّى- ‘দয়া, ভালবাসা ও পারস্পরিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে তুমি মুমিনগণকে একটি দেহের ন্যায় দেখতে পাবে। দেহের একটি অঙ্গ ব্যাথাতুর হ’লে সর্বাঙ্গ ব্যাথাতুর হয় জাগ্রত অবস্থায় হৌক কিংবা জ্বর অবস্থায় হৌক’।[3]

পারস্পরিক মহববতের বিনিময় কি হবে- এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,الْمُسْلِمُ أَخُو الْمُسْلِمِ، لاَ يَظْلِمُهُ وَلاَ يُسْلِمُهُ، وَمَنْ كَانَ فِى حَاجَةِ أَخِيهِ كَانَ اللهُ فِى حَاجَتِهِ، وَمَنْ فَرَّجَ عَنْ مُسْلِمٍ كُرْبَةً فَرَّجَ اللهُ عَنْهُ كُرْبَةً مِنْ كُرُبَاتِ يَوْمِ الْقِيَامَةِ، وَمَنْ سَتَرَ مُسْلِمًا سَتَرَهُ اللهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ- ‘এক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই। সে তাকে যুলম করবে না বা লজ্জিত করবে না। যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের প্রয়োজনে সাহায্য করবে, আল্লাহ তার সাহায্যে থাকবেন। যে ব্যক্তি অপর মুসলিম ভাইয়ের একটি বিপদ দূর করে দিল, আল্লাহ তাকে ক্বিয়ামতের দিন অসংখ্য বিপদের মধ্য হ’তে একটি বিপদ হ’তে রেহাই দিবেন। যে ব্যক্তি একজন মুসলিমের কোন দোষ ঢেকে রাখল, আল্লাহ ক্বিয়ামতের দিন তার একটি দোষ ঢেকে রাখবেন’।[4]

অন্যত্র তিনি বলেন, ‘ক্বিয়ামতের কঠিন দিনে যেদিন আল্লাহর ছায়া ব্যতীত কোন ছায়া থাকবে না, সেদিন সাত শ্রেণীর মুমিন আল্লাহর ছায়াতলে স্থান পাবেন। তন্মধ্যে এক শ্রেণী হ’ল ঐ দুই বন্ধু যারা আল্লাহর জন্য পরস্পরকে ভালবেসেছে। আল্লাহর জন্যই পরস্পরে মিলিত হয়েছে ও আল্লাহর জন্যই পরস্পরে পৃথক হয়েছে’।[5] কিন্তু মানুষ যেকোন অজুহাতে পৃথক হ’তে চায়। ছোটখাট বিষয় যা ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখলে সহজে সমাধান হয়ে যায়, সেগুলিকেই বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে বড় করে তোলার মাধ্যমে শয়তান তাকে অহংকারী করে তোলে ও পৃথক হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। অথচ মুখে সে কখনোই নিজের দোষ স্বীকার করে না বা নিজেকে অহংকারী বলে প্রকাশ করে না। একারণেই তাকে সাবধান করে দিয়ে অন্যত্র আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বলেন, التَّقْوَى هَا هُنَا وَيُشِيرُ إِلَى صَدْرِهِ ثَلاَثَ مَرَّاتٍ- ‘তাক্বওয়া এখানে’ বলে তিনি নিজের সীনার দিকে তিনবার ইশারা করেন’।[6] অর্থাৎ যে অজুহাতেই পৃথক হও বা শত্রুতায় লিপ্ত হও না কেন, আল্লাহ তোমার মনের খবর রাখেন। তাকে ফাঁকি দেওয়া সম্ভব নয়। ক্বিয়ামতের দিন চুলচেরা হিসাব তিনি করবেন। এমনকি চোখের চোরা চাহনি দিয়েও তুমি কি অন্যায় করেছ, সেটারও খবর তিনি রাখেন। যেমন আল্লাহ বলেন, يَعْلَمُ خَائِنَةَ الْأَعْيُنِ وَمَا تُخْفِي الصُّدُورُ ‘তিনি জানেন তোমাদের চোখের চুরি ও অন্তরের লুকানো বিষয়সমূহ’ (মুমিন ৪০/১৯)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,لاَ يَدْخُلُ الْجَنَّةَ مَنْ كَانَ فِى قَلْبِهِ مِثْقَالُ ذَرَّةٍ مِنْ كِبْرٍ ‘ঐ ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না, যার অন্তরে এক সরিষা দানা পরিমাণ অহংকার রয়েছে’...।[7] তিনি বলেন,إِيَّاكُمْ وَالْحَسَدَ فَإِنَّ الْحَسَدَ يَأْكُلُ الْحَسَنَاتِ كَمَا تَأْكُلُ النَّارُ الْحَطَبَ- ‘তোমরা হিংসা করো না। কারণ হিংসা সকল নেকীকে খেয়ে ফেলে। যেমন আগুণ কাঠকে খেয়ে ফেলে’।[8] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এ সকল হুঁশিয়ার বাণী এ জন্য প্রদান করেছেন যে, মূলতঃ আত্ম-অহংকার ও হিংসাই দু’জন মুমিনের মধ্যে ভালবাসা সৃষ্টির পথে সবচেয়ে বড় অন্তরায়।

অহংকারী ব্যক্তি যালেম হয়ে থাকে। যুলম করে সে এক প্রকার আনন্দ পায় ও প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে আরও বেশী যুলম করে। অথচ যুলম কখনোই যালেমকে লাভবান করে না। বরং সে দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয় ও মযলূম লাভবান হয়। কবির কথায়-

لاَ تَظْلِمْنَ إِذَا مَا كُنْتَ مُقْتَدِرًا + فَالظُّلْمُ آخِرُهُ يَأْتِيكَ بِالنَّدَمِ

نَامَتْ عُيُونُكَ وَالْمَظْلُومُ مُنْتَبِهٌ + يَدْعُو عَلَيْكَ وَعَيْنُ اللهِ لَمْ تَنَمِ

‘তুমি যুলম করোনা যখন তুমি শক্তিশালী থাক। কারণ যুলম শেষ পর্যন্ত তোমাকে লজ্জা এনে দিবে’। ‘তোমার চোখ দু’টো ঘুমিয়ে যাবে। কিন্তু মযলূমের চোখ জেগে থাকবে। তোমার উপরে সে বদ দো‘আ করবে। মনে রেখ আল্লাহর চোখ কখনো ঘুমায় না’।[9] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,الظُّلْمُ ظُلُمَاتٌ يَوْمَ الْقِيَامَةِ- ‘যুলম ক্বিয়ামতের দিন যালেমের জন্য বহু অন্ধকার বয়ে আনবে’।[10] অতএব রাসূল (ছাঃ) বলেন,الْمُسْلِمُ مَنْ سَلِمَ الْمُسْلِمُونَ مِنْ لِسَانِهِ وَيَدِهِ ‘প্রকৃত মুসলমান সেই যার যবান ও হাত হ’তে অন্য মুসলমান নিরাপদ থাকে’।[11]

সম্পর্কহীনতার মেয়াদ :

মানুষ দুর্বল জীব। যেকোন দুর্বল মুহূর্তে সে ভালবাসার বদলে পরস্পরের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে বসে। তাই তাকে সুযোগ দিয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,لاَ يَحِلُّ لِمُسْلِمٍ أَنْ يَهْجُرَ أَخَاهُ فَوْقَ ثَلاَثٍ فَمَنْ هَجَرَ فَوْقَ ثَلاَثٍ فَمَاتَ دَخَلَ النَّارَ- ‘কোন মুসলিমের জন্য হালাল নয় অন্য মুসলিমের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন রাখা তিন দিনের অধিক। যে ব্যক্তি তিনদিনের অধিক সম্পর্ক ছিন্ন রাখল, অতঃপর মৃত্যুবরণ করল, সে জাহান্নামে প্রবেশ করল’।[12] তিনি বলেন,تُعْرَضُ أَعْمَالُ النَّاسِ فِى كُلِّ جُمُعَةٍ مَرَّتَيْنِ يَوْمَ الاِثْنَيْنِ وَيَوْمَ الْخَمِيسِ فَيُغْفَرُ لِكُلِّ عَبْدٍ مُؤْمِنٍ إِلاَّ عَبْدًا بَيْنَهُ وَبَيْنَ أَخِيهِ شَحْنَاءُ فَيُقَالُ اتْرُكُوا أَوِ ارْكُوا هَذَيْنِ حَتَّى يَفِيئَا- ‘সপ্তাহে দু’দিন সোম ও বৃহস্পতিবার বান্দার আমলনামা আল্লাহর নিকটে পেশ করা হয়। অতঃপর প্রত্যেক মুমিন বান্দাকে মাফ করা হয়। কেবল ঐ দু’ভাইয়ের আমলনামা, যাদের মধ্যে শত্রুতা রয়েছে। আল্লাহ বলেন, এ দু’টো আমলনামা রেখে দাও, যতক্ষণ না এরা মীমাংসা করে নেয়’।[13] বুঝা গেল যে, আল্লাহ চান যেকোন মূল্যে বান্দার পারস্পরিক ভালবাসা ও কল্যাণময় সম্পর্ক।

মহববত বৃদ্ধির উপায় :

১. ঘণ ঘণ সালাম বিনিময় করা ২. সৎ ও মুত্তাক্বী ব্যক্তি খুঁজে নিয়ে তার সাথে বন্ধুত্ব করা ৩. বন্ধুর বাড়ীতে নিঃস্বার্থভাবে যাতায়াত করা ও খোঁজ খবর নেওয়া ৪. ছিদ্রান্বেষণ, গীবত, অহেতুক ধারণা ইত্যাদি থেকে দূরে থাকা।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,أَوَلاَ أَدُلُّكُمْ عَلَى شَىْءٍ إِذَا فَعَلْتُمُوهُ تَحَابَبْتُمْ أَفْشُوا السَّلاَمَ بَيْنَكُمْ- ‘আমি কি তোমাদেরকে বলে দেব না কোন কাজ করলে তোমরা পরস্পরে বন্ধু হ’তে পারবে? বেশী বেশী সালাম বিনিময় কর’।[14]

অন্যত্র আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বলেন,لاَ تُصَاحِبْ إِلاَّ مُؤْمِنًا وَلاَ يَأْكُلْ طَعَامَكَ إِلاَّ تَقِىٌّ- ‘তুমি প্রকৃত মুমিন ব্যতীত কাউকে সাথী বানিয়ো না এবং মুত্তাক্বী ব্যতীত তোমার খাদ্য যেন কেউ না খায়’।[15]

অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, أَنَّ رَجُلاً زَارَ أَخًا لَهُ فِى قَرْيَةٍ أُخْرَى فَأَرْصَدَ اللهُ لَهُ عَلَى مَدْرَجَتِهِ مَلَكًا فَلَمَّا أَتَى عَلَيْهِ قَالَ أَيْنَ تُرِيدُ قَالَ أُرِيدُ أَخًا لِى فِى هَذِهِ الْقَرْيَةِ. قَالَ هَلْ لَكَ عَلَيْهِ مِنْ نِعْمَةٍ تَرُبُّهَا قَالَ لاَ غَيْرَ أَنِّى أَحْبَبْتُهُ فِى اللهِ عَزَّ وَجَلَّ. قَالَ فَإِنِّى رَسُولُ اللهِ إِلَيْكَ بِأَنَّ اللهَ قَدْ أَحَبَّكَ كَمَا أَحْبَبْتَهُ فِيهِ- ‘কোন বন্ধু যখন অন্য গ্রামে তার অপর বন্ধুর সাথে সাক্ষাতের জন্য যায়, তখন আল্লাহ তার সাথে একজন ফেরেশতাকে পাঠিয়ে দেন। ফেরেশতা তাকে জিজ্ঞেস করেন, তুমি যেখানে যার কাছে যাচ্ছ, সেখানে বা তার কাছে তোমার কোন স্বার্থ বা সম্পদ আছে কি যার কারণে তুমি সেখানে যাচ্ছে? লোকটি বলে যে, না আমি সেখানে যাচ্ছি স্রেফ এজন্য যে, আমি তাঁকে আল্লাহর ওয়াস্তে ভালবাসি। ফেরেশতা বলেন, আমি আল্লাহর পক্ষ হ’তে তোমার নিকটে দূত হিসাবে প্রেরিত হয়েছি এই শুভ সংবাদ নিয়ে যে, আল্লাহ তোমাকে ভালবেসেছেন, যেমন তুমি তোমার বন্ধুকে আল্লাহর জন্য ভালবেসেছ’।[16]

রাসূল (ছাঃ) বলেন, إِيَّاكُمْ وَالظَّنَّ، فَإِنَّ الظَّنَّ أَكْذَبُ الْحَدِيثِ، وَلاَ تَحَسَّسُوا، وَلاَ تَجَسَّسُوا، وَلاَ تَحَاسَدُوا، وَلاَ تَدَابَرُوا، وَلاَ تَبَاغَضُوا، وَكُونُوا عِبَادَ اللهِ إِخْوَانًا- ‘তোমরা অহেতুক ধারণা থেকে বেঁচে থাক। কেননা অহেতুক ধারণা সর্বাধিক বড় মিথ্যা। তোমরা কারু সম্পর্কে অহেতুক সন্ধানী হয়ো না। কারো ছিদ্রান্বেষণ করো না। খরিদ্দারকে ঠকানোর জন্য দালালী করোনা। আপোষে হিংসা করো না, বিদ্বেষ করো না, ষড়যন্ত্র করো না। তোমরা আল্লাহর বান্দা হিসাবে সকলে ভাই ভাই হয়ে যাও’।[17]

আল্লাহ বলেন, وَلاَ تَجَسَّسُوا ‘তোমরা পরস্পরে গীবত করো না’ (হুজুরাত ৪৯/১২)। রাসূল (ছাঃ) বলেন, أَتَدْرُونَ مَا الْغِيبَةُ... ذِكْرُكَ أَخَاكَ بِمَا يَكْرَهُ... إِنْ كَانَ فِيهِ مَا تَقُولُ فَقَدِ اغْتَبْتَهُ وَإِنْ لَمْ يَكُنْ فِيهِ فَقَدْ بَهَتَّهُ- ‘তোমরা কি জানো গীবত কাকে বলে?... তোমার ভাই যেটাকে অপসন্দ করে সেটা বলাকেই গীবত বলে। ... যদি তার মধ্যে সেই দোষ থাকে, তবে সেটা গীবত হবে। আর যদি না থাকে, তবে তোহমত হবে।[18] এই গীবত আরও মারাত্মক হয়, যখন তা লিখিত ভাবে বই বা পত্রিকার মাধ্যমে প্রচারিত হয়। কেননা তা গীবতকারীর মৃত্যুর পরেও স্থায়ী থাকে এবং এর ফলে তার আমলনামায় গোনাহ জারি থাকে। এছাড়া ঐসব পাঠ করে সত্য-মিথ্যা যাচাই না করে যারা বিশ্বাস করে তারাও গোনাহগার হয়। ফলে একজন গীবতকারী যেমন নিজের পরকাল নষ্ট করে, তেমনি অপরের পরকাল নষ্ট করে। দুর্ভাগ্য আজকের যুগে বই-পত্রিকায় এ সবেরই প্রাদুর্ভাব বেশী। আল্লাহ আমাদের হেফাযত করুন-আমীন!

নিঃস্বার্থ ভালবাসার নেকী :

হযরত মু‘আয বিন জাবাল (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, قَالَ اللهُ تَبَارَكَ وَتَعَالَى وَجَبَتْ مَحَبَّتِي لِلْمُتَحَابِّينَ فِيَّ وَالْمُتَجَالِسِينَ فِيَّ وَالْمُتَزَاوِرِينَ فِيَّ وَالْمُتَبَاذِلِينَ فِيَّ- ‘আল্লাহ বলেন, আমার মহববত ওয়াজিব হয়ে যায় ঐ ব্যক্তিদের জন্য যারা আমার জন্য পরস্পরে বন্ধুত্ব করেছে, আমার জন্য পরস্পরে একত্রে বসেছে, আমার জন্য পরস্পরে সাক্ষাৎ করেছে ও আমার জন্য পরস্পরে খরচ করেছে’। তিরমিযীর বর্ণনায় এসেছে যে, قَالَ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ الْمُتَحَابُّونَ فِى جَلاَلِى لَهُمْ مَنَابِرُ مِنْ نُورٍ يَغْبِطُهُمُ النَّبِيُّونَ وَالشُّهَدَاءُ- ‘আল্লাহ বলবেন, আমার সম্মানে পরস্পরে বন্ধুত্ব স্থাপন কারীদের জন্য (ক্বিয়ামতের দিন) নূরের মিম্বর সমূহ থাকবে, যার আকাংখা পোষণ করবেন নবীগণ ও শহীদগণ’।[19]

হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন যে, ‘আল্লাহ যখন কোন বান্দাকে ভালবাসেন, তখন জিব্রীল (আঃ)-কে ডেকে বলেন, আমি অমুককে ভালবেসেছি, তুমিও তাকে ভালবাস। জিব্রীল (আঃ) তখন তাকে ভালবাসেন। অতঃপর আসমান জগতে আওয়ায দিয়ে বলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহপাক অমুককে ভালবেসেছেন। অতএব তোমরাও অমুককে ভালবাস তখন আসমান বাসীগণ ঐ বান্দাকে ভালবাসেন। অতঃপর পৃথিবীতে তার ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা এনে দেওয়া হয়। পক্ষান্তরে আল্লাহপাক যখন কোন বান্দার প্রতি শত্রুভাব পোষণ করেন, তখন তিনি জিব্রীল (আঃ)-কে ডেকে বলেন, আমি অমুককে শত্রু মনে করি, তুমিও তাকে শত্রু গণ্য কর। তখন জিব্রীল (আঃ) তাকে শত্রু গণ্য করেন। অতঃপর আসমান বাসীকে ডেকে বলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহপাক অমুক ব্যক্তিকে শত্রু গণ্য করেছেন, অতএব তোমরাও তাকে শত্রু গণ্য কর। তখন তারা তাকে শত্রু গণ্য করেন। অতঃপর পৃথিবীর বুকে তার জন্য ব্যাপক শত্রুভাব এনে দেওয়া হয়’।[20] আব্দুল্লাহ ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন যে,جَاءَ رَجُلٌ إِلَى رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ- فَقَالَ يَا رَسُولَ اللهِ كَيْفَ تَقُولُ فِى رَجُلٍ أَحَبَّ قَوْمًا وَلَمْ يَلْحَقْ بِهِمْ فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ- الْمَرْءُ مَعَ مَنْ أَحَبَّ- ‘একদা একজন ব্যক্তি রাসূল (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি ঐ ব্যক্তি সম্পর্কে কি বলেন, যে ব্যক্তি একদল লোককে ভালবাসে। কিন্তু কোনদিন তাদের সঙ্গে সাক্ষাত হয়নি। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) জওয়াব দিলেন, (ক্বিয়ামতের দিন) মানুষ তার সঙ্গেই থাকবে, যাকে সে ভালবাসে’।[21]

হযরত আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন যে,أَنَّ رَجُلاً مِنْ أَهْلِ الْبَادِيَةِ أَتَى النَّبِىَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ- فَقَالَ يَا رَسُولَ اللهِ مَتَى السَّاعَةُ قَائِمَةٌ قَالَ : وَيْلَكَ وَمَا أَعْدَدْتَ لَهَا. قَالَ : مَا أَعْدَدْتُ لَهَا إِلاَّ أَنِّى أُحِبُّ اللهَ وَرَسُولَهُ. قَالَ : إِنَّكَ مَعَ مَنْ أَحْبَبْتَ- ‘একদা একজন লোক এসে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলল, ক্বিয়ামত কবে হবে? রাসূল (ছাঃ) তাকে ধমক দিয়ে বললেন, বল সেদিনের জন্য তুমি কি প্রস্ত্ততি নিয়েছ? লোকটি বলল, কোন প্রস্ত্ততি নেইনি। কেবল এতটুকুই যে আমি ভালবাসি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল-কে। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, ‘যাকে তুমি ভালবাস, তার সঙ্গেই তুমি থাকবে’। রাবী আনাস (রাঃ) বলেন, এরপর থেকে আমি মুসলমানদেরকে এত আনন্দিত দেখেছি। যা ইসলাম আনার পর কোনদিন তাদেরকে দেখিনি।[22]

শেষোক্ত হাদীছে স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, ভালবাসা কেবল হৃদয়ে পোষণ করলেই হবে না, তার জন্য প্রস্ত্ততি নিতে হবে। আল্লাহ ও রাসূলকে ভালবাসলে রাসূলের আদর্শকে ভালবাসতে হবে ও তাঁর আনুগত্য করতে হবে। অহি-র বিধান মেনে চলতে হবে। কেবলমাত্র বৈঠকে ও মিছিলে তাকবীর ধ্বনি ও শ্লোগানই যথেষ্ট নয়। বঙ্গভবনে বসে মীলাদুন্নবী করব, নবীর নামে দরূদ পাঠাব। আর সেই বঙ্গভবনে বসেই নবীর আদর্শ বিরোধী বিলে স্বাক্ষর দিয়ে আইনে পরিণত করব। আর সেই আইন দিয়ে আল্লাহর বান্দাদের উপরে শাসন চালাব- এটা সম্পূর্ণ দ্বিমুখী নীতির পরিচয়। রাবে‘আ বছরী (রাঃ) বলেন,

تَعْصِي الْإِلَهَ وَأَنْتَ تُظْهِرُ حُبَّهُ + هَذَا لَعَمْرُكَ فِي الْقِيَاسِ بَدِيعُ

لَوْ كَانَ حُبُّكَ صَادِقًا لَأَطَعْتَهُ + إِنَّ الْمُحِبَّ لِمَنْ يُحِبُّ مُطِيعُ

‘তুমি আল্লাহর অবাধ্যতা করবে, আর তার মহববত যাহির করবে এটা বড় অভিনব বিষয়। যদি তোমার ভালবাসা সত্য হয়, তবে অবশ্যই তুমি তাঁর আনুগত্য করবে। কেননা যে যাকে ভালবাসে, অবশ্যই সে তার আনুগত্য করে’।[23]

অতএব আসুন আমরা আল্লাহর আনুগত্যে পরস্পরে নিঃস্বার্থ ভালবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হই ও কল্যাণময় সমাজ গড়ে তুলি। আল্লাহ আমাদের কবুল কর।- আমীন!


[1]. মুসলিম হা/২৫৬৬; মিশকাত হা/৫০০৬ ‘শিষ্টাচার সমূহ’ অধ্যায়।

[2]. বুখারী হা/৬০২৬; মুসলিম হা/২৫৮৫; মিশকাত হা/৪৯৫৫।

[3]. বুখারী হা/৬০১১; মুসলিম হা/২৫৮৬; মিশকাত হা/৪৯৫৩।

[4]. বুখারী হা/২৪৪২; মুসলিম হা/২৫৮০; মিশকাত হা/৪৯৫৮।

[5]. বুখারী হা/৬৬০; মুসলিম হা/১০৩১; মিশকাত হা/৭০১।

[6]. মুসলিম হা/২৫৬৪; মিশকাত হা/৪৯৫৯।

[7]. মুসলিম হা/৯১; মিশকাত হা/৫১০৮।

[8]. আবুদাঊদ হা/৪৯০৩; মিশকাত হা/৫০৪০।

[9]. মিরক্বাত হা/৪৯৫৮-এর ব্যাখ্যা ৯/২১৬।

[10]. বুখারী হা/২৪৪৭; মুসলিম হা/২৫৭৯; মিশকাত হা/৫১২৩।

[11]. বুখারী হা/১০; মুসলিম হা/৪০; মিশকাত হা/৬।

[12]. আবুদাঊদ হা/৪৯১৪; আহমাদ হা/১৫৮৯; মিশকাত হা/৫০৩৫।

[13]. মুসলিম হা/২৫৬৫; মিশকাত হা/৫০৩০।

[14]. মুসলিম হা/৫৪; মিশকাত হা/৪৬৩১।

[15]. আবুদাঊদ হা/৪৮৩২; তিরমিযী হা/২৩৯৫; দারেমী হা/২০৫৭; আহমাদ হা/১১৩৫৫; মিশকাত হা/৫০১৮।

[16]. মুসলিম হা/২৫৬৭; মিশকাত হা/৫০০৭।

[17]. বুখারী হা/৬০৬৪; মুসলিম হা/২৫৬৩; মিশকাত হা/৫০২৮।

[18]. মুসলিম হা/২৫৮৯; মিশকাত হা/৪৮২৮।

[19]. মুওয়াত্ত্বা হা/৩৫০৭; তিরমিযী হা/২৩৯০; মিশকাত হা/৫০১১, সনদ ছহীহ।

[20]. মুসলিম হা/২৬৩৭; মিশকাত হা/৫০০৫ ‘।

[21]. বুখারী হা/৬১৬৯; মুসলিম হা/২৬৪০; মিশকাত হা/৫০০৮ ‘আল্লাহর জন্য ভালোবাসা’ অনুচ্ছেদ-১৬।

[22]. বুখারী হা/৬১৬৭; মুসলিম হা/২৬৩৯; মিশকাত হা/৫০০৯।

[23]. মিরক্বাত ৯/২৫০ পৃ.।