প্রকৃতির সৃষ্টিকর্তা

عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ- قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ- قَالَ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ يُؤْذِينِى ابْنُ آدَمَ، يَسُبُّ الدَّهْرَ وَأَنَا الدَّهْرُ، بِيَدِى الأَمْرُ، أُقَلِّبُ اللَّيْلَ وَالنَّهَارَ-

হযরত আবু হুরায়রাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন যে, ‘আল্লাহ বলেন, আদম সন্তান আমাকে কষ্ট দিয়ে থাকে। সে প্রকৃতিকে গালি দেয়। অথচ আমিই প্রকৃতি। আমার হাতেই যাবতীয় ক্ষমতা। আমিই রাত্রি ও দিনের বিবর্তন ঘটিয়ে থাকি’।[1]

৩. শাব্দিক ব্যাখ্যা : (১) ক্বা-লাল্লা-হু তা‘আ-লা : ‘মহান আল্লাহ বলেন, এটি হাদীছে কুদসী অর্থাৎ যে হাদীছের ভাষা ও মর্ম সবই আল্লাহর পক্ষ হ’তে হয়। তাই রাসূল (ছাঃ)-এর যবান দিয়ে উচ্চারিত হলেও এটি শব্দ ও অর্থে পূর্ণভাবে আল্লাহর কালাম। সেকারণ হাদীছের সূচনা হয়েছে ‘ক্বা-লাল্লা-হু তা‘আলা’ বাক্য দ্বারা।

(২) ‘ই’উযীনী ইবনু আ-দামা’ : ঈযা’ (الإِيْذَاءُ) মাছদার হ’তে باب إفعال-এর مضارع معروف হয়েছে। অর্থ ‘আদম সন্তান আমাকে কষ্ট দেয়’। ‘ইবনু’ অর্থ পুত্র সন্তান কিন্তু এখানে جنس বা জাতি হিসাবে এসেছে। অর্থাৎ মানব সন্তান, চাই পুরুষ হৌক বা নারী হৌক। তাছাড়া পুরুষ ‘আদম’ থেকে নারী ‘হাওয়া’-র জন্ম হওয়ায় ‘ইবনু’ শব্দটি উভয়ের উপরে বর্তায়। যেমন আল্লাহ বলেন, وَلَقَدْ كَرَّمْنَا بَنِي آدَمَ ‘আমরা আদম সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি’ (বনী ইস্রাঈল ১৭/৭০)। يُؤْذِينِى ‘আমাকে কষ্ট দেয়’ বাক্যটি ‘মুতাশা-বিহ’। যার প্রকৃত তাৎপর্য আল্লাহ ব্যতীত কেউ অবগত নন। কেননা আল্লাহর সত্তা কষ্ট পাওয়া হ’তে মুক্ত। এক্ষণে এর বাস্তব অর্থ এই হ’তে পারে যে,يَقُولُ فِي حَقِّي مَا أَكْرَهُ، وَيَنْسِبُ إِلَيَّ مَا لاَ يَلِيقُ بِي- ‘আমার বিষয়ে বান্দা এমন সব কথা বলে, যা আমি অপসন্দ করি এবং আমার দিকে এমন সব বিষয় সম্বন্ধ করে, যার যোগ্য আমি নই’ (মিরক্বাত হা/২২-এর আলোচনা)

(৩) أَنَا الدَّهْرُ ‘আমিই প্রকৃতি’ কথাটি ‘তাকীদ’ অর্থে এসেছে। আসল বাক্য হবে أَنَا خَالِقُ الدَّهْرِ ‘আমি প্রকৃতির সৃষ্টিকর্তা’। খালেক্ব ‘মুযাফ’-কে বিলুপ্ত করে مضافاف اليه-কে مضاف -এর স্থলে বসিয়ে أَنَا الدَّهْرُ বলা হয়েছে। আরবী ব্যাকরণ রীতিতে এগুলি ‘তাকীদ’ বুঝানোর জন্য আসে। অর্থাৎ প্রকৃতি বা যামানাকে গালি দেওয়া অর্থ আমাকে গালি দেওয়া। কেননা আমিই প্রকৃতির স্রষ্টা। যেমন কোন কর্মকর্তা বলে থাকেন, ‘আমিই অমুক প্রতিষ্ঠান’। অর্থাৎ তিনি উক্ত প্রতিষ্ঠানের মূল ব্যক্তি।

(৪) بِيَدِى الأَمْرُ ‘আমার হাতেই যাবতীয় ক্ষমতা’। ‘ইয়াদাইয়া’ -অর্থ ‘আমার দু’হাত’। তাকীদ ও আধিক্য বুঝানোর জন্য বলা হয়েছে। অর্থাৎ ভাল-মন্দ সকল কাজ আমারই ইচ্ছাধীন।

এখানে দু’টি বিষয় মনে রাখা আবশ্যক। (১) আল্লাহ ভাল-মন্দ সবকিছুর স্রষ্টা। কিন্তু বান্দা হ’ল কর্তা। বান্দা তার কর্ম অনুযায়ী ফল পাবে। তাকে ভাল ও মন্দ উভয় কাজ করার ইচ্ছা ও কর্মশক্তি আল্লাহ দান করেছেন। অতএব অদৃষ্টবাদী জাবরিয়া দার্শনিকদের বক্তব্য অনুযায়ী বান্দা কোন বাধ্যগত জীব নয়। বরং বান্দা চুরি করলে শাস্তি পাবে। এর জন্য আল্লাহ দায়ী হবেন না।

(২) আল্লাহ নিরাকার নন। তাঁর হাত আছে, পা আছে, চক্ষু আছে, কর্ণ আছে। তবে তার আকার কেমন, তা কেউ জানেনা। তার তুলনীয় কিছুই নেই। মু‘তাযিলা, জাহমিয়া ও জাবরিয়া দার্শনিকগণ আল্লাহর গুণাবলীকে যেমন অস্বীকার করেন, তেমনি আল্লাহর আকার সম্বলিত কুরআনের বিভিন্ন আয়াত ও ছহীহ হাদীছ সমূহের মূল অর্থ বাদ দিয়ে রূপক অর্থ করেন। যেমন তারা ‘আল্লাহর হাত’ অর্থ করেন ‘আল্লাহর কুতরত’। ‘আল্লাহর চেহারা’ অর্থ করেন ‘আল্লাহর সত্তা’ ইত্যাদি। এঁরা সঠিক সিদ্ধান্তে কেউ আসতে পারেননি। অন্যদিকে ‘মুশাবিবহাহ’ বা ‘মুজাসসিমাহ’ দার্শনিকগণ আল্লাহকে মানবদেহের সদৃশ কল্পনা করেছেন, যা আর এক বাড়াবাড়ি। উভয়ের মধ্যবর্তী সঠিক পথ হ’ল এই যে,আল্লাহর আকার আছে। কিন্তু তা কেমন তা কেউ জানেনা। যেমন আল্লাহ বলেন, لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ ‘তাঁর তুলনীয় কিছুই নেই; তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা’ (শূরা ৪২/১১)। এই মধ্যবর্তী আক্বীদা হ’ল আহলে সুন্নাত আহলেহাদীছের আক্বীদা। 

(৫) أُقَلِّبُ ‘আমি বিবর্তন ঘটাই’ قَلَّبَ يُقَلِّبُا باب تفعيل تَقْلِيْبًا থেকেإثبات فعل مضارع معروف ছীগা واحد متكلم বা একবচন উত্তম পুরুষ। باب تفعيل-এর ‘মুবালাগাহ’ (مبالغه) বা আধিক্য বোধক ‘খাছছাহ’ বা বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী এখানে উক্বাল্লিবু (اُقَلِّبُ) অর্থ হবে ‘আমি ওলট-পালট করি’। অর্থাৎ রাত্রি-দিনের আগমন-নির্গমন, ঋতু চক্রের আবর্তন-বিবর্তন সবই আল্লাহর হাতে। কালের নিজস্ব কোন ক্ষমতা নেই। এর মধ্যে ডারউইনের Theory of evolution বা বিবর্তনবাদের প্রতিবাদ রয়েছে। এখানে আরেকটি বিষয় লক্ষণীয় যে, কুরআনের অনেক স্থানে আল্লাহ নিজের জন্য (উচ্চ মর্যাদার কারণে) বহুবচনের শব্দ ব্যবহার করেছেন। যেমন তিনি বলেন, إِنَّا نَحْنُ نُحْيِ الْمَوْتَى ‘আমরাই মৃতদের জীবিত করি’ (ইয়াসীন ৩৬/১২)। কিন্তু এখানে আল্লাহ কালের বিবর্তনকে সরাসরি নিজের দিকে সম্বন্ধ করে ‘নুক্বাল্লিবু’ (نُقَلِّبُ) বহুবচন না বলে ‘উক্বাল্লিবু’ (أُقَلُبُ) একবচনের ক্রিয়া ব্যবহার করেছেন প্রকৃতির পরিচালনাকে নিজের দিকে নিশ্চিতভাবে বুঝানোর জন্য।

৪. সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা : অত্র হাদীছটি ইসলামের একটি মৌলিক নীতি নির্দেশক হাদীছ। আল্লাহর একত্ববাদকে যাবতীয় অংশীবাদ থেকে মুক্ত করে আল্লাহকে ভাল-মন্দ সকল বিষয়ের সৃষ্টিকর্তা হিসাবে এখানে ঘোষণা করা হয়েছে। মজুসীগণ আলো ও অাঁধারের দু’টি সত্তাকে সৃষ্টির মূল হিসাবে মনে করে। তবে আদি মজুসীগণ আলো বা নূরকে আদি ও অন্ধকারকে ‘পরবর্তীকালে সৃষ্ট’ (مُحْدَثَةٌ) বলে। আলো ও অাঁধার দুই সত্তাকে তারা ফারসী ভাষায় যথাক্রমে ‘ইয়াযদান’ (يَزْدَانُ) ও ‘আহরিমান’ (أَهْرِمَنْ) বলে থাকে। ইসলাম আল্লাহকেই সবকিছুর একক সৃষ্টিকর্তা ও আদি কারণ হিসাবে পেশ করে। তিনিই কালের স্রষ্টা। কালের আবর্তন-বিবর্তন, শীত-গ্রীষ্মের আগমন-নির্গমন, দিবারাত্রির দীর্ঘতা- হরস্বতা, ঋতুর বৈচিত্র্য, সৌরমন্ডল ও মহাশূন্যের বিস্ময়কর সৃষ্টি লীলা, ভূপৃষ্ট ও ভূগর্ভের এবং সাগর বক্ষের সীমাহীন অজ্ঞাত রহস্য, গ্রীষ্মের খরতাপ, শীতের রুক্ষতা, বর্ষার সিক্ততা, মেঘমেদুর আকাশে বিদ্যুতের চমক ও বজ্রের হুংকার, নিস্তরংগ নদীবক্ষে বন্যার উন্মত্ততা, মলয় হিল্লোলে ঝড়ের উদ্দামতা, শান্ত প্রকৃতির অশান্ত ও বন্য আচরণ সবকিছুই আল্লাহর হুকুমে হয়ে থাকে, প্রকৃতির খেয়ালে নয়। তাঁর নির্দেশের বাইরে গাছের একটি পাতাও পড়েনা। তিনি যেমন মানুষের সৃষ্টিকর্তা, তেমনি পৃকৃতিরও সৃষ্টিকর্তা।

তিনি কুল মাখলূক্বাতের স্রষ্টা। কিছু মানুষ আল্লাহর এই বিরাট সৃষ্টি রহস্য বুঝতে অক্ষম হয়ে খোদ প্রকৃতিকেই আল্লাহ ভেবে বসে এবং অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, ঝড়-ঝঞ্ঝা-বন্যা ইত্যাদিকে ‘প্রকৃতির খেয়ালীপনা’ বলে আখ্যায়িত করে। এ বিষয়ে মানব সমাজে দু’টি দল রয়েছে।-

একদল তারাই যারা প্রকৃতিবাদী বা দাহরিয়া। এরা প্রকৃতিকে সবকিছুর স্রষ্টা ভাবেন। তাদের ভাষায়, Rolled by Eternal laws of Iron ‘শাশ্বত লৌহবিধানের মাধ্যমে সবকিছু পরিচালিত হচ্ছে’। সূর্য নিজ ইচ্ছায় পূর্বদিকে উঠছে ও পশ্চিমে ডুবছে। মানুষ আপনা আপনি ছোট থেকে বড় হচ্ছে ও একসময় বৃদ্ধ হয়ে মারা যাচ্ছে। গারে কচি পাতা আপনা থেকেই হ’লুদ হয়ে ঝরে পড়ছে। আবার কখনো অলৌকিক ক্রিয়াকান্ড ঘটছে, যা জ্ঞানে আসে না, যুক্তিতে বেড় পায় না। সবকিছুই প্রকৃতির খেয়ালীপনা বৈ কিছুই নয়। এই সব লোকেরা প্রকৃতির কোন পরিচালক বা সৃষ্টিকর্তা আছেন বলে বিশ্বাস করেন না। তারা বলেন,وَقَالُوا مَا هِيَ إِلاَّ حَيَاتُنَا الدُّنْيَا نَمُوتُ وَنَحْيَا وَمَا يُهْلِكُنَا إِلاَّ الدَّهْرُ- ‘আমাদের এই দুনিয়াবী জীবনই সবকিছু। এখানেই আমরা মরি ও বাঁচি। আমাদের কেউ ধ্বংস করে না প্রকৃতি ব্যতীত’ (জাছিয়াহ ৪৫/২৪)

অন্য দল আল্লাহ’তে বিশ্বাস রাখেন। কিন্তু প্রাকৃতিক উত্থান-পতন ও ভাঙ্গাগড়াকে এবং বিভিন্ন বিপদ-মুছীবতকে আল্লাহর দিকে সম্পর্কিত করতে অপসন্দ করেন। এজন্য তারা প্রকৃতিকে দোষারোপ করেন ও গালি দেন। যদি তারা এর দ্বারা এই আক্বীদা পোষণ করে থাকেন যে, যথার্থভাবেই প্রকৃতি এজন্য দায়ী, তবে তারা মুখে আল্লাহর নাম উচ্চারণ করলেও ‘কাফের’ হয়ে যাবেন। আর যদি অনুরূপ আক্বীদা না থাকে, বরং কথার কথা হিসাবে বলে থাকেন, তবে কুফরীর সামঞ্জস্য হওয়ার কারণে তারা ‘কবীরা গোনাহগার’ হবেন। যা তওবা ব্যতীত মাফ হয় না। পক্ষান্তরে খাঁটি তাওহীদবাদী মুমিন আল্লাহকেই এ পৃথিবী ও এর মধ্যস্থিত ও বহির্জগতের সবকিছুর একক সৃষ্টিকর্তা ও পরিচালক হিসাবে বিশ্বাস করেন। তারা বলেন,وَلِلَّهِ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَيَوْمَ تَقُومُ السَّاعَةُ يَوْمَئِذٍ يَخْسَرُ الْمُبْطِلُونَ- ‘নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের রাজত্ব আল্লাহরই। যেদিন ক্বিয়ামত সংঘটিত হবে, সেদিন বাতিল পন্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে’ (জাছিয়াহ ৪৫/২৭)। এ পৃথিবীতে কোনকিছুই আপনা থেকে ঘটেনা। বরং আল্লাহর হুকুমে সম্পাদিত হয় বলে তারা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন। তিনি বান্দার মঙ্গলের জন্যই সবকিছু করেন। তাঁর নিদ্রাও নেই তন্দ্রাও নেই। তিনি সদা জাগ্রত ও সবকিছুর ধারক। তাঁর দৃষ্টিকে এড়িয়ে কারু কিছু করার ক্ষমতা নেই। বান্দার অপকর্মের শাস্তি তিনি দুনিয়াতেও দেন, আখেরাতেও দেন। ইচ্ছা করলে তিনি কাউকে দুনিয়াতে অপকর্মের স্বাধীনতা দিয়ে আখেরাতে পুরোপুরি বদলা দান করেন। কাউকে দুনিয়াতেই শাস্তি দিয়ে আখেরাতে মাফ করেন। নারী বা পুরুষের এক সরিষা দানা পরিমাণ পাপ বা পুণ্য তাঁর দৃষ্টিতে ধরা পড়ে ও তার প্রাপ্য শাস্তি বা পুরষ্কার যথার্থ ইনছাফের ভিত্তিতে সে প্রাপ্ত হয়। এক্ষণে পৃথিবীতে এলাহী গযব নাযিলের কিছু কারণ ও ধারা আলোচিত হ’ল।-

(১) আমল : বান্দার অন্যায় আমলের কারণেই এলাহী গযব নাযিল হয়। যেমন আল্লাহ বলেন,فَلْيَحْذَرِ الَّذِينَ يُخَالِفُونَ عَنْ أَمْرِهِ أَنْ تُصِيبَهُمْ فِتْنَةٌ أَوْ يُصِيبَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ- ‘অতএব যারা তাঁর আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করে, তারা এ বিষয়ে সাবধান হৌক যে, ফিৎনা তাদেরকে গ্রাস করবে অথবা মর্মন্তুদ শাস্তি তাদের উপর আপতিত হবে’ (নূর ২৪/৬৩)

(খ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একদা কুরায়েশ বংশের সকলকে একত্রে জমা করে তাদের প্রতি আহবান জানিয়ে বললেন, ‘হে বনু কুরায়েশ! তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নাম থেকে বাঁচাও। আমি তোমাদেরকে আল্লাহর আযাব থেকে বাঁচাতে পারব না। হে বনু কা‘ব বিন লুওয়াই, হে বনু মুর্রাহ বিন কা‘ব, হে বনু আব্দে শাম্স, হে বনু আব্দে মানাফ, হে বনু হাশিম, হে বনু আব্দিল মুত্ত্বালিব, তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও। হে আববাস বিন আব্দুল মুত্ত্বালিব! আল্লাহর হাত থেকে আমি আপনাকে বাঁচাতে পারব না। হে রাসূলের ফুফু ছাফিইয়াহ! আমি আপনাকে আল্লাহর হাত থেকে বাঁচাতে পারব না। হে মুহাম্মাদ কন্যা ফাতিমা!أَنْقِذِى نَفْسَكِ مِنَ النَّارِ، سَلِينِى مَا شِئْتِ مِنْ مَالِى لاَ أُغْنِى عَنْكِ مِنَ اللهِ شَيْئًا- ‘তুমি নিজেকে জাহান্নাম থেকে বাঁচাও। আমার মাল-সম্পদ থেকে যা খুশী চেয়ে নাও। কিন্তু আল্লাহর হাত থেকে আমি তোমাদেরকে রক্ষা করতে পারব না’।[2]

(২) বিশেষ বিশেষ অন্যায় কর্ম : বিভিন্ন ছহীহ হাদীছ একত্রিত করলে নিম্নোক্ত অন্যায় কর্ম সমূহকে এলাহী গযব নাযিলের বিশেষ কারণ হিসাবে চিহ্নিত করা যায়। যেমন- 

(১) ইহূদী-নাছারা সহ অধঃপতিত বিগত উম্মত সমূহের বদ স্বভাব প্রাপ্ত হওয়া।[3]

(২) ইলম উঠে যাওয়া ও আমল কমে যাওয়া।

(৩) ফিৎনা-ফাসাদ বিস্তৃত হওয়া।

(৪) কৃপণতা ছড়িয়ে পড়া।

(৫) হত্যা বৃদ্ধি পাওয়া।[4]

(৬) পথভ্রষ্ট ব্যক্তিগণ নেতা হওয়া।[5]

(৭) শিরক পরিব্যপ্ত হওয়া।

(৮) কবর পূজা, মূর্তি ও প্রতিকৃতি পূজা, বৃক্ষ পূজা ইত্যাদি শুরু হওয়া।

(৯) ত্রিশজন ভন্ডনবীর উদয় হওয়া।[6]

(১০) মূর্খতা, ব্যভিচার, নামে-বেনামে মদ্য পান ব্যপ্তিলাভ করা, পুরুষের সংখ্যা কমে যাওয়া ও নারীর সংখ্যা এমনকি (ক্ষেত্র বিশেষে) ৫০ গুণ বৃদ্ধি পাওয়া।[7]

(১১) অযোগ্য নেতা ও দায়িত্বশীলের কারণে (রাষ্ট্রের বা সমাজের আমানত ধ্বংস হওয়া।[8]

(১২) দেশের মানুষ ব্যাপকহারে দুষ্ট-বদমায়েশ হয়ে যাওয়া।[9]

হযরত আব্দুল্লাহ বিন আববাস (রাঃ) বলেন, যখন কোন কওমের মধ্যে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক আমানতের খেয়ানত ব্যপ্তিলাভ করে, তখন আল্লাহ তাদের অন্তর সমূহে ভীতি ও ত্রাসের সঞ্চার করেন। যখন কোন জনপদে যেনা-ব্যভিচার ছড়িয়ে পড়ে, তখন সেই সমাজে মৃত্যুহার বৃদ্ধি পায়। যখন কোন সমাজে মাপ ও ওযনে কম দেওয়ার প্রবণতা দেখা দেয়, তখন সেই সমাজে রূযির স্বচ্ছলতা বন্ধ করে দেওয়া হয়। যখন কোন সমাজে অবিচার শুরু হয়, তখন সেই সমাজে খুন-খারাবী সস্তা হয়ে যায়। যখন কোন কওম চুক্তিভঙ্গ করে, তখন তাদের উপরে শত্রু জয়লাভ করে’।[10] তবে ইবনু আবদিল বার্র বলেন, আমরা হাদীছটি তাঁর থেকে ‘অবিচ্ছিন্ন’ সনদে রেওয়ায়াত করেছি এবং এমন ধরনের ভবিষ্যদ্বাণী কোন ছাহাবী নিজের থেকে করতে পারেন না’।[11] আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হ’তে বর্ণনা করেন, ‘যখন কোন সমাজে যেনা ও সূদ ব্যাপকতা লাভ করে, তখন তারা আল্লাহর শাস্তিকে নিজেদের জন্য ওয়াজিব করে নেয়’।[12]

৩. অন্যায় ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাওয়া ও তা প্রতিরোধের চেষ্টা না করা :

হযরত আবু বকর ছিদ্দীক (রাঃ) একদা বলেন, ‘হে জনগণ! তোমরা এই আয়াত পাঠ করে থাক, يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا عَلَيْكُمْ أَنْفُسَكُمْ لَا يَضُرُّكُمْ مَنْ ضَلَّ إِذَا اهْتَدَيْتُمْ ‘হে মুমিনগণ! তোমরা সাধ্যমত তোমাদের কাজ করে যাও। পথভ্রষ্টরা তোমাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না, যখন তোমরা সৎপথে থাকবে’ (মায়েদাহ ৫/১০৫)। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি যে, إِنَّ النَّاسَ إِذَا رَأَوُا الْمُنْكَرَ لاَ يُغَيِّرُونَهُ أَوْشَكَ أَنْ يَعُمَّهُمُ اللهُ بِعِقَابِهِ- ‘নিশ্চয়ই লোকেরা পাপকাজ হ’তে দেখেও যখন তা প্রতিরোধ করবে না, আল্লাহ এর পরিণামে তাদের উপরে ব্যাপকভাবে বদলা নিবেন’।[13] আবুদাঊদের বর্ণনায় এসেছে, ‘যখন কেউ কোন অত্যাচারীকে অত্যাচার করতে দেখেও তার হাত ধরে না, অতি সত্ত্বর আল্লাহ তাদের সকলের উপরে ব্যাপকভাবে বদলা নেবেন’।

আবুদাঊদের অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘যখন কোন কওমের মধ্যে গোনাহের কাজ হ’তে থাকে অথচ ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তারা সেটা প্রতিরোধ করে না। আল্লাহ তখন তাদের উপরে সত্ত্বর ব্যাপকভাবে গযব নাযিল করবেন। আবুদাঊদের অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘যখন কোন কওমের মধ্যে পাপ কর্ম সম্পাদিত হয় এবং দুষ্কৃতিকারীদের চেয়ে ঐ কওমের জন সংখ্যা বেশী হয়, অথচ তারা তা প্রতিরোধের চেষ্টা করে না (তখন তাদের উপরে ব্যাপকভাবে গযব নাযিল হয়)।[14]

পরিশেষে বলব যে, এ পৃথিবীতে সামাজিক ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ঝড়-ঝঞ্ঝা, বন্যা-ঘুর্ণিবাত্যা যা কিছু হয়, সবই আল্লাহর হুকুমে বান্দার পাপ কর্মের কিছু ফল হিসাবে নাযিল হয়। যাতে তারা আল্লাহর পথে ফিরে আসে’ (রূম ৩০/৪১)। নূহের মুশরিক কওমকে ৮ দিন ব্যপী প্রবল ঝড়ের গযবে শেষ করা হয়েছিল। ছামূদ-এর কওমকে গগণবিদারী আওয়ায-এর মাধ্যমে এবং লূত-এর সমকামী কমওকে যমীন উল্টে দিয়ে নিশ্চিহ্ন করা হয়েছিল। জর্ডানের মরু সাগর (البَحْرُ الْمَيِّتُ) আজও যার ধ্বংস স্মৃতি হয়ে আছে। যেখানে আজ পর্যন্ত কোন মাছ, সাপ, হাঙ্গর, কুমীর ইত্যাদি কোনরূপ জলজ প্রাণী জীবনধারণ করতে পারে না। আজকের বাংলাদেশে নূহ, ‘আদ, ছামূদ, লূত্ব প্রমুখ নবীদের কওমের অন্যায় কর্মসমূহ একত্রিতভাবে ও বহুলভাবে চালু রয়েছে। অতএব তাদের ন্যায় গযবসমূহ আমাদের উপরে আসাটাই স্বাভাবিক। তবে সম্ভবতঃ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর একটি দো‘আ আমদের জন্য রক্ষাকবচ হয়ে আছে। যেজন্য উম্মতে মুহাম্মাদী একত্রে ধ্বংস হয় না। বরং কেউ ধ্বংস হয় ও কেউ বেঁচে থাকে উপদেশ হাছিলের জন্য। দো‘আটি ছিল নিম্নরূপ :

عَنْ عَامِرِ بْنِ سَعْدٍ عَنْ أَبِيهِ أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ- أَقْبَلَ ذَاتَ يَوْمٍ مِنَ الْعَالِيَةِ حَتَّى إِذَا مَرَّ بِمَسْجِدِ بَنِى مُعَاوِيَةَ دَخَلَ فَرَكَعَ فِيهِ رَكْعَتَيْنِ وَصَلَّيْنَا مَعَهُ وَدَعَا رَبَّهُ طَوِيلاً ثُمَّ انْصَرَفَ إِلَيْنَا فَقَالَ : صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ- سَأَلْتُ رَبِّى ثَلاَثًا فَأَعْطَانِى ثِنْتَيْنِ وَمَنَعَنِى وَاحِدَةً سَأَلْتُ رَبِّى أَنْ لاَ يُهْلِكَ أُمَّتِى بِالسَّنَةِ فَأَعْطَانِيهَا وَسَأَلْتُهُ أَنْ لاَ يُهْلِكَ أُمَّتِى بِالْغَرَقِ فَأَعْطَانِيهَا وَسَأَلْتُهُ أَنْ لاَ يَجْعَلَ بَأْسَهُمْ بَيْنَهُمْ فَمَنَعَنِيهَا-

হযরত ‘আমের বিন সা‘দ স্বীয় পিতা হ’তে বর্ণনা করেন যে, একদা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মসজিদে বনী মু‘আবিয়া-তে আমাদের নিয়ে দু’রাক‘আত ছালাত আদায় করেন ও দীর্ঘ দো‘আ করেন। অতঃপর আমাদের দিকে ফিরে বলেন, ‘আমি আল্লাহর নিকটে তিনটি প্রার্থনা করেছি। দু’টি কবুল হয়েছে, একটি হয়নি। আমি প্রার্থনা করেছিলাম যে, ‘আমার উম্মত যেন দুর্ভিক্ষে ধ্বংস না হয়’। এটা কবুল হয়েছে। আমি প্রার্থনা করেছিলাম যে, আমার উম্মত যেন ডুবে ধ্বংস না হয়। এটাও কবুল হয়েছে। আমি প্রার্থনা করেছিলাম যে, ‘আমার উম্মত যেন আপোষে লড়াই না করে’। এটি কবুল হয়নি।[15]

উপরোক্ত আলোচনার মাধ্যমে এলাহী গযব নাযিলের নিম্নোক্ত দু’টি ধারা পরিষ্ফুট হয়ে ওঠে। যেমন-

গযব নাযিলের ধারা :

(১) একটি জনপদে যখন অপ্রতিরোধ্য গতিতে ও ব্যাপকহারে অন্যায় কর্ম হ’তে থাকে, যতক্ষণ না তারা ফিরে আসে।

(২) উম্মতে মুহাম্মাদীকে আল্লাহ এক সাথে ধ্বংস করেন না। বরং কাউকে গযব দিয়ে কাউকে নিরাপদ রাখেন উপদেশ গ্রহণের জন্য।

অতএব সকলকে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়ের প্রতিরোধে যথাশক্তি নিয়োগ করতে হবে এবং আল্লাহর নিকটে তওবা করে তাঁর সাহায্য প্রার্থনা করতে হবে। নইলে ‘প্রকৃতির খেয়ালীপনা’ বললে প্রকারান্তরে আল্লাহকে গালি দেওয়া হবে ও কষ্ট দেওয়া হবে। আল্লাহ বলেন,إِنَّ الَّذِينَ يُؤْذُونَ اللهَ وَرَسُولَهُ لَعَنَهُمُ اللهُ فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ وَأَعَدَّ لَهُمْ عَذَابًا مُهِينًا- ‘যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে কষ্ট দেয়, আল্লাহ তাদের প্রতি ইহকালে ও পরকালে লা‘নত করেন। আর তিনি তাদের জন্য প্রস্ত্তত রেখেছেন লাঞ্ছনাকর শাস্তি’ (আহযাব ৩৩/৫৭)। আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করুন- আমীন!


[1]. বুখারী হা/৪৮২৬; মুসলিম হা/২২৪৬; মিশকাত হা/২২ ‘ঈমান’ অধ্যায়।

[2]. বুখারী হা/৪৭৭১; মুসলিম হা/২০৪; মিশকাত ‘রিক্বাক্ব’ অধ্যায় হা/৫৩৭২-৭৩।

[3]. বুখারী হা/৭৩২০; মুসলিম হা/২৬৬৯; মিশকাত হা/৫৩৬১।

[4]. বুখারী হা/৭০৬১; মিশকাত হা/৫৩৮৯।

[5]. আবুদাঊদ হা/৪২৫২; তিরমিযী হা/২২২৯; মিশকাত হা/৫৩৯৪।

[6]. আবুদাঊদ হা/৪২৫২; তিরমিযী হা/২১৮০; মিশকাত হা/৫৪০৬, ৫৪০৮।

রাসূল (ছাঃ)-এর জীবদ্দশায় ও খলীফা আবুবকরের যামানায় মোট চারজন ও পরে বর্তমান শতাব্দীতে ভারতের পূর্ব পঞ্জাবের গোলাম আহমাদ কাদিয়ানী (১৮৩৫-১৯০৮) সহ এযাবৎ পাঁচ জন ভন্ডনবী এসে গেছে। -লেখক।

[7]. বুখারী হা/৮১; মুসলিম হা/২৬৭১; দারেমী হা/২১০০; মিশকাত হা/৫৪৩৭, ৫৩৭৭।

সম্ভবতঃ ব্যাপকহারে যুদ্ধ ও খুন-খারাবীর ফলে যুবক পুরুষের সংখ্যা কমে যাবে ও নারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়া ব্যতীত পৃথিবীর অন্য সকল দেশে পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যা বেশী বলে জানা যায়। -লেখক।

[8]. বুখারী হা/৬৪৯৬; মিশকাত হা/৫৪৩৯।

[9]. মুসলিম হা/১৯২৪; মিশকাত হা/৫৫১৭।

[10]. মুওয়াত্ত্বা মালেক হা/১৬৭০; ‘জিহাদ’ অধ্যায়; মিশকাত হা/৫৩৭০; যঈফ আত-তারগীব হা/১০৯০, হাদীছটি ‘মওকূফ’।

[11]. মুওয়াত্ত্বা, টীকা দ্রষ্টব্য (মুলতান : মাকতাবা ফারূক্বিয়া, তাবি) ২৭১-৭২ পৃ.।

[12]. আবু ইয়ালা, সনদ জাইয়িদ; হায়ছামী, মাজমাউয যাওয়ায়েদ (বৈরূত : দারুল কুতুবিল ইলমিয়াহ, (১৪০৮/১৯৯৮) ৪/১১৮ পৃ.। 

[13]. ইবনু মাজাহ হা/৪০০৫; তিরমিযী হা/২১৬৮; মিশকাত হা/৫১৪২; ছহীহাহ হা/১৫৬৪।

[14]. আবুদাঊদ হা/৪৩৩৮, সনদ ছহীহ; মিশকাত হা/৫১৪২।

[15]. মুসলিম হা/২৮৯০ ‘ফিতান’ অধ্যায়; মিশকাত হা/৫৭৫১।