ব্যবসার নামে প্রতারণার ফাঁদ

প্রকাশিত খবর অনুযায়ী এমএলএম নামক বহুস্তর বিপণন কোম্পানী ও সমবায় সমিতি সমূহ মিলিয়ে গত ১৫ বছরে ২৮০টি প্রতিষ্ঠান দেশবাসীর অন্ততঃ ২১ হাযার ১৭ কোটি টাকা লোপাট করেছে। সবক্ষেত্রেই মূল উৎস ছিল লোভ। অর্থাৎ ১০০ টাকার পণ্য কিনলে তার চেয়ে দ্বিগুণ অর্থ ফেরত পাওয়ার লোভনীয় প্রস্তাব। প্রথমদিকে কোন কোন কোম্পানী ওয়াদা অনুযায়ী টাকা দিয়েছে। কিন্তু পরে টাকা নিয়ে সটকে পড়েছে। লোভে পড়ে গ্রাহকরা ধান গাছে তক্তা বানানোর আশা করেছিল। ফলে এখন কেবল বিক্ষোভ করাই সার। এভাবে ই-ভ্যালির প্রায় ৯৫ শতাংশ গ্রাহক প্রতারিত হয়েছে। প্রকাশিত খবর মোতাবেক ২০০৬ সালে ‘যুবক’ ২ হাযার ৬০০ কোটি টাকা, ২০১১ সালে ‘ইউনিপে টু ইউ’ ৬ হাযার কোটি, ২০১২ সালে ‘ডেসটিনি’ ৫ হাযার ১২১ কোটি এবং ২০০৮ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত সময়ে ২৬৬টি সমবায় সমিতি তাদের গ্রাহকদের ৪ হাযার ১শ কোটি টাকা লোপাট করেছে। এছাড়া ২০২১ সালে ১১টি প্রতিষ্ঠান তাদের গ্রাহকদের টাকা ফেরৎ দিচ্ছেনা বলে খবরে প্রকাশ। এসবের মধ্যে ‘ই-ভ্যালি’ ১ হাযার কোটি, ‘ই-অরেঞ্জ’ ১ হাযার ১শ’ কোটি, ‘ধামাকা’ ৮০৩ কোটি, ‘এসপিসি ওয়ার্ল্ড’ ১৫০ কোটি, ‘নিরাপদ ডট কম’ ৮ কোটি, ‘চলন্তিকা’ ৩১ কোটি, ‘সুপম প্রোডাক্ট’ ৫০ কোটি, ‘রূপসা মাল্টিপারপাস সোসাইটি’ ২০ কোটি, ‘নিউ নাভানা’ ৩০ কোটি এবং ‘কিউ ওয়ার্ল্ড মার্কেটিং’-এর ১৫ কোটি টাকা লোপাট করার ঘটনা প্রকাশ পেয়েছে। এদের অনেকে ধর্মের মুখোশে এই অপকর্ম করেছে। যেমন এহসান গ্রুপের চেয়ারম্যান জনৈক মুফতী তার জ্বালাময়ী বক্তব্যের মাধ্যমে এবং কুয়াকাটার জনৈক পরিচিত বক্তা এহসান গ্রুপের পক্ষে বলেছেন, ‘এহসান গ্রুপের সাথে ব্যবসা করা হালাল। এটি শুধু পিরোজপুরের জন্য নয়, বরং গোটা জগতের জন্য রহমত’। অথচ সূদ বিহীন বিনিয়োগের লোভ দেখিয়ে তাদের নামে ইতিমধ্যে গ্রাহকদের ১৭ হাযার কোটি টাকা আত্মসাতের খবর প্রকাশিত হয়েছে। এই গ্রুপের চেয়ারম্যান জনৈক মুফতী ও তার কয়েকজন সাথী মুফতী ও মাওলানা প্রতারণার ৫টি মামলায় গ্রেফতার হয়ে এখন কারাগারে আছেন। ইতিপূর্বে নিউওয়ে, জিজিএন ও ডেসটিনির মাথায় ডজন খানেক আলেমকে দেখা গেছে। এমনকি বিভিন্ন ইসলামী ব্যাংকের শরী‘আহ কাউন্সিলে আলেমদের ব্যবহার করা হয়। ব্যাংকের চাকুরীতেও তাদের কদর বেশী। অথচ কোন ইসলামী ব্যাংকই শতভাগ সূদমুক্ত নয়। এখানে উদ্দেশ্য কেবল মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে পুঁজি সংগ্রহ করা।

উপরের কোম্পানীগুলি ছাড়াও এ্যাপটেক, ডিএক্সএন সহ আরও অসংখ্য নাম না জানা কোম্পানী ও সমিতি দৈনন্দিন তাদের প্রতারণার জাল বিস্তার করে চলেছে। মানুষ শোষিত ও নিঃস্ব হওয়ার পর হতাশ হয়ে যখন কেউ আত্মহত্যা করে বা কেউ প্রশাসনের কাছে গিয়ে ধরনা দেয়, তখনই প্রশাসনের টনক নড়ে। যে জন্য হাইকোর্ট সরকারী পিপিকে প্রশ্ন করেছেন, আপনারা আগে টের পান না কেন? অথচ প্রশাসন হুঁশিয়ার থাকলে এদের দৌরাত্ম্য বৃদ্ধির কোন সুযোগ ছিলনা (এ বিষয়ে বিস্তারিত দ্রষ্টব্য :  ‘প্রতারণার অপর নাম জিজিএন’ আত-তাহরীক অক্টোবর ২০০০; ডেসটিনি বিষয়ক প্রশ্নোত্তর ২/৮২, ডিসেম্বর ২০০৮ সংখ্যা; হাফাবা প্রকাশিত ‘বায়‘এ মুআজ্জাল’ বই)

কিন্তু এযাবৎ প্রতারণার ফাঁদে পড়া ব্যক্তিদের কোন মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে এবং প্রতারিতরা তাদের সব টাকা ফেরৎ পেয়েছে ও প্রতারকরা যথাযোগ্য শাস্তি পেয়েছে, এমন কোন নযীর নেই। ফলে দিন দিন বাড়ছে প্রতারণার অভিনব কৌশল। কাউকে বলা হচ্ছে অমুক একাউন্টে ১০ হাযার টাকা জমা দিন, ২ সপ্তাহ পরেই আপনার একাউন্টে ১ লাখ টাকা জমা হয়ে যাবে। কাউকে বলা হচ্ছে, অমুক একাউন্টে ১ লাখ টাকা জমা দিন, ২ সপ্তাহ পরেই আপনার বাসায় ভারত-বাংলাদেশ  সীমানা চিহ্নিতকরণ  ম্যাগনেট সংযুক্ত  পিলার পৌঁছে যাবে। যার মূল্য কয়েক কোটি টাকা। দেখা গেল, ঐ কোম্পানীর নামে কয়েকজন লোক গাড়ীতে করে একটা আরসিসি পাইপ কাপড়ে ঢেকে নিয়ে আপনার বাড়ীতে এল। অতঃপর খুশী মনে আপনি তাদের রিসিভ করলেন। হঠাৎ লোকগুলি বলে উঠল, পালা পালা! ঐ পুলিশ আসছে’। অতঃপর গাড়ী ছুটল। আপনি হা করে তাকিয়ে থাকলেন। পরে মোবাইলে আপনাকে জানানো হ’ল, আপনি পুলিশকে জানাবেন না। তাহ’লে আর কখনোই এটা পাবেন না’। এরপর থেকে আবারও চলে তাদের একাউন্টে টাকা জমা দেওয়ার খেলা এবং চলে প্রতারণার নিত্য-নতুন প্রতিশ্রুতির ফাঁদ। এভাবেই প্রতারিত হচ্ছে দৈনিক শত শত মানুষ। দেশে প্রশাসনিক দেউলিয়াত্ব এবং ক্রমবর্ধমান বিচারহীনতার সুযোগে এসব প্রতারক চক্র বর্তমানে প্রায় প্রকাশ্যভাবেই তাদের নেটওয়ার্ক বিস্তৃত করে চলেছে। এমনকি নিষিদ্ধ ঘোষিত ডেসটিনিও ‘মিস্টার এ’ নামে সম্প্রতি আত্মপ্রকাশ করেছে। যাদের এমডি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের রোগী হিসাবে শাহবাগের বিএসএম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় তথা পিজি হাসপাতালের প্রিজন সেলে বসে তার এজেন্টদের সাথে সম্প্রতি ভার্চু্যয়াল মিটিং করেছে।

ডিজিটাল প্রতারণার আরেকটি ফাঁদ হ’ল ‘বিটকয়েন’ লেনদেন পদ্ধতি। এটি একটি ক্রিপ্টোকারেন্সি বা গুপ্ত মুদ্রার নাম। সারা পৃথিবীতে প্রায় হাযারেরও উপরে গুপ্তমুদ্রা রয়েছে। যেমন বিটকয়েন, ইথেরিয়াম, লাইটকয়েন, রিপ্ল, মোনেরো, ড্যাশ, বাইটকয়েন, ডোজকয়েন ইত্যাদি। তবে এগুলোর মধ্যে বিটকয়েন সবার পূর্বসূরী ও সবচেয়ে পরিচিত। এটি একটি বিকল্প ডিজিটাল মুদ্রা। সরকার বা ব্যাংকগুলি বিটকয়েন ছাপেনা বা নিয়ন্ত্রণ করেনা। কিন্তু কে বা কারা করে, সেটাও অস্পষ্ট। এই মুদ্রার লেনদেনে জালিয়াতি ও প্রতারণার প্রচুর সুযোগ রয়েছে (দ্র. আত-তাহরীক প্রশ্নোত্তর ১/৪০১, আগস্ট ২০২০)। ফলে ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে মিসর ও ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে চীন এই লেনদেন নিষিদ্ধ করেছে।

বস্ত্ততঃ সবকিছুর মূলে রয়েছে লোভ। একদল চতুর মানুষের পাতানো লোভের ফাঁদে পড়ে মানুষ প্রতিনিয়ত সর্বস্ব হারাচ্ছে। লোভ এমনই পাপ যে, লোভীর পতন দেখেও অন্য লোভীরা সাবধান হয়না। আর এজন্যেই বলা হয় ‘লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু’। 

প্রত্যেক মানুষের মধ্যে ষড়রিপু আছে। প্রতিটি রিপুই মানুষের প্রয়োজনে সৃষ্ট এবং প্রতিটির দক্ষ ব্যবহার কাম্য। যেমন টক-ঝাল-মিষ্টি-লবণ প্রতিটিই প্রয়োজন। কিন্তু অপরিমিত ব্যবহারে প্রতিটিই ক্ষতিকর। ষড়রিপুগুলি ইঞ্জীনে রাখা আগুনের বাক্সের মত। যাকে সর্বদা পাখা দিয়ে বাতাস করতে হয় এবং ড্রাইভার সর্বদা গিয়ার পরিবর্তনের মাধ্যমে আগুন নিয়ন্ত্রণ করে গাড়ী চালিয়ে থাকেন। দেহের মধ্যে লুক্কায়িত ষড়রিপুর আগুন সমূহের মধ্যে ‘লোভ’ হ’ল অত্যন্ত মারাত্মক। যাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারলে যেকোন সময় মানুষ খাদে পড়ে ধ্বংস হবে। মুমিন বান্দারা আল্লাহর ভয়ে নিজেকে সংযত রাখেন। কিন্তু ধর্মীয় ও সামাজিক অনুশাসন এবং রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের ভয় যখন থাকেনা, তখন মানুষ বেপরোয়া হয়ে যায়। দ্রুত মাল ও মর্যাদার লোভে সে যা খুশী তাই করে।

আল্লাহ বলেন, (১) ‘তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি তোমাদের জন্য পরীক্ষা মাত্র। আর আল্লাহর নিকটেই রয়েছে মহা পুরস্কার’ (তাগাবুন ৬৪/১৫)। তিনি বলেন, (২) ‘তারা কি ধারণা করে যে, আমরা তাদেরকে সাহায্য করছি ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি দিয়ে’। ‘এবং (এর দ্বারা) তাদেরকে দ্রুত কল্যাণের দিকে নিয়ে যাচ্ছি? বরং ওরা (আসল তত্ত্ব) বুঝে না’ (মুমিনূন ২৩/৫৫-৫৬)

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, (১) ‘প্রত্যেক উম্মতের জন্য ফিৎনা রয়েছে। আর আমার উম্মতের ফিৎনা হ’ল মাল’ (তিরমিযী হা/২৩৩৬)। তিনি বলেন, (২) দু’টি ক্ষুধার্ত নেকড়ে বাঘকে ছাগপালের মধ্যে ছেড়ে দেওয়া অত বেশী ধ্বংসকর নয়, যত না বেশী ধ্বংসকর মাল ও মর্যাদার লোভ মানুষের দ্বীনের জন্য (তিরমিযী হা/২৩৭৬)। রাসূল (ছাঃ) বলেন, (৩) ‘আমি তোমাদের দরিদ্রতাকে ভয় পাই না। বরং তোমাদের স্বচ্ছলতাকে অধিক ভয় পাই। তোমরা দুনিয়া অর্জনে মেতে উঠবে, অতঃপর দুনিয়া তোমাদের ধ্বংস করে দিবে। যেমন তা বিগত যুগের উম্মতকে ধ্বংস করেছে’ (বুঃ মুঃ মিশকাত হা/৫১৬৩)। তিনি বলেন, (৪) এমন একটি যামানা আসছে, যখন মানুষ তোয়াক্কাই করবে না যে, বস্ত্তটি হারাম না হালাল (বুখারী হা/২০৮৩)। তিনি বলেন, (৫) ‘অভাবগ্রস্ত মুসলমানরা ধনীদের পাঁচশ’ বছর আগে জান্নাতে প্রবেশ করবে’ (তিরমিযী হা/২৩৫৩)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, (৬) ‘ঐ ব্যক্তি সফলকাম, যে ইসলাম কবুল করেছে এবং তাকে প্রয়োজন মাফিক রিযিক দেওয়া হয়েছে। আর আল্লাহ তাকে যে রিযিক দিয়েছেন, তাতেই তিনি তাকে সন্তুষ্ট রেখেছেন’ (মুসলিম হা/১০৫৪; মিশকাত হা/৫১৬৫)। আল্লাহ আমাদেরকে লোভ দমন করে অধিকহারে পরকালীন পাথেয় সঞ্চয়ের তাওফীক দান করুন- আমীন! (স.স.)